E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

শিরোনাম:

সুন্দরবনে আগুন, ৬ জনকে আসামী করে আরো একটি মামলা

২০১৬ এপ্রিল ৩০ ১৭:১৪:৪৩
সুন্দরবনে আগুন, ৬ জনকে আসামী করে আরো একটি মামলা

শেখ আহসানুল করিম, সুন্দরবন : বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের পঁচিশ নাম্বার কম্পার্টমেন্টের এলাকায় ধরিয়ে দেয়া নাশকতার আগুন ৭৮ পর নিয়ন্ত্রনে এসেছে। শনিবার চতুর্থ দিন দুপুর ১২টার পরে কোথাও ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে আগুন জ্বলে উঠতে আর দেখা যায়নি।

ফায়ার সার্ভিসের হিসেব ইতিমধ্যে পুড়ে গেছে প্রায় ২০ একর বনাঞ্চল। নাশকতাকারীরা এবার সুন্দরবনের কয়েক কিলোমিটারের এলাকা জুড়ে অন্তত ২০ টি স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় অনেক উদবিড়াল,কচ্ছপ, গুইসাপসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণি আগুনে পুড়ে মারা গেছে।

এলাকাটি দূর্গম এবং পানির সুব্যবস্থা না থাকায় আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিটকে। চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনে চতুর্থ দফা নাশকতার আগুনের ঘটনায় ৬ জনকে আসামী করে শুক্রবার রাতে একটি বিভাগীয় বন মামলা দায়ের করেছে সুন্দরবন বিভাগ। এদিকে এই আগুনের ঘটনায় শরণখোলা থানা পুলিশ শুক্রবার রাতে খলিলুর রহমান হাওলাদার (৩৫) নামে একজনকে আটক করে গতকাল আদারতে পাঠালে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠাবার নির্দেশ দিয়েছেন। শনিবার বিকালে সুন্দরবনে নাশকতার আগুনের ভয়াবহতা সরেজমিনে পরির্দশনে করেছেন প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. ইউনুছ আলী। আজ রবিবার সকালে আসছেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। মন্ত্রী র্দূঘটনাস্থল পরির্দশন শেষে শরণখোলায় আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনী সংশ্লিষ্টদের সাথে মতবিনিময় করবেন। ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগ এতথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক মানিকুজ্জামান মানিক শনিবার বিকালে জানান, আমাদের ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট বুধবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে কাজ করে আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যে পুড়ে গেছে প্রায় ২০ একর বনাঞ্চলসহ অনেক উদবিড়াল, কচ্ছপ, গুইসাপসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণি। পানির অবাবসহ প্রখর তাপদাহ ও তীব্র বাতাসের কারনে আগুন নেভানোর কাজ বিঘ্নিত হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিকে ধানসাগর স্টেশনে স্ট্যান্ডবাই রাখা হচ্ছে।

চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনে চতুর্থ দফা এই নাশকতার আগুনের ঘটনায় ৬ জনকে আসামী করে শুক্রবার রাতে একটি বিভাগীয় বন মামলা দায়ের করেছে সুন্দরবন বিভাগ। ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বাদী হয়ে বন আইনে ৬ জনকে অভিযুক্ত করে বিভাগীয় এই মামলাটি দায়ের করেছে। এই বিভাগীয় মামলার আসামীদের বিরুদ্ধে সোমবার বাগেরহাটের আদালতে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা চাওয়া হবে। বিভাগীয় এই মামলায় নাশকতার আগুনে সাড়ে তিন একর বনাঞ্চল সম্পূর্ন পুড়ে ধ্বংসের কথা উল্লেখ করা হলেও কতো টাকার সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে ক্ষতি হয়েছে তা তদন্তের পরেই জানা সম্ভব হবে মামলার এজহারে বলা হয়েছে। এনিয়ে মাত্র এক মাসে চার দফা আগুনের ঘটয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহশাহান হাওরাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীসহ শাসকদলের ১৭ জনকে আসামী করে তিনটি মামলা দায়ের করা হলো।

বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মো. জহির উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, সুন্দরবনে এবারে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনের ধরনটা ছিলো সম্পূর্ন ভিন্ন ধরনের। ওইসব দুর্বৃত্তরা বনের তুলাতলা এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২০ টি স্থানে আগুন দিয়েছিলো। এটি সনাক্ত করতে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের সময় লেগেছে। যার কারনে আগুন নিভাতেও সময় লাগছে। আগুন সম্পূর্ন নিভে যাওয়ায় এখন তদন্তের পাশাপাশি জিপিএস সিষ্টেমের মাধ্যমে ধরিয়ে দেয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া এলাকাসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপনের কাজ চলছে ।

সুন্দরবনে নাশকতার আগুনের ভয়াবহতা সরেজমিন পরির্দশন শেষে শনিবার বিকালে প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. ইউনুছ আলী সাংবাদিকদের জানান, সুন্দরবনে একের পর এক পরিকল্পিত আগুনের ঘটনায় জড়িত সবাইকে আটক করতে আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। র্দূবৃত্তদের ধরতে অভিযান শুরু হয়েছে। সুন্দনবনের বিলে অবৈধ্য উপায়ে মিটা পানির মাছ ধরতে বনে আগুন দিযে কেউ পার পাবেনা। বন বিভাগের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই দূস্কর্মটির সাথে জড়িত থাকলে তাকেও খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় বন অধিদপ্তর জিরো টলারেন্সে থাকবে।

সুন্দরবনের আগুন ধরিয়ে দেয়ার নেপথ্যে :
সুন্দরবনসহ উপকূলের অপরাধ জগতের হাল নাগাদ খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র বলছে, দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অনেক সময় এক শ্রেনীর অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বাগেরহাটের শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় শাসকদলের কয়েকজন প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যান তাদের দস্যুবাহনী দিয়ে সুন্দরবনে মিঠা পানির মাছের ভান্ডার হিসেবেখ্যাত ১৮/২০টি বিল কথিত ইজারার নামে অবৈধ্য মাছ চাষ করতে পরিকল্পিত ভাবে বনে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ১২ এপ্রিল রাতে এবং ১৮ এপ্রিল সকালে ও সর্বশেষ ২৭ এপ্রিল ভোরে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী বনে ৩টি আগুনের ঘটনাটি নিয়ে এবার এমনই অভিযোগ তুলেছে খোদ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো.সাইদুল ইসলাম।

তিনি জানিয়েছেন, ১২ এপ্রিল রাতে এবং ১৮ এপ্রিল সকালে ও ২৭ এপ্রির বোওে সুন্দরবনে দেয়া আগুনের ঘটনায় বন বিভাগ আদালত এবং শরণখোলা থানায় পৃথক ৩টি মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। ওই দুটি নাশকতার আগুনের ঘটনায় শরনখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীসহ আসামী স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১৭ নেতা-কর্মীদের পুলিশ একজনকেও আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি।

ডিএফও জানান, এবারেও যারা সুন্দরবনে পরিকল্পিত ভাবে অগ্নিকান্ডের ঘটনার সাথে জড়িত প্রাথমিত তদন্তে ইতিমধ্যে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রবিবার সকালে বাগেরহাটের আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। তবে সুন্দরবনে পরিকল্পিত এসব আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনার মাষ্টারমাইন্ডদের কেন দ্রুত বিচার আইনের মামলার আসামী করা হচ্ছেনা ? সে বিষয়ে নিয়ে সরাসরি কোন মন্তব্য না করে এই বন কর্মকর্তা আরও জানান, বন বিভাগ কাইকে ছাড় দেবে না।

ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে গত ১৪ বছরে এনিয়ে ২২ বার আগুনে পুড়েছে । চলতি বছরের ২৮ মার্চ বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় লাগা আগুনে প্রায় দেড় একর এবং ১২ ও ১৮ এপ্রিল লাগা আরো দুটি নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বনভূসি। সর্বশেষ একই এলাকায় মাত্র এক মাসের মধ্যে চতুর্থ বার ২৭ এপ্রিল ভোরে ধরিয়ে দেয়া নাশকতান আগুন তিন দিন পর শূক্রবার মধ্য রাতে নিয়ন্ত্রনে এসেছে। শুধুমাত্র বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় লাগা এসব আগুনে প্রায় ৭০ একর বন ও পুড়েছে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ। সুন্দরবনকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষায় নেই বন বিভাগের কোন নিজস্ব অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা।

২০০২ সালের ২২ মার্চ ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড কটকা অভয়ারণ্যের প্রায় পনেরো দিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুনের মধ্য দিয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ শুরু হয় অগ্নিকান্ড। আগুন লাগানোর এসব দুস্কর্মের সাথে জড়িত আপরাধীরা সব সময় থেকে যায় ধরাছোয়ার বাইরে। গোটা সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে কেন বা কোন যাদুবলে শুধুমাত্র চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের কিছু এলাকায় একের পর এক আগুন লাগার বিষয়টি এখন মানুষের কাছে সচ্ছ আয়নার মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

(একে/এএস/এপ্রলি ৩০, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০২ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test