E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

পাকিস্তানে ফের সেনা অভ্যুত্থানের শঙ্কা!

২০১৪ সেপ্টেম্বর ০৫ ১৫:৪৫:৪৭
পাকিস্তানে ফের সেনা অভ্যুত্থানের শঙ্কা!

নিউজ ডেস্ক : পাকিস্তানের রাজনীতিতে কালো ছায়া যেন কাটছেই না। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়াদ দেড় বছর যেতে না যেতেই আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশটির পরিস্থিতি। পাক সেনাপ্রধান বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়টি নাকচ করে দিলেও সামগ্রিক পরিস্থিতিতে শঙ্কা কাটছে না। পাকিস্তানে বারবার নির্বাচিত সরকারকে হঠাতে সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাসই এই শঙ্কার কারণ।

ইসলামাবাদের রাজপথে হাজার হাজার সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের বসিয়ে রেখে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সরকারবিরোধী নেতা ইমরান খান ও তাহির উল কাদরি। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক মধ্যস্থতায় জড়িয়েছে এবং যেকোনো মুহূর্তে তারা সরকার পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে গুঞ্জন ওঠে।

তবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের এক বৈঠক শেষে এমন সম্ভাবনার কথা নাকচ করে গণতান্ত্রিক সরকারকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয় ওই বাহিনীর প্রচার বিভাগ (আইএসপিআর)।

এরপরেও আন্দোলনের মাঠ ছাড়তে নারাজ ইমরান। পিটিআই এবং পিএটি শক্তির সঙ্গে তৃতীয় শক্তি হিসেবে যোগদানের ইঙ্গিত দিয়েছে ফারুখ সাত্তারের মুত্তাহিদা কাওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)।

ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফে (পিটিআই) বেজে উঠেছে ভাঙনের সুর। এরই মধ্যে জাভেদ হাশমিসহ দলের শীর্ষ চার নেতাকে

পিটিআই দলে কোনো গণতন্ত্র নেই দাবি করে হাশমি বলেন, ‘আমি ইমরানকে আলোচনার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলাম।’ তিনি বলেন, যদি গণতন্ত্র ভেঙে যায়, তাহলে এ জন্য ইমরান খান দায়ী থাকবেন।

এছাড়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে আতাঁত করে ইমরান খান আন্দোলন করছেন বলেও অভিযোগ করেন জাভেদ হাশমি।

নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবিতে ১৪ আগস্ট ‘আজাদি মার্চ’ শুরু করে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এবং তাহির উল কাদরির দল পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি)। এরমধ্যেই পিটিআইয়ে কোন্দল দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসভবন ঘেরাও প্রসঙ্গে মতবিরোধের জের ধরে পিটিআই-য়ের প্রেসিডেন্ট জাভেদ হাশমিকে বরখাস্ত করেন ইমরান খান।

সংকট সমাধানে দেশটির পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বকারী সব রাজনৈতিক দল ও পিএটিকে নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট। আর সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অনড় ইমরান খানের পিটিআই ও তাহির-উল-কাদরির পিএটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করেছে সরকার। ঘোরতর সংকটে ঘুরপাক খেতে থাকা নওয়াজ সরকারের পরিত্রাণের চেষ্টার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে যৌথ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। যৌথ অধিবেশন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। বিরোধীদের সমর্থনে বলীয়ান নওয়াজ সরকার আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী ও দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছেন।

চলমান সংকট নিয়ে অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খান বলেন, ‘দেশ এখন খুবই কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। তবে কয়েক হাজার মানুষের দেশদ্রোহ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আছে দেশের ১৮ কোটি জনতার কণ্ঠস্বর এই পার্লামেন্ট। নির্বাচিত একজন নেতার নেতৃত্বেই এ দেশ পরিচালিত হচ্ছে। এতে কারও সন্দেহ থাকার কারণ নেই।’

ইমরান খান ও তাহির উল কাদরির যৌথ আন্দোলনে চরম রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে পাকিস্তান। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ইসলামাবাদ। শুধু আন্দোলন নয় নওয়াজের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়েও নেমেছেন ইমরান খান।

প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে সোমবার নতুন করে আইনি লড়াইয়ে নেমেছে পিটিআই। নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন দাখিল করেছেন পিটিআইয়ের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ইসহাক খান খাকওয়ানি।

ইমরান ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সরকার পতনের যে আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁর বিপক্ষের পাল্লাই বেশি ভারি। রাজনৈতিক পরিমন্ডলের প্রায় পুরোটাই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে নওয়াজের পদত্যাগের বিরুদ্ধে। এমনকি পার্লামেন্টে তাঁর ঘোর বিরোধীরাও এই কথা বলছেন। দেশের ব্যবসায়ী সমাজ, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, আইনজীবী ও আদালতও সরকার এবং সংবিধানের পক্ষে জোরদার সমর্থন ব্যক্ত করছেন। আন্দোলন শুরু করার সময় পাকিস্তানের রাজনীতিক, সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের চিন্তাটা ছিল এমন, পুরো জাতি তাঁর পেছনে এককাট্টা হবে। রাজধানী ইসলামাবাদে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ দেখে ভড়কে গিয়ে গদি ছাড়বেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।

কারণটাও অনুমান করে নিয়েছিলেন ইমরান খান। নওয়াজের ক্ষমতার প্রথম বছরটা কেটেছে চরম নড়বড়ে অবস্থার মধ্য দিয়ে। দায়িত্ব নেওয়ার সময় যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন, এই এক বছরে তা আরও শোচনীয় হয়েছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি আর নানা দুর্নীতির অভিযোগে সরকার জেরবার।

কিন্তু সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরুর পর প্রকৃতপক্ষে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। আন্দোলনকারীরা ইসলামাবাদ কাঁপিয়ে দিলেও জনগণের বড় একটা অংশই ইমরান খান ও তাঁর সমর্থকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

সবাই নওয়াজ শরিফের সমর্থক, বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রায় কেউই আরেকটি সংকট, আরও বেশি বিশৃঙ্খলা বা অস্বাভাবিকভাবে সরকার পরিবর্তন দেখতে চায় না। কারণ, এসব হলেই সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে দেশের চালকের আসনে চলে যেতে পারে।

সেনা হস্তক্ষেপ বারবার

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে উপমহাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ থেকে এখন পর্যন্ত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচয় পায়নি পাকিস্তান। বারবার সামরিক শাসনের কারণে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কখনও শক্তিশালী হয়নি দেশটিতে। পাকিস্তানের জন্ম আর সামরিক শাসন যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

পাকিস্তানের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলা থাকলেও দেশটির ৬৭ বছরের ইতিহাসে ৩২ বছরই সরাসরি শাসন করেছে সেনাবাহিনী। প্রথমে আইয়ুব খান, পরে ইয়াহিয়া খান এরপর জিয়াউল হক আর সব শেষে পারভেজ মোশারফ। অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে কিছুই হয় না, বিশ্বের কাছে যেন এ উদাহরণ তৈরি করেছিল পাকিস্তান। তবে এবার পারভেজ মোশাররফের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত মুসলিম রাজনীতিবিদ এবং পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং পাকিস্তানে তিনি মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর ডানহাত হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৫-৪৬ এর নির্বাচনে লিয়াকত আলি মিরাট থেকে নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের পর একটি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। লিয়াকত আলি সে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর লিয়াকত আলি খানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও সংবিধান রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তিনিই পাকিস্তানের সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। লিয়াকত আলির আমলেই দেশটিতে প্রথম সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিলো।

১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বৃটিশ সেনাপ্রধান ডগলাস গ্রেসি অবসরে গেলে জেনারেল আইয়ুব খানকে সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিয়োগ দেন লিয়াকত আলি। সে বছরই পাকিস্তানের প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এই অভুত্থান রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির পৌরসভা পার্কের থেকে মাত্র ১৫ গজ দূরে আততায়ী সাদ আকবর গুলি করে হত্যা করে লিয়াতক আলি খানকে। তবে কি কারণে লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করা হয়েছিলো তা আজও জানা যায়নি।

লিয়াকত আলি খানের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন খাজা নাজিমুদ্দীন। পাকিস্তানে তার শাসনামল স্থায়ী ছিলো দুই বছর। ১৯৫৩ সালে লাহোর বিক্ষোভের সময় তিনি পাঞ্জাবে সেনাবাহিনীর শাসন জারি করেন। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল সরকার ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেন খাজা নাজিম উদ্দিন।

১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আলী বগুড়া। খাজা নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ তাকে প্রধামন্ত্রীর পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। ১৯৫৫ সালের আগস্টে গোলাম মোহাম্মদ ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে পদত্যাগ করেন। নতুন গভর্নর জেনারেল হন ইস্কান্দার মির্জা। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালের ৮ আগস্ট মোহাম্মদ আলীকে পদত্যাগে বাধ্য করেন ইস্কান্দার মির্জা।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মোহাম্মদ আলীর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সংবিধান প্রণয়ন। যা পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান নামেই বেশি পরিচিতি পায়। এতো বড় অর্জন সত্ত্বেও আলী তার নিজ দল মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ঠেকাতে পারেননি। দলীয় কোন্দলের কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম লীগের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন ইস্কান্দার আলী মির্জা। সে সময় পাকিস্তান চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মাত্র দুবছরে দেশটিতে চারজন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সংবিধান বিলুপ্ত ঘোষণা করে দেশে সামরিক আইন জারি করেন ইস্কান্দার মির্জা। সেই সময়ে আইয়ুব খান প্রধান সেনা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পান। এভাবে ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল হয় এবং সকল রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পরে আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে বাধ্য করেন পদত্যাগ করতে।

২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ ইস্কান্দর মির্জাকে বিনা রক্তপাতে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন আইয়ুব খান। ক্ষমতায় বসে স্বপ্রণীত একটি "গণতান্ত্রিক" পদ্ধতি চালু করেন এবং নিজের ক্ষমতা আরও পোক্ত করেন। ১৯৬৩ সালে ফাতিমা জিন্নাহর সাথে প্রতিদ্বদ্বিতা করে ৬১% ভোটে জিতে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

ক্ষমতা গ্রহণের পর আইয়ুব খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেন। এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে গণদাবির মুখে তৎকালীন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন আইয়ুব খান।

১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও সামরিক শাসক ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার আদেশেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে মন্ত্রিসভা ত্যাগ নিজে আলাদা দল গঠন করেন, যার নাম দেন পাকিস্তান পিপ্লস পার্টি (পিপিপি)। পরবর্তীতে পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থায় একাধিকবার ভুট্টোর দল পিপিপি সরকার গঠন করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হন ইয়াহিয়া খানের স্থলে। ১৯৭৩ সালে দেশের সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ নেন। ১৯৭৭ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই জেনারেল জিয়াউল হকের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন ভুট্টো। জিয়াউল হক ক্ষমতায় এসে ফাঁসিতে ঝোলান প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে।

জিয়াউল হক ছিলেন দেশটির ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। পাকিস্তানের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনি সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হক মারা যাওয়ার পর অবসান হয় সামরিক শাসনের।

১৯৮৮ সালের নভেম্বরে পার্লামেন্ট নির্বাচনে পিপলস পার্টি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর ৩৫ বছর বয়সী মেয়ে বেনজির ভুট্টো হন পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। দুই বছর পরই ১৯৯০ সালের ৬ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেন তৎকালীন পাক-প্রেসিডেন্ট গুলাম ইসহাক খান। এরপর ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচনে পিপলস পার্টি আবারও জিতে এবং প্রধানমন্ত্রী হন বেনজির ভুট্টো। ১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আবারও বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট ওয়াসিম সাজ্জাদ। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে বেনজির ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টির আজীবন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং এবছরই অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার দল নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগের কাছে হেরে যায়।

পাকিস্তানের ইতিহাসে মোট তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন নওয়াজ শরিফ। প্রথমবার নওয়াজ সরকারের মেয়াদ ছিলো ১৯৯০ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯৩ সালের জুলাই পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল)। কিন্তু ভারতের সঙ্গে কারগিল যুদ্ধের এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাত করে ক্ষমতা নেন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফ।

২০০১ সালে ক্ষমতায় থেকে দল করে নির্বাচন দেন পারভেজ মোশারফ। কারচুপির সেই নির্বাচনে জিতেও আসেন তিনি। মোশারফের আধা সামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত।

২০০৭ সালের ২৮ নভেম্বর চিফ অব আর্মি স্টাফের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তারই উত্তরসূরি জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। পরে নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরে পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপি। পিপিপি তার নির্ধারিত সময় কোন মতে পার করলেও বার বার সংবাদের শিরোনাম হয় সেনাবাহিনী। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে পিপিপি প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সরকার ব্যবস্থা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০১৩ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয় দলটির। নওয়াজ সমর্থিত পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকার গঠন করেন।

প্রায় দেড় বছর মোটামুটি শান্তই ছিলো পাকিস্তানের পরিস্থিতি। নির্বাচনের পর থেকেই নওয়াজ সরকারের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ আনলেও, তা তেমন যুতসই ছিলো না। সম্প্রতি আরেক বিরোধী দল পিএটিকে সরকার বিরোধী কাঠোর আন্দোলন শুরু করে ইমরান খান। তবে এখনো তিনি নওয়াজের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির কোনো অকাট্য প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

তবে ইমরানের এই তৎপরতা ঠেকাতে এবার একাট্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপি নওয়াজ সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে। এই সমর্থন পাকিস্তানের ইতিহাসে নজিরবিহীন আর এটাই নওয়াজের সবচেয়ে বড় শক্তি।

(ওএস/এটিআর/সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০২ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test