E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরায় নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ‘প্রমত্তা বেতনা’ 

২০১৮ মার্চ ০৬ ১৬:৫৩:১৯
সাতক্ষীরায় নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ‘প্রমত্তা বেতনা’ 

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা :  নাব্যতা হারিয়ে সাতক্ষীরার প্রমত্তা বেতনা নদী এখন মৃতপ্রায়। দু’পাশে জেগে ওঠা চরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা, ঘরবাড়ি, মাছের ঘের ও ফসলি ক্ষেত। নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদ ও পাকা শ্মশান। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের কতিপয় দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারির কারণে জবরদখলের প্রতিযোাগিতায় হারিয়ে যেতে বসেছে বেতনা নদী।

সোমবার দিনভর সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি থেকে সদরের সুপারীঘাটা পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে বেতনা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ১০টির বেশি সংযোগ খাল রয়েছে। এ খাল গুলোর সঙ্গে রয়েছে স্লুইজ গেট। সংস্কার না হওয়ায় স্লুইজ গেটের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। পলিমাটি জমে বেতনা নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় বর্ষকালে বিলের পানি সংযোগ খালের মধ্য দিয়ে নদীতে পড়তে পারে না। উল্টে নদীর পানি লোকালয়ে বা বিলে এসে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় স্থায়ী জলাবদ্ধতার রুপ নেয়। ফলে বর্ষকালে সাতক্ষীরা সদরের দামারপোতা, মাছখোলা, পরমাছখোলা, বড়দল বাকডাঙ্গি, জিয়ালা, বদনার বিল, খেজুরডাঙি, গোবিন্দপুর, বারিগাছা, সানাপাড়া, কোমরপুর, তেতুলডাঙি, জাহানাবাজ, শাল্লে, ডাইয়ের বিল, গোপীনাথপুর, কৈখালি, শহরের রাজারবাগানসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। সেখানে হয়না আমন ধান। বোরো ধান হলেও তা যথেষ্ট নয়। বেতনা নদীর অধিকাংশ স্থান সংকুচিত হয়ে কোথাও ১৫ ফুট আবারে কোথাও ১০ ফুট চওড়া রয়েছে। সুপারীঘাটা, মাছখোলা, বিনেরপোতাসহ কয়েকটি ব্রীজ নির্মিত হওয়ায় ওইসব জায়গায় নির্মিত পিলারের গোড়ায় পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদী মরতে শুরু করে।

ডবশিষ্ঠ সমাজ কর্মী অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দুআল চন্দ্র রায় জানান, মুরারীকাটি থেকে সুপারীঘাটা পর্যন্ত বেতনা নদীর দূরত্ব প্রায় ৪৪ কিলোমিটার। খরস্রোতা এ নদীতে জাল পাতলে এক সময় জালের দড়ি কেটে যেত। নদীতে চলতো স্টিমার, লঞ্চ ও ব্যবসায়ি নৌকা। নদীপথেই বেতনা নদী থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যেত। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকে নদী শাসনের নামে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে স্লুইজ গেট নির্মাণ করার পর থেকেই বেতনাসহ বিভিন্ন নদ নদী নাব্যতা হারাতে থাকে। দু’পাশে জেগে ওঠে চর। চরের মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হতো ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থানে। আবার সুযোগ বুঝে এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী মহল জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ম্যানেজ করে নদীর দু’পাশের কিছু কিছু জমি ইজারা নিয়ে মাছের ঘের ও ধান চাষ শুরু করে। অনেকে নদীর বুকে আড়াআড়ি ভাবে নেটপাটা দিয়ে মাছ ধরায় সমস্যার সৃষ্টি হয়।

বর্তমানে বেতনা নদীর দু’ ধারের চর দখল করে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ৫০ টির বেশি ইটভাটা। তারা ক্ষতাসীন দলের কিছু নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দেদারছে ইট পোড়াচ্ছে ভাটায়। তারা নদীর পলিমাটি কৌশলে কেটে নিয়ে ব্যবহার করছে। আবার একটি মহল চর দখল করে ঘরবাড়ি বানিয়ে দরিদ্র ভূমিহীনদের কাছে হস্তান্তর করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ভূমিহীনদের কারণে নদীর দু’ধারে গড়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর পায়খানা। এখানে রয়েছে সুপেয় পানির সংকট। তাছাড়া কৃষি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি ঘের করায় এক শ্রেণীর মাছ চাষীেেদর কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জবরদখলের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে ইচ্ছা করলেই সরকার বা প্রশাসন তা উচ্ছেদ করতে গেলে সংঘাত হবে। নদী চরে জেগে ওঠা সরকারি খাস জমির আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে খুনের মত ঘটনা।

তারা আরো জানান, নাব্যতা ফেরাতে বেতনা খননের কোন বিকল্প নেই। জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালের ২২ জুলাই ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সাতটি প্যাকেজের মাধ্যমে কলারোয়ার মুরারীকাটি থেকে সদরের সুপারীঘাটার দিকে ২৫ কিলোমিটার নদী খননের জন্য টেণ্ডার আহবান করা হয়। ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই কাজ শেষ করার কথা থাকলেও সেই সময়ে জামায়াত শিবিরের নাশকতার কারণে ঠিকাদাররা কাজ করতে পারেনি। ফলে কাজের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়িয়ে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত ধার্য করা হয়। কিন্তু ২৫ শতাংশ খনন কাজ হওয়ার পর বিভিন্ন বিলের পানি কমাতে যেয়ে নদীর উপর নির্মিতি তিনটি ক্লোজার কেটে দিতে হয়।

বর্ষা শেষে দেখা যায় ক্লোজারের পাশে খননকৃত জায়গাগুলি আবারো পলিমাটিতে ভরে গেছে। নতুন করে খনন করতে দ্বিগুন খরচ দেখানোয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে কাজ বন্ধ করে দেয়। ফলে বেতনার তীরে বসবাসকারি মানুষজনের নতুন করে দুর্ভোগ দেখা দেয়। তখন একশ্রেণীর ভূমিদস্যু নদী চর দখলের প্রতিযোগিতা শুরু করে। যার ভয়াবহতায় পরিবেশ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে।

বেতনা নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি নুরুল হুদা জানান, অবিলম্বে বেতনা খননের জন্য দু’ধারের ইজারা বন্ধে জেলা প্রশাসককে আন্তরিক হতে হবে। উচ্ছেদ করতে হবে ইটভাটাসহ সকল অবৈধ স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবৈধ নির্মান বন্ধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড -২ এর সাতক্ষীরা শাখার সার্ভেয়র বিমল গায়েনের মত দুর্ণতিবাজ কর্মচারিকে বরখাস্ত করতে হবে। পুরাতন ইজারা বাতিল করে নতুন ইজারা দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অপূর্ব কুমার ভৌমিক জানান, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২৫ শতাংশ বেতনা খননে কোন সফলতা আসেনি বললেই চলে।বেতনা খননে ১,২, ৪ ও ৬ নং পোল্ডারের আওতাধীন নতুন করে ৪৪ কিলোমিটার ও মরিচ্চাপ নদীর ৩৭ কিলোমিটার খননের জন্য ৫৪৩ কোটি টাকা চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কাগজপত্র(ডিপিবি) পাঠানো হয়েছে।

নদীর নব্যতা বাড়াতে পাউবো-১ এর আওতাধীন দেবহাটার টিকেট ও শুকদেবপুর বিলে টিআরএম পদ্ধতিতে পাঁচ বছরের চন্য জলাধার নির্মানের পরিকল্পনা ডিপিবিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই পাঁচ বছর চলে গেলে বয়ারবাতান ও আমোদখালি বিলে টিআরএম গ্রহণ করা হবে। তবে তাদের চাহিদা খুবশীঘ্র একনেকে গেলে তা পাশ হলে তিন মাসের মধ্যেই বেতনা খনরে টেণ্ডার আহবান করা যাবে। দ্রুত শুরু করা যাবে নদী খননের কাজ। সেক্ষেত্রে সব নদী তীরবর্তী সব ধরণের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হবে।

(আরকে/এসপি/মার্চ ০৬, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test