E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চট্টগ্রামে বাড়ছে গণধর্ষণ, উদ্বিগ্ন প্রশাসন অভিভাবক

২০১৮ ফেব্রুয়ারি ০৫ ১৫:১৮:১৪
চট্টগ্রামে বাড়ছে গণধর্ষণ, উদ্বিগ্ন প্রশাসন অভিভাবক

জে জাহেদ, চট্টগ্রাম : বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গণধর্ষণ বাড়ছে ৷ দিন দিন একাধিক ধর্ষক মিলে একজন মেয়ে বা নারীকে ধর্ষণের মতো ঘটনা বিস্তৃত হচ্ছে। এতে স্থানীয় প্রশাসন ও যাদের ঘরে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া উপযুক্ত মেয়ে রয়েছে সেসব অভিভাবক চরম উদ্বিগ্ন বলে জানা যায়।

অন্যদিকে অনেক নারী সংগঠন, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এবং পুলিশের তথ্যে প্রমাণেও মিলছে ধারাবাহিক ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট ঘটনার। বিশ্লেষকরা বলছেন এর জন্য আইনের প্রয়োগ এর পাশাপাশি অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছেন।

নারীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে বাংলাদেশে ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েেছ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামের সংগঠনটি নারীদের উপর নির্যাতনের 'নির্মম ও নিষ্ঠুর' ধরণকে 'উদ্বেগজনক' বলে বর্ণনা করেছে।

অন্যদিকে, চট্টগ্রামে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণীর ৫ টি দৈনিক পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে একটি সংগঠন দাবি করেছে ২০১৭ সালে দুই শতাধিক ধর্ষণের শিকার হয়ছে। এমনকি তারা আরো বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে পুর্বের চেয়ে ছিনতাই, চুরি,ডাকাতি কমে আসলেও ধর্ষণ, নির্যাতন ও শিশুদের উপর নির্মম ও নিষ্ঠুরতা বেড়েছে।

যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সকল স্কুল কলেজে শিক্ষক শিক্ষিকাবৃন্দও । বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামে একটি সংস্থা সারাদেশের রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেছিলো, ২০১৭ সালে প্রথম ১০ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৩৭টি।

এছাড়াও চিকিত্সার বাইরে, সামাজিক চক্ষু লজ্জায়' যারা ঘটনা প্রকাশ করেন না। তাদের হিসাব পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ ওসিসি'র মতে সাধারণত চটগ্রামে এর শিকার ১২/১৯ বছর বয়সী উঠতি মেয়েরা৷ বাদ যাচ্ছেনা ঘরের গৃহবধূ সহ বেসরকারি চাকরিজীবি নারীও।

এ বিষয়ে নগরীর কোন না কোন থানায় ইভটিজিং ও নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিদিন মামলা হচ্ছে৷ এর মধ্যে চলন্ত বাসে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো বহু স্পর্শকাতর মামলার ও সৃষ্টি হচ্ছে। ক্রিমিনোলজির নিয়মে অপরাধও সামাজিক উপাদান। তবে তা নিয়ন্ত্রিত রাখা দায়িত্ব প্রশাসনের।

সাম্প্রতিক চট্টগ্রামে দুটি আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা বেশ নাড়া দেয় নগরীর সাধারণ জনগণকে। ভাবিয়ে তোলেছে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। যার একটি হল,২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর গভীর রাতে কর্ণফুলীর বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমিরপুর গ্রামে ৪ পাষন্ডের গণ ধর্ষণের শিকার হওয়া একই পরিবারের চার নারী। যা পরে থানা পুলিশের অভিযান ও পিবিআই পুলিশের তৎপরতায় কয়েকজনকে আটক করেছিলো।

তবে এখনো এর পেছনের প্রকৃত আসামীরা আড়ালে রয়েছে বলে মনে করছে স্থানীয় জনগণ। কেননা আসামীরা কৌশলে একে অপরকে দোষারোপ করে আদালতে জবানবন্দি দিয়ে তাল গোল পাঁকাচ্ছে বলে বাদী পক্ষেরও অভিযোগ ওঠেছে।

অপরদিকে কর্ণফুলি শাহমিরপুরের ঘটনার ৩৯দিনের মাথায় গণধর্ষণ শব্দটি আবারো ওঠে আসে গত ২১শে জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ্ থানা সংলগ্ন বিশ্বকলোনি এলাকায়।

মমতাজ মহল নামক পাঁচতলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার বারান্দা থেকে ফাতেমা আক্তার মিম নামে ৯ বছরের শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়,একে একে ৭ জন বকাটে মিলে তরুণীকে ধর্ষণ করে এরপর গলা টিপে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

সুত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর বন্ধের দিন এক নারী পোশাক শ্রমিক নগরীর পতেঙ্গা হতে বাসে ওঠলে লোকজন না থাকায় ড্রাইভার ও হেলপার মিলে মুখ বেধে ধর্ষণ করে। পরে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল মোড়ে ফেলে পালিয়ে যায়।

২০১৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর নগরীতে স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের দায়ে আমির হোসেন সুমন নামে এক যুবককে গ্রেফতার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

গত ২০ শে মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার উত্তর বাজালিয়া এলাকায় যুবতীকে গণধর্ষণ মামলায় ৫ আসামির প্রত্যেককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- দেয় চট্টগ্রামের একটি আদালত।

২০১৭ সালের পহেলা এপ্রিল চট্টগ্রামের সীতাকু-ের কুমিরা এলাকায় পাহায় এক নারীকে গণধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যসেবিকাকে গণধর্ষণ। এমনকি বাঁশখালীতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক কর্মীকে সংঘবদ্ধভাবে গণধর্ষণ করেছিল।

২০১৪ সালের চট্টগ্রামে একটি গণধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ফজল আহমদ (৩৩)কে গ্রেফতার করে পুলিশ।

২০১৫ সালের ১৮ই অক্টোবর চট্টগ্রামে স্বামী পরিত্যক্তা নারীকে গণধর্ষণ করে নির্মম ভাবে।

২০১৫ সালের নগরীর পাঁচলাইশ থানার বন গবেষণাগারের পাহাড়ি এলাকায় গণধর্ষণের শিকার হয় ২০ বছর বয়সী এক তরুণী।

নগরীর পটয়িা উপজেলার সুচক্রদন্ডী এলাকায় প্রতিবন্ধী এক কিশোরীকে ছয়জন মিলে গণধর্ষণ করায় কিশোরী আট মাসের অন্তঃসত্বা ছিল।

২০১৫ সালের ৮আগষ্ট চট্টগ্রামে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর এক গৃহবধূকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে দুর্বৃত্তরা। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত গভীর রাতে সীতাকু- উপজেলার ছোট কুমিরার এলাকা এ ঘটনা ঘটে।

পরিশেষে ২০১৮ জানুয়ারীতে সালে এক উপজাতি মারমা নারীকে সেনাবাহিনীর সদস্য কতৃক ধর্ষণের অভিযোগ তোলে নগরীর শহীদ মিনারে সংখ্যালঘুরা মানববন্ধন করে।

এভাবে একের পর এক গণধর্ষণ সংঘটিত হওয়ায় সাধারণ জনগণ ও অভিভাবকেরা বড়ই উদ্বিগ্ন। প্রশাসন এক্ষেত্রে অপরাধীদের সহজে আইনের মুখোমুখি করতে পারছেনা। নানা জটিলতায় যেমন, ধর্ষণের আলামত নষ্ট, মেডিকেল রিপোর্টে পেতে দেরি, অনেক সময় ধর্ষিত নারীরাও মামলা করতে অনীহা বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।

বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুল আবছার জানান, "চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে৷ অপহরণের পর নারীদের ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। সামাজিকভাবে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহবান করেন তিনি"।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম আইনজীবি সমিতির সদস্য তৌহিদুল মওলা জানান, "প্রথম কাজ হল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করা৷ তাঁর মতে, ধর্ষণ বিষয়ে আইনও সংশোধন করা প্রয়োজন৷ কেননা এখনো আমাদের আইনগুলো সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছেনা। যদি কার্যকর হতো ধর্ষণ ও অপরাধ কমতো।

তিনি আরো জানান, "ফিলিপাইনে যেমন মাদকের অপরাধে মৃত্যুদন্ড রেখেছে। তেমনি আমাদেরও ধর্ষণের বিষয়ে আর কঠিন পদক্ষেপ ও অভিভাবকদের সচেতনতা দরকার বলে মনে করি"।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সিনিয়র সহকারি পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম জানান,প্রথমে শাসন ও স্নেহ এই দুটি জিনিসের মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছেলেমেয়েদের বিনোদন মানেই এখন সিনেমা, নাচ-গান, যা প্রায়ই অশ্লীলতাই ভরপুর। তাতে বুঝে উঠার আগেই তরুণ কিশোর এই অকাজে অনেক সময় শুধু রিপুর তাড়নায় লিপ্ত হচ্ছে বলে জানান।

এছাড়াও তিনি আরো জানান,অভিভাবক - সন্তান এই দুটি সম্পর্কের মাঝে গুণগত সময় বাড়ানো দরকার। যাতে মাদক হতে সন্তানকে দূরে রাখা যায়। আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি সর্বশেষে ধর্মীয় অনুশাসন এবং সামাজিক মুল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে শিশু ও কিশোরকালেই। তাহলে অনেকটা ধর্ষণ কমবে।

(জেজে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test