E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শ্রম অধিকার ও বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের গতিশীলতা

২০২৪ মে ০৯ ১৯:১১:৪৮
শ্রম অধিকার ও বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের গতিশীলতা

ড. প্রণব কুমার পান্ডে


বৈশ্বিক সম্পর্কের জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রায়ই এমন জটিলতা দেখা দেয়, স্বাভাবিকভাবে যার ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং দ্বন্দ্ব দুটোই দেখা যাচ্ছে। শ্রম অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসনীয় অগ্রগতির পরও এই বিষয়টিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে দেখছে না। এমন বৈপরীত্যকে বিশ্লেষণ করতে হলে অবশ্যই পররাষ্ট্রনীতির সহজ-সরল ব্যাখ্যাগুলো অতিক্রম করে এই সম্পর্কের বহুমুখী মাত্রা অন্বেষণ করতে হবে।

এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শ্রম অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। বছরের পর বছর ধরে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের কাজের অবস্থার উন্নতি, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে চলেছে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের মর্মান্তিক ঘটনায় ১১০০ জনেরও বেশি পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়, যা বাংলাদেশ এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে চলেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং অংশীদারদের সহযোগিতায়, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার মানকে শক্তিশালী করতে এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

তাছাড়া, বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াই এবং কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ-সমতা নিশ্চিতের জন্য আইন প্রণয়নে অগ্রগতি অর্জন করেছে। জাতীয় শিশুশ্রম নির্মূল আইন এবং শিশুদের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনার মতো উদ্যোগগুলো শিশুশ্রম নির্মূল এবং শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করেছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা, যেমন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের প্রতিনিধিত্বের জন্য কোটা বাস্তবায়ন, লিঙ্গ-সমতা এবং নারী অধিকারের প্রতি বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এই অগ্রগতির আলোকে অনেকেই এটা প্রত্যাশা করতে পারে যে বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে শ্রম অধিকারের পক্ষে কাজ করার জন্য একটি মডেল হিসেবে ঘোষিত হবে। তবে, বাস্তবতা ভিন্ন, কারণ বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে– শ্রম অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টার পরও বাংলাদেশ কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে?

এই ধরনের ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শ্রম বিধিমালা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দুর্নীতি এবং সম্পদের অভাবের মতো বিষয়গুলো শ্রম আইনের কার্যকারিতা হ্রাস করে চলেছে। অপর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োগকারী ব্যবস্থার কারণে আইন ভঙ্গের প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে, যা বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করছে।

তাছাড়া বিশ্বব্যাপী পোশাক শিল্প (যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি প্রধান খেলোয়াড়) সরবরাহ চেইনের একটি জটিল জালের মধ্যে কাজ করে যা প্রায়ই শ্রমিক কল্যাণের চেয়ে দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেয়। উৎপাদনের সময়সীমা এবং ব্যয়ের লক্ষ্য পূরণের চাপ অনিরাপদ কাজের পরিস্থিতি, কম মজুরি এবং শোষণসহ শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের মধ্যে পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বহুজাতিক করপোরেশন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভোক্তা দেশগুলোসহ স্টেকহোল্ডারদের একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

এছাড়া, ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান আঞ্চলিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা গতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে তার বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য আগ্রহ বজায় রেখেছে।

তবে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় পরিকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ওয়াশিংটনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবের ভারসাম্য রক্ষা এবং কৌশলগত অবস্থান বজায় রাখার প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে।

তাছাড়া, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক শাসনের মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার বিষয় হিসাবে কাজ করে। যদিও বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেশ কিছু অগ্রগতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে এই উদ্বেগগুলো দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের জটিল সমীকরণ সৃষ্টি করেছে।

এই জটিল প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েরই পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গঠনমূলক সংলাপ ও সহযোগিতায় সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশকে শুধু শ্রম অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বৃহত্তর আর্থসামাজিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। তাদের উচিত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে এবং টেকসই উন্নয়নের প্রসারে সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা।

একইভাবে, শ্রম অধিকার সমুন্নত রাখা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকারকে কাজ করে যেতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসাবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা জোরদার করতে পারে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী অংশীদারিত্বও গড়ে তুলতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক শ্রম অধিকার, ভূ-রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি জটিল বিষয়। শ্রম অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করলেও চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে এবং প্রচুর ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। সংলাপ, সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সম্মান বৃদ্ধি করে উভয় দেশই সবার জন্য আরও সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের পথ তৈরি করতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকের মতামত:

২১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test