E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

সরকার-বিরোধী ঐক্যের প্রশ্নে

২০২২ এপ্রিল ১১ ১৮:১৭:১৩
সরকার-বিরোধী ঐক্যের প্রশ্নে

রণেশ মৈত্র


যদিও জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আজ থেকে দেড় বছরের কিছু বেীশ বাকী আছে তবুও দেশের বিদ্যমান উদ্বেগজনক ও অসহনীয় পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে জনজীবন বিপর্য্যস্ত হয়ে পড়া, সরকারি দলের কিছু সংখ্যক সংসদ সদস্য সহ সকল স্তরে ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কালোটাকার অবাধ ও ব্যাপক প্রসার, নারী নির্য্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে লালন ও তাদের ব্যাপক প্রসার, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে বছরের পর বছর ধরে সরকারের অনীহা, আইনের আওতায় অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা না করা প্রভৃতির কারণে সরকার বিরোধী শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা অপরিহার্য্য হয়ে পড়েছে। কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করলেও এই সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নাম উচ্চারণ করলেও সরকার তার সকল কাজের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতি মালা প্রতিনিয়ত লংঘন করে চলেছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৫ দিনের ঐক্যবদ্ধ স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলণ কালে এরশাদের জারী করা কুখ্যাত অষ্টম সংশোধনী বাতিলের সুস্পষ্ট অঙ্গিকার থাকা সত্বেও অষ্টম সংশোধনীতে বর্ণিত “বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” কে যথারীতি বহাল রাখা হয়েছে এবং দেশের উচ্চতম আদালতের রায়ে যখন ওই অষ্টম সংশোধনী অবৈধ বলে ঘোষণা করলেন তখন ঐ রায় অনুযায়ী একটি গেজেট প্রকাশ করে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল না করে সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে এরশাদ প্রণীত ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ কে সাংবিধানিকভাবে স্থায়িত্ব দিয়ে দেশের নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। 

শুধু তাই ওই পঞ্চদশ সংশোধনী মারফত জিয়াউর রহমান প্রণীত “বিসমিল্লাহির রাহমানুর রহিম” ও জামায়াতে ইসলামী সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দলগুলিকেও অনুরূপ বৈধতা দেওয়া হয়েছে-কার্যত: পরিত্যক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাহাত্তরের ঐতিহাসিক সংবিধানে তৎকালীন জাতীয় পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত চার মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি পরিত্যাগ করা হয়েছে এবং দেশকে রাজনৈতিকভাবে ও আদর্শিক বিবেচনায় পাকিস্তানের কাছাকাছি ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নতুন গজিয়ে ওঠা জঙ্গীবাদী দল হেফাজতে ইসলাম একাধিকবার সারা দেশে তাণ্ডব সৃষ্টি করলেও তাদের গায়ে কাঁটার আঁচড়ও পড়ছে না বরং তারা সরকারের ধর্মীয় উপদেষ্টায় পরিণত হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা, তাঁর ভাস্কর্য্য নির্মাণ প্রকল্পকে হুমকি দিয়ে বাস্তবায়নের কর্মসূচি বাতিল করানো, পাঠ্যপুস্তকের সম্প্রদায়িকীকরণ প্রভৃতি দেশেকে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক অর্জনগুলিকে ম্লান ও বিবর্ণ করে তুলেছে।

অপরদিকে সম্প্রতি একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বর্ণিত রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতা আয়েন উদ্দিন এম.পি’র ব্যাপক দুর্নীতি খবর সবিস্তারে প্রকাশিত হওয়ায় এ কথা ধরেই নেওয়া যায়, সরকারের দায়িত্বশীল মহলগুলির একটি কত মারাত্মকভাবে লুঠপাট-দুর্নীতির মাধ্যমে আঙুল ফুলে আক্ষরিক অর্থেই কলাগাছ হয়েছে। দুর্নীতি দমন বিভাগ নামে একটি বিভাগের অস্তিত্ব থাকলেও ওই বিভাগ ক্ষমতাসীন মহলগুলির কারও গায়ে হাত দেয় না। তাদের কাজের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করছে যে ওই কমিশিনের কাজ হলো সরকার বিরোধী মহলগুলিকে শায়েস্তা করা।

দ্রব্যমূল্য প্রভৃতির ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে কিছু লেখার প্রয়োজন অনুভব করি না। কোটি কোটি মানুষ তাদের বিপর্য্যস্ত দৈনন্দিন জীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতায় তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করছেন। ঝাঁঝ দিয়ে পড়েছে স্বল্পবিত্ত, বিত্তহীন ও সকল স্তরের গৃহিনীদের উপর। এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অন্যায্য দামে পণ্য বিক্রয় বন্ধের, মুনাফাভোগি মওজুতদারী উচ্ছেদের ও কোন নজির নেই। সমগ্র বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতগুলি বড় বড় বে-আইনী সি-িকেট এবং ভাবে মনে হয় সরকার ঐ সিন্ডিকেটগুলির হাতের মুঠোয় বাঁধা। তাই সরকার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেই।

সরকারি গণ-বিরোধী, মানুষের মৌলিক অধিকার বিরোধী এবং জনগণের কণ্ঠের স্বাধীনতা হরণকারী আইন “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” এর বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা সত্বেও ওই উদ্দেশ্যে প্রণীত কালো আইনটি বাতিল করা হচ্ছে না।

অপরদিকে সীমান্ত আদিবাসীর সাথে যৌথভাবে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াতে রাঙ্গামাটি-কক্সবাজার এলাকায় সরকারি এক বিশেষমহল তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ সৃষ্টি করে বেসরকারি সশস্ত্র বাহিনী তৈরী করে পরস্পর পরস্পরকে হত্যার মারফত প্রতিদিন রাজপথ রক্তাক্ত করে তুলইে পাহাড়ে শান্তি ফিরিরে আনার কোন গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেই।
তা হলে কী করা?

দেশের সামগ্রিক ভয়াবহতার অংশ বিশেষ উপরের তুলে ধরলাম পরিস্থিতির বর্ণনা কল্পে। কিন্তু এমন অবস্থার সমাধান করে চতুর্থ সংশোধনীর মৌলিক স্তম্ভে ফিরে আসা, দুর্নীতি দমন করা, রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নয় সকল ধর্মের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িকতার উৎখাত, পাঠ্যপুস্তক সমূহের অসাম্প্রদায়িকীকরণ, দুর্নীতি দূরীকরণ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য্য নির্মাণ প্রভৃতি যে এই সরকার করতে অক্ষম তা তাঁরাই তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। এমন আরও বহু নজির তুলে ধরা যায়।

তাই আজ প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের। এবং ওই আন্দোলনের মাধ্যমে দাবীগুলি আদায়ের। আন্দোলন চূড়ান্ত পর্য্যায়ে নেওয়ার পরও মূল মূল দাবীসহ অপরাপর যৌক্তিক দাবীগুলি সরকার মানতে অসম্মত থাকে তা হলে সরকার বদলের দাবী উত্থাপন করে তার জন্য একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ইস্যুকে যুক্ত করে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে হবে। এক্ষেত্রে কী ধরণের ঐক্য গড়া প্রয়োজন?

জাতীয় ঐক্য

বিএনপি সহ সমমনা কতিপয় দল জাতীয় ঐক্য গঠনের আবেদন জানিয়ে আসছে ও দীর্ঘকাল যাবত কিন্তু সরকার বদল ছাড়া অন্য কোন দাবী তারা উত্থাপন করছে না। তারা স্পষ্ট করে বলছে না তারা বাহাত্তরের সংবিদানের অবিকল পুনরুজ্জীবন তাঁরা চান কি চান না। বলছেন না জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত ইসলামী নামক ধর্মাশ্রয়ী উগ্রপন্থী দলগুলিকে সংবিধান সংশোধন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চান কিনা, তাঁরা এ কথাও বলছেন না পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ বন্ধ করে তাঁরা অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি চালু করছেন কিনা-সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলি তাৎক্ষণিক আমলে নিয়ে অপরাধীদের বিচারের আয়োজন করবেন কি করবেন না-নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণের নীতি গ্রহণ করছেন না। দুর্নীতি দমনে নিরপেক্ষ নীতি তাঁরা গ্রহণ করবেন কি করবেন না। এই সকল গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক প্রশ্নে তাঁদের নীরবতা প্রমাণ করে-তাঁরা সে পথে এগুবেন না। তাই তাঁদের আকাংখিত জাতীয় ঐক্য শুধুমাত্র একদল থেকে অন্য দলকে ক্ষমতায় আনার লক্ষ্যে। এতে জাতির জীবনে আদৌ কোন পরিবর্তন আসবে না। বিগত দলগুলিতে কয়েক দফায় ক্ষমতার বদল তো ঘটছে কিন্তু তাতে মানুষের জীবনে কোন কল্যাণ কল্যাণ বয়ে আনে নি। তাই এ ধরণের জাতীয় ঐক্যের ধারণা পরিত্যজ্য।

বিকল্প কি বাম-ঐক্য? বিগত দু’তিন দশক ধরে সি.পি.বি সহ বামপন্থী দলগুলির বৃহৎ অংশ বাম-ঐক্য বাড়ার আহ্বান জানেিয় আসছেন-তাঁরা কতিপয় মার্কবাদী দলকে ঐক্যবদ্ধ করেওছেন। তাঁরা সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করে উপরে আলোচিত প্রায় সকল প্রশ্নেই সহমত ঘোষণা করেছেন। বাস্তবে তাঁরা কমিউনিষ্ট নেতৃত্ব বা কমিউনিষ্ট ঐক্য গড়াকেই লক্ষ্য হিসেবে ঘোষনা করেছেন যদিও স্পষ্ট করে তাঁরা তা ঘোষণা করেন নি।

দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদ যে দেশে সরকারি আনুকূল্যে বিস্তার লাভ করছে সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যখন ধর্মের নামে সহজেই বিভ্রান্ত হচ্ছে তখন কমিউনিষ্ট ঐক্য দ্বারা জনগণের মধ্যে ঠাঁই করে নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার প্রগতিশীল বদল অত্যধিক অনিশ্চিত ও অসম্ভবও বটে।

চাই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐক্য তাই কমিউনিজমে বিশ^াসী দলগুলি উচিত দেশের বাস্তব অবস্থার প্রতিকূলতাকে সঠিকভঅবে উপলব্ধি করে একটি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ব্যাপক ভিত্তিক ঐক্য গড়ে তুলে আন্দোলনে অগ্রসর হওয়া।
গণতান্ত্রিক শক্তি দেশে নেই এমন নয়। অমন শিক্ষা ঘোষণা করে অগ্রসর হলে, নিষ্ঠা ও প্রত্যয় এবং চিন্তার ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠে আন্তরিকতার সাথে অগ্রসর হলে অমন শক্তিগুলিও এগিয়ে আসবে-তা নির্দিষ্ট করে কেউই বলতে পারবে না। তবে আসবে অবশ্যই।

ভারতের উদাহরণ সামনে রাখতে পারি। সে দেশে হিন্দুত্ববাদী অসাম্প্রদায়িক সরকার বহু রাজ্যে ও কেন্দ্রে অবস্থিত। ধর্মের নামে তাঁরা মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভোটে জিতেছেন। এর বিরুদ্ধে সে দেশের কমিউনিষ্ট কংগ্রেসসহ আঞ্চলিক অসাম্প্রদায়িক দলগুলির সামনে ঐক্য গড়তে সক্রিয়।

মূল শত্রু সাম্প্রদায়িকতা এটাকে মেনে নিয়ে বাংলাদেশেও বাম প্রগতিশীল শক্তিগুলিকে কালবিলম্ব না করে ঐক্যবদ্ধ করার সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

১৪ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test