E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুন্দরবনে সাড়ে ৩ বছরে ডুবেছে ১০ জাহাজ, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

২০১৮ এপ্রিল ১৯ ১৮:৩৪:৫৬
সুন্দরবনে সাড়ে ৩ বছরে ডুবেছে ১০ জাহাজ, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবন এখন জাহাজের ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে। একর পর এক ডুবছে পন্যবোঝাই লাইটর জাহাজ। সুন্দরবনের নদীতে পন্যবোঝাই লাইটারেজ জাহাজ ডুবির ঘটনা আগে থেকে ঘটলেও ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এসে জাহাজ ডুবির ঘটনা আশংঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। সাড়ে ৩ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম সংরক্ষিত এই বনের নদীতে তলা ফেটে ডুবেছে পন্যবোঝাই ১০টি লাইটার জাহাজ। সুন্দরবন ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কোন উদ্ধারকারী জলযান না থাকায় দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছেনা ডুবে যাওয়া এসব জাহাজ ও পন্য। ডুবে যাওয়া এসব জাহাজে থাকা ছড়িয়ে পড়ছে ফার্নেস অয়েল, সার, কয়লা, সিমেন্ট তৈরীর কাঁচামাল কিংঙ্কার, স্লাগ, জিপসান। এরফলে হুমকির মুখে পড়েছে ম্যানগ্রোভ এই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। ডুবে যাওয়া অনেক লাইটার জাহাজ উত্তোলন না করায় দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে সুন্দরবনের নদ-নদী।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ জানায়, ১৯৯৪ সালের আগষ্টে সুন্দরবনের কাছে পশুর চ্যানেলের বানিশান্তা এলাকায় একটি তেবাহী জাহাজ ডুবে গেলে প্রথম বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে সুন্দরবন। ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তেল।এরপর ১৯৮৮ সালের ১ জুলাই মোংলা বন্দরের কাছে একটি তেলবাহী লাইটার কার্গো জাহাজ দুর্ঘটনায় পশুর চ্যানেলে তেল ছড়িয়ে পড়লে সুন্দরবন আবারও বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। একই বছরের ১০ আগষ্ট সুন্দরবনের মাজহার পয়েন্টে অপর একটি তেলবাহী লাইটার কার্গো দূর্ঘটনায় পড়ে উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনে।

সুন্দরবনে নদীতে পন্যবোঝাই লাইটারেজ জাহাজ ডুবির ঘটনা আগে থেকে ঘটলেও ২০১৪ সালের সেপ্টম্বরে এসে জাহাজ ডুবির ঘটনা আশংঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পূর্ব সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ৬৩০ মেট্রিক টন সিমেন্ট তৈরীর কাঁচামাল নিয়ে তলা পেটে ডুবে যায় লাইটার জাহাজ ‘এমভি হাজেরা-২’। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পূর্ব সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ৬ শত মেট্রিক টন মট্রিক টন সিমেন্ট তৈরীর কাঁচামাল নিয়ে তলা পেটে ডুবে যায় লাইটার জাহাজ ‘এমভি নয়ণ শ্রী- ৩’।

একই বছরের ২৪ নভেম্বর পূর্ব সুন্দরবনের হরিনটানা এলাকায় তলাফেটে ডুবে যায় তিনতলা বিশিষ্ট যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি শাহীদূত’। একই বছরের ৯ ডিসেম্বর পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শ্যালা নদীতে তলা ফেটে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ডুবে যায় ‘ওটি সাউদার্ন ষ্টার - ৭’ নামের একটি অয়েল ট্যাংকার। সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নদ-নদী ও বনের প্রায় ৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অস্তিস্ব সংকটে পড়ে সুন্দরবন। এঘটনা দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই সময়ে ম্যানগ্রোভ এই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ছুটে আসতে হয় খোদ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেলদের।

এরপর ২০১৫ সালের ৫ মে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের মরাভোলা নদীতে তলা পেটে ডুবে যায় ‘এমভি জাবালে নূর’ নামের সার বোঝাই একটি লাইটার জাহাজ। সুন্দরবনের নদীর পানিতে গলে ছড়িয়ে যায় ৫ শত মেট্রিক টন পটাশ সার। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে তলাফেটে ডুবতে-ডুবতে অন্য একটি লাইটার জাহাজের সহয়তায় মোংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় আরো একটি কয়লা বোঝাই লাইটার জাহাজ। ওই একই বছরের ২৭ অক্টোবর সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে তলাফেটে ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় ‘এমবি জিয়ারাজ’ নামের একটি লাইটার জাহাজ।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শ্যালা নদীতে ১ হাজার ২৩৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে তলা ফেটে ডুবে যায় ‘এমভি সি হর্স - ১’ নামের একটি লাইটার জাহাজ। ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারী সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের মোহনায় ১ হাজার টন করয়া বোঝাই ‘এমভি আইচগাতি’ নামের একটি লাইটার জাহাজ ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে তলাফেটে ডুবে যায়। একই বছরের ৫ জুন সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ৮২৫ মেট্রিক টন সিমেন্ট তৈরীর কাঁচামাল স্লাগ নিয়ে তলাফেটে ডুবে যায় ‘এমভি সেবা’ নামের অপর একটি লাইটার জাহাজ।

সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল ভোরে মোংলা বন্দর চ্যানেলের পশুর নদীর হারবাড়িয়ায় সুন্দরবনের মধ্যে ৭৫০ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই একটি লাইটার জাহাজ এমভি বিলাস ডুবে যায়। কয়লা বোঝাই এই জাহাজ ডুবির পর এখনো শুরু হয়নি উদ্ধার অভিযান।

সুন্দরবনে প্রতিটি জাহাজ জাহাজ ডুবির পর বন বিভাগের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির রির্পোটে উঠে আসে সুন্দরবনের নদ-নদীর মূল চ্যানেল না চিনে জাহাজ চালানো, ফিটনেসবিহীন মেয়াদ উত্তীর্ণ জাহাজের চলাচল, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালকদের কারনে সুন্দরবনে ডুবোচরে জাহাজ উঠিয়ে দেয়ায় জাহাজগুলোর তলা ফেটে দুর্ঘটনা ঘটছে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের খামখেয়ালী পানার কারেনে এসব লাইটার মেয়াদ উত্তীর্ণ জাহাজগুলো পন্য পরিবহন করে আসছে। সুন্দরবন বিভাগ প্রতিটি জাহাজ ডুবির পর বনের জলজপ্রানীসহ জীববৈচিত্র্যের প্রাথমিক ক্ষয়খতি নিরুপন করে আদালতে করলেও তা এখনো রয়েছে বিচারাধীন। অন্যদিকে ডুবে যাওয়া অনেক লাইটার জাহাজ উত্তোলন না করায় দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে সুন্দরবনের নদ-নদী।

সুন্দরবন গবেষক ও সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম সুন্দরবনে একের পর এক লাইটার জাহাজ ডুবির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যনেল ও নদ-নদীতে মেয়াদ উত্তীর্ণজাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রন না করায় ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড এই বনের নদ-নদী এখন ডুবন্ত জাহাজের ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে। এত করে সুন্দরবনের গাছের শ্বাসমূলসহ জীববৈচিত্র্য, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ৬ প্রজাতির ডলফিনর, কয়েক শত প্রজাতির মাছসহ জলজ-প্রাণির প্রজননে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। ড. ফরিদ গত বছর ইউনেস্কোর বার্ষিক সভায় গৃহীত ‘সুন্দরবন সুরক্ষায় কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা’ দ্রুত করতে সরকারের কাছে দাবী জানান।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বারবার লাইটার জাহাজ ডুবির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সুন্দরবনে জলভাগে এভাবে পন্যবোঝাই লাইটার জাহাজ ডুবির কারনে জাহাজের পন্য দ্রবিভূত হয়ে ম্যনগ্রোভ এবনের পানি দূষিত হচ্ছে। এরফলে সুন্দরবনের কয়েক শত প্রজাতির মাছসহ জলজ-প্রাণি ও জীববৈচিত্র্য ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। দূর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া জাহাজ ও পন্য ওঠানো সম্ভব হলে সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি অনেক কম হতো।

বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদ হাসান বলেন, সুন্দরবনে প্রতিটি জাহাজডুবির পর বন বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটির রির্পোটে ভিত্তিতে সুন্দরবনের জলজপ্রানীসহ জীববৈচিত্র্যে ক্ষতির কারনে আদালতে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার কোনটিরই বিচার কাজ এখনো শেষ হয়নি।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর একেএম ফারুক হাসান বলেন, সুন্দরবন রক্ষাসহ মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ছড়িয়ে পড়া তেল জাতীয় পদার্থ দ্রুত অপসারনের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর ক্লিনার- ১ নামে নিজস্ব বর্জ্য অপসারণকারী জাহাজ কিনেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারের জন্য মোংলা বন্দর উদ্ধারকারী জলযান কেনার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে। উদ্ধারকারী জলযান কেনার বিষয়ে একটি প্রস্তাব দ্রুত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

(এসএকে/এসপি/এপ্রিল ১৯, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test