E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৪৬ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি কার্তিক বাওয়ালীর

২০১৭ ডিসেম্বর ৩০ ১৬:০৫:৪০
৪৬ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি কার্তিক বাওয়ালীর

সঞ্জিব দাস, গলাচিপা (পটুয়াখালী) : আমার কাছে মুক্তিযোদ্ধার কোন সনদ নাই, আছে শুধু যুদ্ধের স্মৃতি আর স্মৃতি। যুদ্ধের স্মৃতি হিসাবে আমার কাছে একখান সাদা হাফ হাতার জামা আছে। ওই সাদা জামার উপরে লাল কালির ‘মুক্তিবাহিনী’ লেহাডা আমারে বার বার মনে করাইয়া দেয় হেই যুদ্ধের কথা। জামাডা যত্ন কইরা রাইখা দিছি বাক্সের ভিতরে। মাঝে মাঝে জামাডা বাক্স থেইকা বাইর কইরা দেহি আর বুকভরা নিঃশ্বাস ফালাই। মৃত্যুর আগে যদি একটু দেইখা যাইতে পারতাম- মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম উঠছে, তইলে আত্মায় একটু শান্তি পাইতাম! কথাগুলো এক অসহায় বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক বাওয়ালীর (৭৭)।

তিনি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার চিকনিকান্দী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কচুয়া গ্রামের মৃত অটাল বাওয়ালীর ছেলে। তৎকালীন গলাচিপা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমসি প্রয়াত আ. বারেক মিয়ার বাড়ির দরজায় বিল কচুয়া খেয়াঘাটে খেয়া পারাপারের মাঝি ছিলেন ওই মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক বাওয়ালী।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হওয়ার পরেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম নেই অসহায় বৃদ্ধ কার্তিক বাওয়ালীর। সংসারে স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুদীর্ঘ সময় ধরে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে আজও বেঁচে আছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়া বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক বাওয়ালী। ছেলেরা বিবাহ করে অনেক আগেই যার যার সংসার নিয়ে কোন রকমে জীবন যাপন করে আসছেন। আর একমাত্র মেয়েটিও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর সংসারে চলে গেলেন। কিন্তুু সংসারে পড়ে রইলেন অসহায় বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা কার্তিক বাওয়ালী ও তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী।

ছোট্ট কুটিরে বৃদ্ধা স্ত্রী সহ কোন রকমে দিনাতিপাত করছেন অসহায় বৃদ্ধ কার্তিক বাওয়ালী । জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এ কেমন আহাজারি শোনা যাচ্ছে কার্তিক বাওয়ালীর মুখে ? এ যেন দেখার কেউ নেই! সংশ্লিষ্টদের কাছে বহুবার ধরনা ধরেও কোন ফল পাননি বৃদ্ধ কার্তিক বাওয়ালী। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠাবার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবেগ আপ্লুত হয়ে কাকুতি মিনতি করেছেন- এবার যেন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম উঠে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম এবার উঠবেই- এই বুকভরা আশা নিয়ে আজও তিনি বেঁচে আছেন। কিন্তুু উনি জানেন না- বাস্তব বড় নির্মম । কালের গর্ভে একদিন অনেক কিছুই বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তুু কার্তিক বাওয়ালীর সেই আহাজারি কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে। যারা তাঁকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম উঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন, তারা তালিকায় নাম উঠাতে পারলে ওই অসহায় বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার কষ্টটা একটু লাঘব হত। আর যদি তালিকায় তাঁর নাম না উঠে তখন সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার কী জবাব দিবেন তাঁর কাছে ? - এটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আপামর জন সাধারনের কাছে। কার্তিক বাওয়ালীকে প্রতিনিয়ত গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী অফিস ও গলাচিপা মুক্তিযোদ্ধা ভবনের সম্মুখে অসহায় এর মত ঘুরতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অসহায় বৃদ্ধ কার্তিক বাওয়ালী হতাশাগ্রস্ত হয়ে ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি যুদ্ধের সময় চিকনিকান্দীর মাঝগ্রাম, চিকনিকান্দী বাজার, দয়াময়ীর কালিমন্দির এলাকা, আলীপুরা ইউনিয়নের মধুপুরা গ্রাম, চরকাজল ও চরবিশ্বাস ইউনিয়নে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নৌকায় কইরা নিয়া যাই। এই খবর রাজাকারেরা পাইয়া আমার ঘরের সমস্ত মালামাল লুট কইরা নিয়া আমার ঘরটি পুড়িয়া ছাই কইরা দিয়া যায়।

এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য মো. বাবুল খাঁ বলেন, আসলেই কার্তিক বাওয়ালী নিতান্ত গরীব মানুষ। ছোট বেলা থেকেই শুনেছি যে, উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

এ বিষয়ে চিকনিকান্দী ইউপি চেয়ারম্যান এরশাদ হোসেন বাদল বলেন, কার্তিক বাওয়ালী আজ নিঃস্ব। যুদ্ধের সময় তাঁর ঘর লুট হয়েছে ও তাঁর ঘরটি রাজাকারেরা পুড়ে ফেলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নৌকায় পারাপার করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁদের মত লোকদের নাম উঠানো উচিত।

এ ব্যাপারে পটুয়াখালী জেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বাবু বাদল ব্যানার্জী বলেন, আসলেই কার্তিক বাওয়ালী যুদ্ধের সময় নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পারাপার করেছেন। এছাড়া তিনি অনেক গোপণ সংবাদও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দিতেন। দেশের জন্য তাঁর এ অবদানটুকু ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম উঠানোর বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে বিবেচনার জন্য গলাচিপা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়ার কাছে আমি লিখিত ভাবে অনুরোধ জানাই।

এ বিষয়ে সাবেক পুটয়াখালী জেলা ইউনিট কমান্ড, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ - এর ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নিজাম উদ্দিন তালুকদার বলেন, বিগত দিনে যারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন তাদের তুলনায় কার্তিক বাওয়ালীর ত্যাগ কোন অংশে কম নয়, মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম উঠা উচিত।

গলাচিপা উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মু. নুরুল ইসলাম ধলা বলেন, বিষয়টি আমি শুনেছি । এরকমের অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যাঁরা এখনও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি কোন না কোন কারণে।

এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে গলাচিপা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য কার্তিক বাওয়ালী আমার মাধ্যমে কোন আবেদন করেন নি।

(এসডি/এসপি/ডিসেম্বর ৩০, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test