E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডির ৫ বছর 

সন্তানদের মানুষ করতে সহযোগিতা চান মৃত্যুঞ্জয়ী রোজিনা

২০১৮ এপ্রিল ২৪ ১৬:২০:৩৩
সন্তানদের মানুষ করতে সহযোগিতা চান মৃত্যুঞ্জয়ী রোজিনা

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ধ্বংসস্তুপের নীচে আটকা পড়া শ্রমিক রোজিনা। নিজের হাত নিজেই করাত দিয়ে কেটে বেড়িয়ে আসা রোজিনা নানা শারীরিক জটিলতায় ভোগছে। তার নিজের স্বপ্নগুলি মরে গেলেও চায় সন্তানদের মানুষ করতে। আর এজন্য সে সকলের সহযোগিতা চায়। 

ওরা দুই বোন রোজিনা বেগম ও মর্জিনা আক্তার জীবিকার তাগিদে কাজ করতো সাভারের রানাপ্লাজার তৃতিয় তলায় পোশাক কারখানায়। শত কষ্টের মাঝেও তাদের সংসার গোছানোর স্বপ্নটা অল্প অল্প করে এগোচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে। রানাপ্লাজা ধসের ঘটনায় মর্জিনার মৃত্যু হয়। আর ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়ে তিন দিন পর মৃত্যুকে জয় করে নিজের হাত নিজে কেটে বেরিয়ে আসেন রোজিনা। এরপর দীর্ঘদিন ঢাকায় চিকিৎসা শেষে রোজিনা ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে।

রোজিনার বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের গাজীপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ছফুর উদ্দিন। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে রোজিনা সবার বড়। বিভিন্ন সংস্থার অনুদান থেকে পাওয়া টাকায় ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়েকর গাজীপুর বাজারের পাশে এক টুকরো জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন রোজিনা। সেই বাড়িতেই স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে এখন তাঁর দিন কাটে। তবে বিভীষিকাময় সেইসব দিনের দুর্বিষহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে বেড়ায় রোজিনাকে। প্রায় রাতেই তার ঘুম ভেঙে যায় সেই ধ্বংসস্তুপের দুঃস্বপ্ন দেখে।

রানাপ্লাজা ধসের দিনের ঘটনা শুনতে চাইলে রোজিনার চোখ জলে ভিজে যায়। চোখের জল মুছতে মুছেতে রোজিনা বলেন ওই ঘটনা মনে করলে আমার কিছু ভাল লাগে না। আমি ওই দিনগুলোর কথা ভুলতে চাই। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে বেঁচে আসার গল্প বলতে রাজি হন।

তিনি বলেন, আগে থেকে রানাপ্লাজার ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ায় ঘটনার দিন গার্মেন্টস কর্মীরা কেউই ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছিলো না। সকাল ৮টার শিফটে একপ্রকার আমাদের জোর করেই কারখানার ভেতেরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ভয়ের কারণে কেউই কাজে মনোযোগী হতে পারছিলো না। বেশির ভাগ শ্রমিক নিজেদের মধ্যে আতঙ্ক নিয়ে কথা বলছিলো।

২৪ এপ্রিল আনুমানিক পৌনে ৯টার সময় আমার মেশিনের পাশের একটি পিলার জুরজুর করে ভেঙে পড়তে শুরু করে। শুরু হয় শ্রমিকদের চিৎকার আর আর্তনাদ। যে যার মত ছুটছে ফ্লোর জুড়ে। কেউ খুঁজছে সিঁড়ির পথ। এরপর আর কোনো কিছুই কথা মনে নেই। চেতনা ফেরার পর চোখ মেলেই দেখি ঘোর অন্ধকার। দিন না রাত বুঝতে পারছিলাম না। বাইরে থেকে অনেক মানুষের চিৎকার আর মাইকের শব্দ পাচ্ছিলাম। এক সময় টর্চ লাইটের আলো দেখতে পেলাম। কিন্তু গলা শুকিয়ে যাওয়ায় কথা বলতে পারছিলাম না। পানির পিপাসায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বাম হাতটা আটকে গিয়েছিল পিলারের নিচে। পা দুটো চাপা পড়েছে মেশিনের নিচে। সামান্য নড়াচড়াও করা যাচ্ছিল না। উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তুপ সরিয়ে আমাকে বের করে আনার অনেক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। অনেকটা দূর থেকে তাঁরা আমার সাথে কথা বলতো। একটা পানির বোতল ঢিল দিয়ে পৌঁছানো হয় আমার কাছে। নিজের হাতে পানি পান করতে পারেনি। ঢিল দেওয়ার সময় ছিটকে কয়েক ফোঁটা পানি মুখে পড়ে। আরও কিছু সময় পর একজন চিকিৎসক দূর থেকে আমার সঙ্গে কথা বলে শারিরীক অবস্থা জানেন। বাম হাতটা ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়েছিল। এভাবেই কাটে দুই দিন। উদ্ধারকারী দল ও চিকিৎসক নিয়মিত যোগযোগ করে যাচ্ছিলো।

দ্বিতীয় দিন রাতে চিকিৎসক আমাকে প্রস্তাব দেন নিজে নিজে বাম হাতটা কেটে বের হয়ে আসতে। কিছুতেই সেই সাহস করতে পারছিলাম না। দ্বিতীয় দিন গভীর রাতে জীবন বাঁচানো জন্য নিজের নিজের হাত কাটার সিদ্ধান্ত নিই। চিকিৎসকের শিখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে তৃতিয় দিন দুপুরে বিশেষ ব্লেড দিয়ে নিজের বাম হাত কেটে বের হই ধ্বংস্তুপের নিচ থেকে। শরীর ফুলে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর সিএমএইচ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিআরপিতে ৭ মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হই।

কথা প্রসঙ্গে রোজিনা বলেন‘ ধ্বংসস্তুপে চাপা থাকার সময় বারবার মনে হচ্ছিল ছোট বোন মর্জিনার কথা। আমরা দুই বোন পাশাপাশি কাজ করতাম। ভবন ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। তখন শুধু মর্জিনার কথাই মনে পড়তে থাকে। ও কি বেঁচে আছে না মরে গেছে তাই ভাবতে থাকি। আমি বেঁচে ফিরলেও তাকে আর খোঁজে পাইনি। পরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারি মর্জিনা ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে মারা গেছে। জুরাইন কবরস্থানে মর্জিনাকে দাফন করা হয়েছে। এরই ফাঁকে ঘরে এসে উপস্থিত হয় রোজিনার স্বামী সাইদুল ইসলাম।

কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একবার পহেলা বৈশাখে মর্জিনা কিছু ছবি তুলেছিল। সহকর্মীদের দেখানোর জন্য মর্জিনা ছবিগুলো কর্মস্থালে নিয়ে গিয়েছিল। ধ্বংসস্তুপের নিচে ছবিগুলোও চাপা পড়ে শেষ হয়ে গেছে। এরপর ছোট একটা ছবি ছিলো। সেটা এক সাংবাদিক ভাই নিয়ে যায়। পড়ে আর ফেরত পাইনি।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, খুব অল্প বয়সে রোজিনার বিয়ে হয়। স্বামীর একার উপার্জনের টাকায় ঠিক মতো সংসার চলছিল না। তাই রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় চাকরি নেয় সে। কিন্তু সেটাই জীবনের কাল হয়ে দাড়ায়। দুর্ঘটনার পর থেকে রোজিনা তাঁর পরিবার নিয়ে নিয়ে গাজীপুরে গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করছেন। তাঁর স্বামী সাইদুল ইসলাম গ্রামে চটের বস্তার ব্যবসা করেন। বড় মেয়ে রিমি আক্তার স্থানীয় একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সে বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। ছোট মেয়ে সাদিয়া আক্তারের বয়স তিন বছর।

শারীরিক সমস্যার কারণে ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না রোজিনা। ভাত রান্না করতে গেলেও অন্যের সাহায্য নিতে হয়। বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে প্রতিমাসে দশ হাজার টাকা অনুদান পায় সে। এছাড়া অপর আরেকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে গরু দেয়া হয়েছে তাকে। এগুলো দিয়েই চলছে তাঁর সংসার।

রোজিনার স্বামী সাইদুল ইসলাম বলেন, দূর্ঘনার পর থেকে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া রোজিনা কোনো কাজ করতে পারেনা। তাছাড়া রোজিনা শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, হাতে ব্যাথা সহ নানা রকম শারীরিক সমস্যা ভুগছে। প্রতিমাসে ওষুধ বাবদ চার হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিমাসে রোজিনাকে যে দশ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয় সেটাও আগামী দুমাস পর বন্ধ হয়ে যাবে। আমি গরীব মানুষ টাকার জন্য স্ত্রীর উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছিনা। অনুদানটা যখন বন্ধ হবে তখন, স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ, সংসার ও সন্তানদের পড়ালেখার খরচ কিভাবে চালাবো।

তবে রোজিনা বলেছেন, নিজের জীবন নিয়ে আমার আর কোনো স্বপ্ন নেই। অভাবের সংসারে নিজেরা লবন দিয়েও ভাত খেতে পারবো, কষ্ট হবে না। কিন্তু টাকা ছাড়া তো সন্তানদের ভালো জায়গায় পড়ালেখা করানো যাবে না। তাই সরকার ও হৃদয়বানদের কাছে আমার আকুতি আমার সন্তানদের যেনো পড়ালেখার করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কারণ আমি চাইনা ওরা গার্মেন্টেসে কাজ করুক। আর যে ব্যক্তির জন্য (রানা প্লাজার মালিক) এতো মানুষের প্রাণহাণি হলো, অনেকই পঙ্গুত্ব বরণ করলো, তাঁরও বিচার হওয়ার উচিৎ।

(এসআইএম/এসপি/এপ্রিল ২৪, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৮ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test