E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

সাতক্ষীরা সিটি কলেজে জালিয়াতি ও প্রতারণা

সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদসহ চার শিক্ষকের জামিন নামঞ্জুর

২০২৩ নভেম্বর ৩০ ১৬:৪৯:৩৯
সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদসহ চার শিক্ষকের জামিন নামঞ্জুর

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রতারণা, জালিয়াতি ও তথ্য গোপনের মাধ্যমে কনিষ্ঠ শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত  মামলায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদসহ চার শিক্ষকের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন সাতক্ষীরা বিশেষ আদালতের বিচারক চাঁদ মোঃ আব্দুল আলীম আল রাজী।  বৃহস্পতিবার  দুপুরে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে তিনি এ আদেশ দেন।

জামিন নামঞ্জুর হওয়া আসামী আবু সাঈদ সাতক্ষীরার আশাশুনী উপজেলার কচুয়া গ্রামের ও বর্তমানে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল মধু মল্লারডাঙির মৃত নূরুল ইসলাম সরদারের ছেলে। অন্য আসামীরা হলেন, আশাশুনি উপজেলার নাকতাড়া গ্রামের আন্দুল হামিদ সরদারের ছেলে সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এসএম আবু রায়হান, সদর উপজেলার নেবাখালি গ্রামের আব্দুল কাদিরের ছেলে দর্শন বিভাগের প্রভাষক নাসির আহমেদ ও সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথ সরকারের ছেলে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক অরুন কুমার সরকার।

সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে চার প্রভাষককে এমপিওভুক্ত করার মাধ্যমে ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আশাশুনি উপজেলা কচুয়া গ্রামের ও বর্তমানে শহরের পলাশপোল মধুমল্লারডাঙীর বাসিন্দা সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদ, দেবহাটা উপজেলার উত্তর পারুলিয়া গ্রামের দেলবার মৃধার ছেলে সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোঃ মনিরুল ইসলাম, আশাশুনি উপজেলার নাকতাড়া গ্রামের আব্দুল হামিদ সরদারের ছেলে ইংরাজী বিভাগের প্রভাষক এসএম আবু রায়হান, সদর উপজেলার নেবাখালি গ্রামের আব্দুল কাদিরের ছেলে দর্শণ বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ এবং সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ধীরেন্দ্র নাথ সরকারের ছেলে হিসাব বিজ্ঞানের প্রভাষক অরুন কুমার সরকারের বিরুদ্ধে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক প্রবীর কুমার দাস ২০২২ সালের ৯ মার্চ খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা (৩/২০২২)দায়ের করেন। যাহা পরবর্তীতে সাতক্ষীরা বিশেষ আদালতে ২/২০২২ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দুদকের খুলনা অফিসের সহকারি পরিচালক বিজন কুমার রায় চলতি বছরের ৫ মে আদালতে ওই পাঁচ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

গত ২৬ অক্টোবর আদালত ওই পাঁচ আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। ৩০ অক্টোবর আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে বিচারক শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রভাষক মনিরুল ইসলামকে আগামী বছরের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত জামিনে মুক্তি দিয়ে প্রভাষক এসএম আবু রায়হান,নাসির আহমেদ ও অরুন কুমার সরকারকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গত ২৮ নভেম্বর মূল অভিযুক্ত সিটি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলহ্বাজ্ব আবু সাঈদ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আসামি পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন,অ্যাড. মোঃ শফিউল ইসলাম শফি, অ্যাড. মিজানুরন রহমান পিন্টু, অ্যাড. এম শাহ আলম, অ্যাড. আশরাফুল আলম।

দুদকের মামলার বিশেষ সহকারী পিপি অ্যাডভোকেট সাধন কুমার চক্রবর্তী চার আসামীর জামিন নামঞ্জুর করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

প্রসঙ্গত, অনিয়ম ও দূর্ণীতির মাধ্যমে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে রেজুলেশন জালিয়াতি করে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগ ও ২১ জন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৫ আগষ্ট সাতক্ষীরায় এসে তদন্ত শুরু করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক প্রবীর কুমার দাস। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুকুমার দাসকে সাতক্ষীরা এলজিইডি অফিসের রেষ্ট হাউজে ডেকে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের দূর্ণীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অবগত হন। অভিযুক্ত ২১জন প্রভাষক ও অধ্যক্ষ আবু সাঈদকে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফায় দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নেওয়া হয় তাদের লিখিত জবানবন্দি। পরবর্তীতে বাংলা বিভাগের প্রভাষক মোঃ মনিরুল ইসলাম, দর্শন বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এস্এম আবু রায়হান এবং হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক অরুন কুমার সরকারের কাগজপত্র জাল বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়।

২০১৯ সালের ২৪ জুলাই দুদকের হটলাইনে সিটি কলেজের এমপিও বঞ্চিত এবং কলেজ থেকে নিয়মবহির্ভুতভাবে বিতাড়িত বিধান চন্দ্র দাসসহ অন্যান্যদের অভিযোগের পর তদন্ত প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারির পর থেকে এসকল শিক্ষকদের তদন্ত কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হয়। অভিযুক্ত চারজন প্রভাষকের অনার্স শাখায় নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য জালিয়াতি করে ডিগ্রীর তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য ২০০৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি ওই বছরের ২৯ নভেম্বর নিয়োগ বোর্ড গঠণ করা হয়। ৪ ডিসেম্বর এক পরিপত্রে উক্ত বোর্ডের মাউশি প্রতিনিধি হিসেবে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি এলপিআরে যাওয়া অধ্যক্ষ সুকুমার দাসকে ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি দেখানো হয় যুদ্ধাপরাধী মামলায় তৎকালিন জেলে থাকা আসামী মাওলানাা আব্দুল খালেক মণ্ডলকে। ওই বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি উপরোক্ত চারজন শিক্ষককে ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর নিয়োগ চুড়ান্ত করা হয়।

যদিও ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, ওই চার প্রভাষকের নিয়োগকালে খালেক মণ্ডল সভাপতি ছিলেন না। ২০০২ সালের ২৪ জুন থেকে ২০০৬ সালের ৩ আগষ্ট পর্যন্ত খালেক মন্ডল সভাপতি ছিলেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, তৎকালিন অধ্যক্ষ ইমদাদুল হকের সময় ওই চারজন প্রভাষকের নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশন দেখালেও শুধুমাত্র কৃষি ডিপ্লোমার শিক্ষক আবু রায়হান ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ২০০৫ সালে। অন্য তিনজনের রেজুলেশন তার নয় বলে তদন্তে জানা যায়। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর রুপালী ব্যাংকের সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে সিটি কলেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন তালিকায় অধ্যক্ষ হিসেবে ইমদাদুল হক ও সভাপতি হিসেবে তৎকালিন সাংসদ এমএ জব্বারের সাক্ষর দেখা যায়।

মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়, ব্যান বেইস এর তথ্য অনুসারে মোঃ মনিরুল ইসলামের প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর। এসএম আবু রায়হানের যোগদানের তারিখ ২০০৫ সালের ১৭ মার্চ। মোঃ নাসির আহম্মেদ এর প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০১৬ সালের পহেলা ডিসেম্বর ও অরুন কুমার সরকারের যোগদানের তারিখ ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এইসব শিক্ষকদের যোগাদানের তারিখ জালিয়াতি করে মনিরুল ইসলাম ও অরুন কুমার সরকারের যোগদান ২০০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর, এসমএম আবু রায়হান ও নাসির আহম্মেদ এর যোগদান দেখানো হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। মাউশি’র ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির পূর্বে ডিগ্রী স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। এই পরিপত্র জারির পরপরই অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ওই চার শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিও ভুক্তির জন্য অফ লাইনে মাউশি বরাবর আবেদন করেন। এরই আলোকে তারা ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এমপিও ভুক্ত হন। অধ্যক্ষ আবু সাঈদের যোগসাজসে ওই চারজন শিক্ষক ২০১৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ২৯ আগষ্ট পর্যন্ত বেতন ভাতা বাবদ ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা রুপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।

সূত্রটি আরো জানায়, বর্তমানে আরো ১২জন শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিওযোগ্য নামের তালিকাভুক্ত করার অভিযোগে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই থেকে ১২ জুলাই দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তা তাদেরকে ডেকে নিয়োগ সংক্রান্ত সকল তথ্য উপাত্ত রেকর্ড করেন। এ ছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আজিম খান শুভসহ চারজনের নামে দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও বেতন ভাতা গ্রহণের পরিমান জানতে চাওয়া হয়েছে।

(আরকে/এএস/নভেম্বর ৩০, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test