E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রোহিঙ্গাদের এনআইডি সরবরাহ একটি পারিবারিক ব্যবসা!

২০১৯ সেপ্টেম্বর ২০ ১৫:১৭:৩৪
রোহিঙ্গাদের এনআইডি সরবরাহ একটি পারিবারিক ব্যবসা!

স্টাফ রিপোর্টার : আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাইয়ে দেয়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন অফিসে কর্মরত দুই পরিবারের সদস্যরা জড়িত বলে নিশ্চিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ দুই পরিবারের সদস্যরা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে কর্মরত।

বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের এক কর্মচারীকে গ্রেফতার করে মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। মোস্তফা ফারুক (৩৫) নামে ওই কর্মচারী চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীন হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কর্মরত। এর আগে সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে তিনি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, আনোয়ারা, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও বোয়ালখালী উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেন।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া জানান, জিজ্ঞাসাবাদের মোস্তফা ফারুকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য খুব স্পর্শকাতর। তাই তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তিনি জালিয়াতির ঘটনায় সরাসরি জড়িত। বৃহস্পতিবার রাতেই তার হামজার বাগের বাসায় অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু মালামাল জব্দ করা হয়েছে।

রাজেশ বড়ুয়া বলেন, ফারুকের কাছ থেকে নির্বাচন কমিশনের দুটি রেজিস্টার্ড ল্যাপটপ, একটি মডেম, তিনটি সিগনেচার প্যাড ও জাতীয় পরিচয়পত্র লেমেনিটিং মেশিন জব্দ করা হয়েছে।

সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ফারুকের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ডেল মডেলের ল্যাপটপটি নির্বাচন কমিশনের টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট শনাক্ত করেছেন, যা নির্বাচন কমিশনের ল্যাপটপ। তবে ল্যাপটপের তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে। আমরা পেনড্রাইভে রোহিঙ্গাদের অনেক তথ্য পেয়েছি। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গ্রেফতার মোস্তফা ফারুক চট্টগ্রাম নগরের হামজার বাগ এলাকার ভাড়াটিয়া বাসিন্দা মো. ইলিয়াসের ছেলে। তাদের স্থায়ী বাড়ি ফেনীর দমদমা লস্কর হাটে।

দুদক সূত্র জানা গেছে, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাতে গ্রেফতার মোস্তফা ফারুক নির্বাচন কমিশনের এক কারিগরি বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাইয়ে দেয়ার কাজ করছিলেন। ফারুক ওই ব্যক্তির চাচাতো ভাই। একই ব্যক্তির আপন ভাই নগরের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসে কর্মরত আছেন। এছাড়া তার এক ভাগ্নী বাঁশখালি উপজেলা নির্বাচন অফিসে কম্পিউটার অপারেটর পদে কর্মরত।

দুদকের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এনআইডি জালিয়াতি এ চক্রের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তির বোন চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কর্মরত। এছাড়া তার এক খালাতো ভাই অফিস সহায়ক পদে কর্মরত আছেন কক্সবাজার সদর নির্বাচন অফিসে। চাচাত ভাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন অফিসে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করেন।

মূলত ১৬ সেপ্টেম্বর ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ তিনজনকে আটকের পর জিজ্ঞসাবাদে রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাইয়ে দেয়ার এ নতুন চক্রের বিষয়ে জানা গেছে।

এদিকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালে কোতোয়ালী থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোস্তফা ফারুক। সে সময় হাবিব উল্লাহ সওদাগর নামে এক ব্যক্তি নগরীর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড থেকে ভোটার হওয়ার আবেদন করেছিলেন। ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ দেয়ায় তৎকালীন কোতোয়ালী থানা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ তার আবেদন বাতিল করেন। কিন্তু মোস্তফা ফারুক নিবন্ধন ফরম নম্বর পরিবর্তন করে ওই ব্যক্তিকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ওই ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্রও সংগ্রহ করেন। পরে ওই বছরের ২৯ জুন এ প্রকল্পের উপ পরিচালক মো. ইলিয়াস ভূঁইয়া তাকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।

দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বলেন, এর আগে গ্রেফতার জয়নাল বা জিজ্ঞাসাবাদে থাকা ফারুক নির্বাচন কমিশনে কর্মরত স্বজনদের যোগসাজোসে এমন বড় বড় কাণ্ড ঘটিয়েছে। দুটি চক্রেই তাদের পরিবারের সদস্যরা জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাইয়ে দেয়া চক্রের অনুসন্ধানে কক্সবাজার থেকে কাজ শুরু করে দুদক। টানা পাঁচদিনের অনুসন্ধানে কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা দালালসহ ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৬ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় জয়নাল আবেদীন, বিজয় দাস ও তার বোন সীমা দাসকে আটক করা হয়।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনির হোসাইন খান জানান, জয়নাল আবেদীনের হেফাজতে থাকা নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্স করা ল্যাপটপটি ব্যবহার করে ওয়েবক্যাম দিয়ে ছবি তোলাসহ জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজই করা যায়। জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে এন্ট্রিও দেয়া যায়। এই ল্যাপটপটি ব্যবহার করেই তারা এনআইডি জালিয়াতি করেছে। এ সময় জয়নাল আবেদীনের হেফাজতে থাকা নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্স করা একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়।

এ তিনজনকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসে জাল এনআইডি বানানোর পারিবারিক ব্যবসার চমকপ্রদ কাহিনী। যেখানে পুরো ঘটনার মধ্যমণি হয়ে কাজ করেছেন ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন।

জানা যায়, ২০০৪ সালে জয়নালের মামা তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সচিব স ম জাকারিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন অফিসে অফিস সহায়ক (চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) হিসেবে যোগদান করে। দীর্ঘদিন রাঙামাটি নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে কাজ করার পর ২০১৭ সালে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে আসেন। এরপরই জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কাজ শুরু করেন।

চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করে জয়নাল। তার এক মামার মাধ্যমে ২০০৪ সালে নির্বাচন কমিশনে অফিস সহায়ক হিসেবে নিয়োগ পায়। সেই বছরই দেড় কোটি ভুয়া ভোটার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কারণে জয়নালের মামাকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়। কিন্তু নিজের মামা নির্বাচন কমিশনের বড় কর্তা হওয়ায় জয়নালের আচরণ ছিল বেপরোয়া। সর্বশেষ তাকে বান্দরবানের থানচি নির্বাচন অফিসে বদলি করা হলেও তিনি পুনরায় নগরের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসে বদলি হয়ে চলে আসেন।

দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করা জয়নালের অন্তত ১০ স্বজন ঢাকা-চট্টগ্রামসহ নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন দফতরে চাকরি করছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত আছেন তার বোনের জামাই নূর মোহাম্মদ। নির্বাচন কমিশনের ঢাকা অফিসে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন জয়নালের স্বজন ওসমান গণী চৌধুরী, কক্সবাজার জেলা নির্বাচন অফিসে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত রয়েছেন জয়নালেন খালাতো ভাই মোজাফ্ফর। রাঙ্গামাটি জেলা নির্বাচন অফিসে উচ্চমান সহকারী হিসেবে কাজ করছেন জয়নালের আরেক স্বজন মোহাম্মদ আলী। এরমধ্যে কক্সবাজার নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মোজাফফর রোহিঙ্গাদের চট্টগ্রামে জয়নালের কাছে পাঠাতেন। চট্টগ্রামে নিয়ে আসতেন জয়নালের আরেক স্বজন জাফর ও আরেক সহযোগী নজিবুল আমিন।

চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, রোহিঙ্গাদের এনআইডির জন্য চট্টগ্রাম থেকে ছবি, আঙুলের ছাপসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু ডাবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক মো. জয়নাল আবেদীন সরবরাহ করতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছুটির দিনে অফিস থেকে নিয়ে আসা ওয়েবক্যাম, ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার যন্ত্র, স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাড বাসায় ব্যবহার করতেন। জয়নালের চাকরি অফিস সহায়ক হলেও থাকতেন ফ্ল্যাট বাসায়। নগরের সাব-এরিয়া এলাকায় জয়নালের বাসা ছিল ‘মিনি সার্ভার স্টেশন।‘

তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজে তাকে তার স্ত্রী ছাড়াও সৈকত বড়ুয়া, শাহজামাল, পাভেল বড়ুয়া, বয়ান উদ্দিন নামের চার ব্যক্তি সহযোগিতা করতেন। তবে ডাটা ইনপুটের কাজ করতেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক দুই কর্মচারী সাগর ও সত্যসুন্দর দে। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিটি জাতীয় এনআইডি বানাতে জয়নাল ৫০-৬০ হাজার টাকা নিতেন।

জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানায়, এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ করছেন। অফিস সহকারী হলেও নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্সধারী ল্যাপটপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ শুরু করেন ২০১৮ সাল থেকে। নির্বাচন অফিসের আরও অনেকে এ কাজে জড়িত। ৫০-৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রতিটি রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হতো। দালাল আর নির্বাচন অফিসের বিভিন্ন জনকে দেয়ার পর একজন রোহিঙ্গাকে ভোটার করার বিনিময়ে জয়নাল পেতেন সাত হাজার টাকা।

জয়নাল জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের উচ্চমান সহকারী আবুল খায়ের তাকে এ পথে আনেন। নজিবুল্লা নামে একজন দালাল আবুল খায়েরের মাধ্যমে তার কাছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসতেন। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে দালাল নজিবুল্লার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতেন আবুল খায়ের। তার সঙ্গে যুক্ত আছে কক্সবাজারের আরও অনেকে।

আবুল খায়ের ছাড়াও আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের মোজাম্মেল, মিরসরাই নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী আনোয়ার, পাঁচলাইশ থানা নির্বাচন অফিসের হোসাইন পাটোয়ারি টেকনিক্যাল ও বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ মোস্তফা ফারুক এসব কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে জানায় জয়নাল।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

০১ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test