একজন অনিমাদির কথা

প্রবীর বিকাশ সরকার : অনিমা মজুমদার কুমিল্লা শহরের একজন গৌরবান্বিতা নারী। একজন শিক্ষক, একজন সংগঠক, একজন লেখক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেই একটি ইতিহাস।
সেই কবে ছেলেবেলায় মাঝেমাঝে কচি-কাঁচার মেলায় যেতাম ফরিদা বিদ্যায়তন স্কুলে অনিমাদির পেলব আদর খাওয়ার জন্য। এই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন সুনাম অর্জন করেছেন তার চেয়েও বেশি সুখ্যাতি শিশুসংগঠক হিসেবে। গোড়া থেকেই সেই ষাটের দশকে তিনি কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। সুদীর্ঘ বছর পর তিনি এখন মেলার পরিচালিকা। তিনি যখন যৌবনের মধ্যগগনে তখন মেলার প্রধান সংগঠকরা ছিলেন বাঙালির অহঙ্কার বিপ্লবী অতীন্দ্রমোহন রায় তথা সবার দাদু, সাংবাদিক অসামান্য শিশুসংগঠক কিংবদন্তিসম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী তথা আমাদের প্রাণপ্রিয় মোস্তফাভাই এখন তাঁরা এই জগতে নেই কিন্তু তাঁদের শিক্ষায় লালিত অনিমাদি অসাধারণ একজন শিশুবান্ধব অভিভাবক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। তাঁকে চেনেন না এমন মানুষ মনে হয় কুমিল্লায় নেই।
বাগিচাগাঁওএর পুরনো বাসিন্দা অনিমাদির কোনো শত্রু আছে বলে শুনিনি। ছোটবড় সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্ব তাঁর। তিনি যেমন নরম মনের মানুষ তেমনি সাহসী এবং চৌকস। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হল অনেক বছর পরে ২০০৭ সালে। আমি তখন শিশুকিশোরপত্রিকা কিশোরচিত্র প্রকাশ করি। প্রথম সংখ্যায় তার একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলাম। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল একটি কিশোরী। ভালো নাচত মেয়েটি। নাম ভুলে গেছি। সম্প্রতি তার বিয়ে হয়ে গেছে বলে জানালেন সৈয়দ আহমাদ তারেক। কিশোরচিত্র পত্রিকার প্রকাশনা উৎসবেও অনিমাদি মঞ্চে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন।
সেই থেকে প্রায়শ দিদির বাসায় যাই। ঈশ্বর পাঠশালার খ্যাতিমান শিক্ষক বিমলেন্দু মজমুদার তথা বিমলদা তাঁর বড়দা। এই পরিবারের সবাই সুশিক্ষিত এবং মার্জিত রুচিবোধসম্পন্ন। একই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির চিরন্তন মেজাজধারী। তাঁদের বাড়িটি যেন সবসময় চাঁদের হাট হয়ে থাকে কচি-কাঁচার মেলার ছেলেমেয়েদের উচ্ছল উপস্থিতিতে।
ছেলেবেলায় যেমন তাঁর আদর খেয়েছি, মিষ্টি অভিমানসুলভ বকুনি খেয়েছি আজও তার পরিবর্তন ঘটেনি। এখনো তিনি বাসায় গেলেই হাত ধরে টেনে কাছে বসান। অভিযোগ করেন, ‘আসো না কেন? কোথায় থাকো?’ তারপর হেসে বলেন, ‘কি খাইবা কও । মুড়ি, নারকেলের নাড়ু আছে, মোয়া আছে।’ ভাবতেই পারি না এই ইন্টারনেটের যুগে এই চিরাচরিত খাবারগুলো দিয়ে প্রিয়জনকে আপ্যায়ন করেন অনিমাদি! আমার যতখানি মনে হয় এই একটি পরিবারই কুমিল্লা শহরে আছে যারা মনেপ্রাণে বাঙালি।
অনিমাদিদের বাড়িটি আজও তেমনি আছে যেমনটি কয়েক দশক আগে দেখেছি। টিনের গেটওলা টিনের চালের বাড়ি। পেছনে বিশাল আকাশচুম্বী ভবন উঠেছে। ফলে তার ছায়ায় অনেকটা অন্ধকার হয়ে গেছে বাড়িটা। কিন্তু যেটি ওই ম্যানশনে নেই সেটি আছে অনিমাদির বাড়িতে, শিউলি ফুলের গাছ আছে, অকাতরে গন্ধ বিলায়। টিনের চালে ঝমঝম করে যে বৃষ্টি পড়ে তার শব্দটি কত না রোম্যান্টিক!
২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার স্ত্রী নোরিকো মিয়াজাওয়া অসুস্থ শ্বশুড়কে দেখতে বাংলাদেশে গিয়েছিল। সপ্তাহখানেক ছিল। তখন অনিমাদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। অনিমাদি কত প্রকারের বাঙালি খাবার যে রেঁধে আমাদেরকে আতিথেয়তা করলেন তা কোনোদিন বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়! একাধিক ভর্তা, মাছভাজি, নিরামিশ, মাছের ঝোল দেখে নোরিকো প্রায় চিৎকার দিয়ে ওঠে আর কি! এত খেতে পারবে না সে বলে বসল। তাই শুনে অনিমাদি তার মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে হেসে বললেন, ‘তোমাকে সব খেতে হবে না গো জাপানি বউ। যা ইচ্ছে যতটুকু পারো খেয়ো।’ তারপরও ঠেলেঠুলে খেতে হয়েছে তাকে। খেতে খেতে বারংবার বলছিল,‘খুব মজা খুব মজা। খুব সুস্বাদু হয়েছে!’ বাংলাতেই কথা বলছিল। খাওয়ার পর টানা আড্ডা চলল। দুধচা খেলাম। কবি হাসনেআরা মিনাপা’ এবং আমার িএক মামী বাগিচাগাঁও থাকেন এই শহরে বৃটিশ আমলে খ্যাতিমান হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ দীনেশচন্দ্র রাউত এর ছেলে শিবুমামার স্ত্রী। সবাই সেদিন জাপানি বউ পেয়ে কত আনন্দ-ফূর্তি করেছেন!
২০১২ সালে অনিমাদিরা গঠন করলেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’ নামে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও হয়েছিল ঘটা করে জেলা প্রশাসক মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া উপস্থিত ছিলেন। এরকম প্রতিভাবান ভদ্র এবং পড়ুয়া ডিসি কুমিল্লার মানুষ খুব কম দেখেছে। তিনি বিনম্রকণ্ঠে সেদিন অনুষ্ঠানটিকে অন্যমাত্রা দিয়েছিলেন কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিচিতি তুলে ধরে। ডিসির সঙ্গেও অনিমাদির দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।
ঠাকুরপাড়াস্থ রামকৃষ্ণ মিশনভিত্তিক মা সারদা সংঘের তিনি অন্যতম কর্মকর্তা। প্রতি সপ্তাহে আশ্রমে রামকৃ্ষ্ণের মন্দিরের বারান্দায় সংগঠনের সভা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। অনিমাদি তার মধ্যমণি। আমি সময় পেলেই যাই। আবালবৃদ্ধবনিতারা আসেন আলাপ আলোচনা এবং গান গেয়ে মাকে স্মরণ করা হয়। এই সংস্কৃতিটিও হয়ত আর বেশিদিন টিকে থাকবে না। সংঘের একটি স্মারক সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন অনিমাদি। আমিও কিছুটা সাহায্য করার সুযোগ লাভ করলাম। শুধু তাই নয়, সংকলনের পুরো ডিজাইন ও লেআউট আমি তৈরি করে দিই। সেটা ছাপিয়ে দেবার দায়িত্বও আমার ওপর বর্তায়। পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমি স্বপনকুমার দাস তথা স্বপনদার প্রিন্টিং প্রেস মেঘামালাতে যাই ঢাকার আরামবাগে। অনিমাদি ও স্বপনদারা কচি-কাঁচার মেলার অনেক পুরনো সদস্য ও বন্ধু। সংকলন বের হলে কুমিল্লায় নিয়ে এসে দিদির হাতে প্রদান করি। অনিমাদি সেটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন।
ওই বছরের শেষদিকে অনিমাদি ঢাকায় যাবেন। আমারও কাজ ছিল। কাজেই একসঙ্গে বাসে রওয়ানা দিলাম। দীর্ঘ সময় লেগেছিল যেতে। মনে হয় তারেকভাইও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা নানা কথা বলতে বলতে সময় কাটাচ্ছিলাম। সন্ধেবেলা বাস থেকে নেমে আমরা গেলাম রামকৃষ্ণ মিশনে। মিশনের প্রবীণ মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। প্রসাদ গ্রহণ করে একটি সিএনজি ধরলাম। গুলশানে অনিমাদির ছোটবোন থাকেন। সেখানে একরাত অতিথি ছিলাম। চমৎকার বাড়িটি। ছাদে ফুলের বাগান দেখার মতো। কত জাতের যে ফুল গৃহকত্রী সংগ্রহ করেছেন। আমরা আড্ডা দিলাম। পরের দিন দুপুরবেলা আমার বোনের বাসা উত্তরায় চলে গেলাম।
মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে অনিমাদি আমাদের বাসায়েএকদিন এসেছিলেন। তখন আমার ছোটবোন রীনা যেটা বাহরাইন থাকে বেড়াতে এসেছিল। অনিমাদিকে দেখে সে তো ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা! কারণ রীনার প্রত্যক্ষ শিক্ষক ছিলেন অনিমাদি। সে ফরিদা বিদ্যায়তনের ছাত্রী ছিল। দুই প্রজন্মের আবার দেখা হয়ে গেল। এভাবেই প্রিয়জনের সঙ্গে প্রিয় মানুষের বারবার দেখা হয়ে যায়।
অনিমাদির বয়স হয়েছে। বিয়েও করেননি। সম্প্রতি বুকে অপারেশনও করিয়েছেন। তথাপি সচল আছেন কচি-কাঁচাদের নিয়ে। অনিমাদি কুমিল্লা শহরের একটা দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস। কুমিল্লার হাতেগোনা কয়েকজন অগ্রণী আধুনিক নারীর মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি প্রতিদিন।
অনিমাদি মানেই টিনের চালে সন্ধেবেলা হঠাৎ ঝমঝম ভারী বৃষ্টির পতন---ঝালমুড়ির আড্ডা, শরতের বিকেলে মৌ মৌ শিউলির গন্ধে বিভোর হওয়া, মোয়ার গুড়জাত ঘ্রাণ আর নারকেলের নাড়ুর দারুণ সুস্বাদ। কত কথা কত স্মৃতি রোমন্থনে চায়ের পেলায় ছলকে ওঠা অনিমাদির স্নেহরস অামার জীবনের অনন্য এক পাওয়া।
অনিমাদি সুস্থ থেকো, সুন্দর থেকো। আবার দেখা হবে এবং শিগগিরই।
লেখক : জাপানপ্রবাসী
(অ/জুলাই ০১, ২০১৪)
পাঠকের মতামত:
- ‘যারা পিআর দাবি করে তাদের নিয়েই সন্দেহ থেকে যায়’
- ‘নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে ২৭৬৩৭ জন নিয়োগ’
- মুক্তিবাহিনী কুড়িগ্রামে পাকহানাদার বাহিনীর চিলমারী ঘাঁটি আক্রমণ করে
- ৮ শতাধিক কিস্তি সুরক্ষা কার্ডধারী পরিবারকে ২ কোটি টাকার বেশি আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ওয়ালটন প্লাজা
- সাতক্ষীরায় শিক্ষককে লাঞ্ছনা, মানববন্ধনে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
- দিনাজপুরে জীবন মহল নিয়ে দুই পক্ষের বিক্ষোভ প্রতিবাদ সভা
- সাগরে ৩ দিন ধরে ভাসতে থাকা ৮ জেলে উদ্ধার
- স্থানীয়দের ধাওয়ায় সেনাক্যাম্পে আশ্রয় নিলো ভুয়া পুলিশ
- রাণীশংকৈলে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভিতরে গ্যাসের চুলায় রান্না
- সাবেক এমপি শফিকুল ইসলাম অপুর দুই দিনের রিমাণ্ড
- পাংশায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদ্বোধন
- ঈশ্বরদীতে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত
- চাটমোহরে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধন
- দোষীদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন সংবাদ সম্মেলন
- হারুনসহ ১৮ পুলিশ কর্মকর্তা চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত
- র্যাগিংয়ে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে স্কুলছাত্রী
- নগরকান্দা ছাত্রঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীর ওপর হামলা
- ইতালী প্রবাসীকে মারধর ও চাঁদা দাবির অভিযোগে বিএনপি নেতাসহ ৮ জনের নামে মামলা
- সালথায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের উদ্ধোধন
- বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পলাশবাড়ীতে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত
- সোনাতলায় নানা আয়োজনে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত
- নড়াইলে বিনামূল্যে দেড় হাজার রোগীকে চক্ষুচিকিৎসা ও লেন্স সংযোজন
- নিজ গ্রামে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন সহকারী মহাপরিদর্শক আবু তালেব
- নড়াইলে ট্রাক চাপায় গৃহবধূ নিহত
- কাপাসিয়ায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত
- বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী : আনন্দে-বেদনায়
- ঠাকুরগাঁওয়ে সফল নারীরা পেলেন সম্মাননা ক্রেস্ট
- বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস টি-টোয়েন্টি সিরিজ সিলেটে, দেখে নিন সূচি
- মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে আলোচনায় মাসুদা বেগম বুলু
- গৌরীপুরে প্রকৃতিতে শোভা ছড়াচ্ছে সোনালু ফুল
- একুশের কবিতা
- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’র কবিতা
- সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারের স্বীকৃতি দিলো বাংলাদেশ
- ‘অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের লক্ষ্য’
- সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু
- 'যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে বিদেশে গেলে কাজের অভাব হয় না'
- কুমিল্লায় ট্রাক্টর খাদে, চালকসহ নিহত ৩
- এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কথা
- ডেঙ্গুতে ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৪০৮ জন
- প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকের ৩৪ হাজার শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ
- মাইলস্টোন খুলছে রবিবার, ক্লাস হবে নবম-দ্বাদশের
- ‘পরের ১৫-২০ বছরও চেন্নাইয়েই থাকব’
- ১২ দিন পর খুললো মাইলস্টোন, নেই শিক্ষার্থীদের হৈ-হুল্লোড়
- তৃষ্ণার হ্যাটট্রিকে বাংলাদেশের গোল উৎসব
- বরিশালে বেড়েছে নারী মাদকসেবীদের সংখ্যা