E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মৎস্য কুড়ানী নারী-শিশুদের কাজ শুরু হয় সূর্যাস্তের পর

২০১৭ নভেম্বর ১৮ ১৫:৩৩:৩৭
মৎস্য কুড়ানী নারী-শিশুদের কাজ শুরু হয় সূর্যাস্তের পর

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : দুইডা নাতির ল্যাহাপড়া। ঘরে ইনকামের কেউ নাই। মোগো তো দুইডা খাইতে হয়। মাইয়া মানু (মানুষ)। মোরা তো গাঙ্গে মাছ ধরতে পারি না। তাই রাইতের আন্ধারে এইহানে মাছ বাছি। এক-দেড় ঘন্টা কাজ কইর‌্যা কয়ডা খাওনের মাছ পাই। হেই মাছ বেইচ্চাই চলে আমাগো সংসার। নাতি-নাতনীদের সাথে মাছ বাছতে বাছতে এ কথা বলেন ষাটোর্ধ্ব সাহাবানু।

উপকূলীয় কলাপাড়ার জেলে পল্লীগুলোতে এ মাছ বাছাইয়ের কাজ করেই চলে “মৎস্য কুড়ানী” অন্তত দেড় সহস্রাধিক পরিবারের সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়া। উপকূলীয় “মৎস্য কুড়ানী” নারী-শিশুদের কাজ শুরু হয় সূর্যাস্তের পর। সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে নিহত,নিখোঁজ ও অস্বচ্ছল জেলে পরিবারের নারী-শিশুরা এখন জেলে পল্লীতে ঘুরে ঘুরে কুড়ানীর কাজ করছে।

কুয়াকাটা জেলে পল্লী ঘুরে দেখে যায় অন্তত অর্ধ শতাধিক নারী-শিশু ব্যস্ত মাছ বাছাইয়ে। সাগর থেকে একেকটি ডিঙি নৌকা তীরে ভীড়লেই তারা দৌড়ে ছুটে যায় কাজের জন্য। বস্তায় বস্তায় মাছ এনে ফেলা হয় পল্লীতে। প্রতিটি বস্তায় অন্তত ৩০/৩৫ কেজি মাছ। ২-৩ ইঞ্চি সাইজের কোটি কোটি মাছের পোনা থেকে বিক্রির উপযোগী মাছ বাছাই করাই তাদের কাজ।

মাছ বাছাইয়ের ব্যস্ত চতুর্থ শ্রেণির সুমন ও শাবনুর। দুই হাত দেখলে অনুমান করা যায় কয়েক বছর ধরেই তারা এই কাজ করছে। হাতের প্রতিটি আঙ্গুল ও তালুতে অজস্র মাছের কাটার আঘাতের চিহ্ন। একই অবস্থা অন্যদেরও। কারো কারো হাতে দগদগে ক্ষত। তারপরও হাতে ক্ষত নিয়েই শেষ বিকালের আলোতে তারা ব্যস্ত মাছ বাছাইয়ে।

শাবনুর জানায়, বিহালে আইয়া মোরা দুইজনে তিন বস্তা মাছ বাছছি। হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ দ্যাখাইয়া বলেন দ্যাহেন না আইজ অনেক মাছ পাইছি। আইজ খাওনও যাইবে, ব্যাচাও যাইবে। মনে হয় দেড় কেজি হইবে। ব্যাগ খুলে দেখা যায় হাতের আঙ্গুল সাইজের কিছু পোমা, লইট্রা মাছ ও ছোট ছোট লাল চিংড়ি। কতো টাকা বিক্রি হবে জানতে চাইলে ঝটফট শাবনুরের উত্তর, মনে হয় পঞ্চাশ টাহা হইবে।

সুমন বলেন, যহন ক্লাস টুতে পড়ি তহন থেইক্কা রোজ দাদির লগে আইয়া এইহানে মাছ বাছি। তবে সবদিন খাওয়ার মাছ পাইনা। এই মাছ বেইচ্চাই আমাগো যে স্যারে পড়ায় তার বেতন দেই। জামা-কাপুড় বানাই। মোগো তো আর বাপ নাই। যে কিইন্না দেবে।

প্রায় সাত বছর ধরে মাছ বাছাইয়ের কাজ করছে স্বামী পরিত্যক্তা আকলিমা বেগম (৪৫)। দুই ছেলে থাকলেও তারা বিয়ে করে অন্যত্র চলে যাওয়ায় বৃদ্ধা মা ও তাকে চলতে হচ্ছে এই মাছ বাছাই করে। তার ভাষায়, দিনে কহনও মাডি কাডি। শাকপাতা টোহাই। আর সন্ধা হইলে এইহানে আইয়া মাছ ধরি। মাসের মধ্যে ১৫/২০ দিন এইহানে আই। কহনও এককেজি কহনও আধা কেজি মাছ পাই। মোগো দোহান আছে বাজারে, হ্যাগো ধারেই এই মাছ বেচি। ৪০/৫০ টাহা পাই কয়েক ঘন্টা কাজ কইর‌্যা।

কলাপাড়ার কুয়াকাটা,আলীপুর,মহীপুর, ঢোশ, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর, খাজুরা এলাকার অন্তত দশটি জেলে পল্লীতে এই মৎস্য কুড়ানীরা শুধু মাছ বাছাই করে বেঁচে থাকলেও তাদের নাম নেই কোন জেলে তালিকায়। জেলেদের কোন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা।

স্বামী ও সন্তান কিছুই নেই সফুরা বিবির(৫৫)। আগে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে চলতো সংসার। এখন সে মৎস্য কুড়ানী। গঙ্গামতি সৈকতে মাছ বাছাই করে এখন তার সংসার চলে। তিনি বলেন,“ মোগো এই কামে না রাখলে আমরা তো না খাইয়াই মইর‌্যা যাইতাম। তার মতো অন্তত তিন শতাধিক শিশু ও ১২ শতাধিক নারী এই“মৎস্য কুড়ানীর” কাজে জড়িত বলে জেলেরা জানান।

কলাপাড়ার জেলে পল্লীগুলোতে অন্তত ২০ হাজার খুটা জেলে সাত শতাধিক ইঞ্জিনচালিত ডিঙি নৌকায় করে মাছ শিকার করে। সাগরে দেড়/দুই কিলোমিটারের মধ্যে কারেন্ট,নেট ও সুক্ষ ফাঁসের জাল দিয়ে তারা মাছ শিকার করে। প্রতিটি নৌকায় গড়ে ২/৩ মন পোনা মাছ শিকার করে। প্রতিদিন গড়ে ২/৩’শ মন মাছ শিকার করে জেলেরা। কিন্তু ছোট ছোট সাইজের মাছ হওয়ায় এই মৎস্য কুড়ানীদের দিয়ে মাছ বাছাই করে বিক্রি উপযোগী বাজারে বিক্রি করে। বাছাই করা মাছ থেকে একটি অংশ দেয়া হয় তাদের। বাকি আগাছা মাছ শুকিয়ে তৈরি করা হয় মাছ ও মুরগীর খাবার।

জেলে আলামিন মিয়া বলেন, এ্যাতো মাছ তো আমাগো বাছা সম্ভব না। তাই হ্যাগো দিয়া বাছাই করি। আর সব গুড়া মাছ বাজারে নেলে পুলিশে ধরবে এই ডরে মাছ আইন্নাই বাছাইয়া হালাই। আনার লগে লগে না বাছাইলে মাছ পইচ্চা যায়।

একাধিক জেলে বলেন, আমাগো জালে এই ছোড মাছই বেশি ধরা পড়ে। এই মাছ ধরা নিষেধ। তাই মাছ তীরে আইন্নাই না বাছাইতে পারলে আর বেঁচা যায় না। বাজারে হগল পদের মাছ তো আর বেঁচা যায় না।



(এমকেআর/এসপি/নভেম্বর ১৮, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test