E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

ডিম দিয়েছে খানজাহানের দীঘির কুমির ধলা পাহাড় পিলপিল

২০১৬ এপ্রিল ২১ ১৮:১৪:৪৭
ডিম দিয়েছে খানজাহানের দীঘির কুমির ধলা পাহাড় পিলপিল

বাগেরহাট প্রতিনিধি : বাগেরহাটে হযরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দীঘিতে প্রাকৃতিক ভাবে বংশ পরপম্পরায় বেড়ে ওঠা দেশের এক মাত্র মিঠা পানির কুমির ‘কালা পাহাড়-ধলা পাহাড়’ এর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ফের শুরু হয়েছে প্রাণান্তকর চেষ্টা।

এই দীঘির দক্ষিণ পাড়ের উঁচু ভিটিতে ৫ এপ্রিল সকালে ৪০-৪৫টি ডিম পেড়ে ধুলো চাপা দিয়ে ‘তা’ দেয়া শুরু করে কুমির ধলা পাহাড় পিলপিল। হযরত খানজাহানের মাজার শরীফের খাদেমরা ওই দিন দুপুরের মধ্যে কুমিরের ডিম তা দেয়া স্থানটির চারপাশ বাশের শক্ত খুটি গেড়ে উপরে সামিয়ানা টানিয়ে দেয়। কুমির আবারও ডিম পেড়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তোলপাড়। জেলা ও পুলিশ প্রশাসন, প্রাণী সম্পদ, সুন্দরবন বিভাগের করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা এখন প্রতিদিনই দেখভাল করতে ছুটে আসছেন মাজার শরীফে।

খানজাহানের মাজার শরীফে প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের শত-শত আশেকান, মুরিদ-ভক্ত ও পর্যটকরাও ছুটে আসছেন, কুমিরের ডিমে তা দেয়া দেখতে। ডিমে তা দেয়া অবস্থায় মাঝে- মধ্যে চোখ খুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে লোক সমাগম দেখছে ধলা পাহাড় নামে খ্যাত কুমির পিলপিল। আহার ও শরীর ভিজাতে রাতে এই কুমিরটি দীঘির পানিতে কিছু সময়ের জন্য নামলেও সারা দিন সে এক বারের জন্যও ডিমে তা দেয়া ছেড়ে উঠে যাচ্ছেনা।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো. জাহাংগীর আলম থেকে শুরু করে, প্রাণী সম্পদ বিভাগ, করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ, হযরত খানজাহানের শত-শত আশেকান, ভক্ত, মুরিদসহ মাজার শরীফের প্রধান খাদেম শের আলী ফকিরদের একটাই প্রত্যাশা, বিগত ৩০ বছরে অনেক প্রচেষ্টার পর এবার এই দীঘির কুমরের ডিম থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে বাচ্চা ফুটবে। এতে করে হযরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দীঘির সাড়ে ৬ শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি দেশের মিঠা পানির কুমির (মার্শ ক্রোকোডাইল) বিলুপ্তির হাত থেকেও রক্ষা করা সম্ভব হবে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খানজাহান (রহ.) মাজার এরাকায় ঘুরে বিভিন্ন জনের সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসছে তাঁদের এমনই প্রত্যাশার কথা।

হযরত খানজাহান (রহ.) মাজার শরীফের দীঘির কুমির ধলা পাহাড়- কালা পাহাড় কুমির নিয়ে রয়েছে অনেক কিংবদন্তির ইতিহাস। অধিকাংশঐতিহাসিকদের মতে, হযরত খানজাহান (র:) সুলতানী শাসন আমলে খ্রীষ্টিয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে বাগেরহাটে খলিফতাবাদ নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।

এসময় তিনি তাঁর সাম্রাজ্য জুড়ে বিশাল-বিশাল ৩৬০টি দীঘি খনন করেন। বাগেরহাটে খলিফাতাবাদে তার রাজধানীতে বিশাল একটি দীঘি খনন করে সেখানে মাজার শরীফও নির্মান করেন। পরে তিনি ওই দীঘির পানি যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে সেজন্য ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ নামে মিঠা পানির প্রজাতির এক জোড়া কুমির ছেড়ে দেন। হযরত খানজাহান (র:) নিয়মিত কুমির দুটিকে খাবার দিতেন, কুমির দুটি তাঁর হাত থেকে খাবার খেতো। তাঁর মৃত্যুর পরও মাজারের খাদেম ও ভক্তরা এই কুমির দুটিকে নিয়মিত খাবার দিতেন। ক্রমে এই কুমির যুগল বংশ বিস্তার করে এবং গত সাড়ে ৬ শ’ বছর ধরে বংশপরাম্পরায় তারা এই দীঘিতে উন্মুক্ত পরিবেশে বসবাস করে আসছিলো। এক সময়ে এই কুমির হযরত খান জাহানের ভক্ত অনুরাগীদের বিশ্বাস ও অনুভূতির প্রতীকে পরিণত হয়। এখনও প্রতিদিন শত-শত মানুষ মাতৎ করে কুমিরের খাবার হিসেবে নিয়ে আসে অসংখ্য মুরগি ও ছাগল। আর দীঘির এই কুমির হয়ে ওঠে এই মাজার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংগ। মাজারের এই কুমির নিয়ে এলাকার মানুষের মুখে অনেক কিংবদন্তি ও নানান লোক কাহিনী।

তবে, সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের নির্দেশে ১৯৮৫ সালে হযরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দীঘি থেকে কয়েকটি কুমির ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবার পর থেকেই কমতে শুরু করে এই দীঘির কুমির। এরপর থেকেই এই দীঘির কুমির ডিম পাড়লেও আর বাচ্চা ফুটা বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থার মধ্যে বয়ষসহ নানা কারণে ৭টি কুমির বিভিন্ন সময়ে মারা যায়। হযরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দীঘির মিঠা পানির কুমিরের সাড়ে ৬ শত বছরের ঐতিহ্য রক্ষা ও বিলুপ্তি ঠেকাতে সরকার ২০০৫ সালে ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাঙ্ক থেকে ছয়টি কুমির এনে এই মাজারের দীঘিতে ছাড়া হয়। মাদ্রাজ থেকে এনে ছাড়া ওই কুমিরের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মারামারিতে কালাপাহাড় গুরুতর আহত হয়। এর কিছুদিন পর কালাপাহাড় মারা যায়।

এরপর অবশিষ্ট থাকে ধলাপাহাড়। সেটিও ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মারা যায়। এখন হযরত খানজাহান (রহ.) মাজারের দীঘিতে রয়েছে ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাঙ্ক থেকে আনা মাত্র ৩টি মিঠা পানির কুমির। গত বছর জেলা প্রশাসন মিঠা পানির কুমিরের বিলুপ্তি ঠেকাতে এই দীঘির কুমিরের পাড়া ডিমের মধ্য থেকে ২২টি ডিম নিয়ে কৃত্রিম উপায়ে ফোটানোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে (ইনকিউবেটর) চেষ্টা করে করে ব্যর্থ হয়। সে কারণে এবার আর ইনকিউবেটরে কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো কোন চেষ্টাই করেনি জেলা প্রশাসন। তাই এবার কুমির যাতে করে কো উপদ্রব ছাড়াই প্রাকৃতিক পরিবেশে কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয় সেজন্য সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে কুমিরটিকে। প্রাণী ও সুন্দরবন বিভাগের করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা এখন নিয়মিত হযরত খানজাহান (রহ.) মাজার শরীফে এসে দেখভাল করছেন ডিমে তা দেয়া কুমিরটির।

বৃহস্পতিবার দুপুরে খানজাহান (র:) মাজার দীঘির দক্ষিণপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, শত-শত দেশ-বিদেমের দর্শনার্থীরা ‘তা’ দেয়া অবস্থায় থাকা কুমিরটি দেখছেন। তারা সবাই আশা করছে, এবার নিশ্চয় কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটবে।

বাগেরহাট খানজাহান (র:) মাজারের প্রধান খাদেম শের আলী ফকির বলেন, ২০০৫ সালের ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাঙ্ক থেকে এনে এই দীঘিতে ছাড়া মিঠা পানির কুমির গত কয়েক বছর ধরে ডিম দিলেও তাতে নতুন করে কোন বাচ্চা ফুটছে না। গত বছর এই দীঘিতে মিঠা পানির কুমির রক্ষায় জেলা প্রশাসন কুমিরের ডিম সংগ্রহ করে তা দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটানোর উদ্যোগ নেয়। আর এই কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটানোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (ইনকিউবেটর) দিয়ে সহযোগিতা করেছিল বেসরকারী সংস্থা এসিআই। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হয়নি। এবার আশা করছি প্রাকৃতিম ভাবে বাচ্চা ফুটবে। সে ব্যাপারে প্রশাসনের সহযোগিতা ও পরামর্শ নিয়ে আমরা এগুচ্ছি।

বাগেরহাট অতিরিক্ত জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. লুৎফর রহমান বলেন, গত বছর মাজারের দীঘির একটি কুমির ৫৫টি ডিম পাড়ে। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের একটি বিশেষজ্ঞ দল সেখানে গিয়ে ২২ ডিম সংগ্রহ করে তা দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা ফুটাতে ইনকিউবেটরে বসানো হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা না ফুটায় এবার প্রাকৃতিক উপায়ে বাচ্চা ফোটার জন্য সব ধরনের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়াসহ মাজার শরীফে গিয়ে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

(একে/এএস/এপ্রিল ২১, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test