E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডির ৫ বছর 

আজও মাকে খোঁজে শিশু জেরিন

২০১৮ এপ্রিল ২৪ ১৬:২৯:১৯
আজও মাকে খোঁজে শিশু জেরিন

ছাদেকুল ইসলাম রুবেল, গাইবান্ধা : দেড় বছর বয়সে রানা প্লাজা ধসে মাকে হারিয়েছিল ছোট শিশু জেরিন। মাকে হারানোর পর তার ঠাঁই হয়েছে দাদির কোলে। ঘরে থাকা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি হাতে নিয়ে আজও মাকে খোঁজে জেরিন। মায়ের কথা বলতেই কেঁদে ওঠে সাত বছরের শিশু জেরিন।

জেরিনের সঙ্গে কথা হলে সে বলে, ‘মায়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকতে মা প্রতিদিন কাজে যাওয়ার আগে আমাকে আদর করে ভাত তুলে খাওয়াতো। কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেও আমাকে কোলে নিতেন, খাইয়ে দিতেন। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। তার আদর ও ভালোবাসার কথা সবসময় মনে পড়ে।’

জেরিন রানা প্লাজা ধসে নিহত গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের দামোদরপুর গ্রামের লিপি বেগমের একমাত্র সন্তান। লিপি বেগম ওই গ্রামের জিয়াউর রহমানের স্ত্রী।

জেরিনের বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘অভাবের কারণে লিপি চাকরি করে নিজের সংসার সাজাতে চেয়েছিল। তার স্বপ্ন ছিল আমাদের একমাত্র মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবে। এই তাড়নায় গ্রামের আর ১০ জনের সঙ্গে লিপিও ঢাকায় গেল। চাকরি নিল রানা প্লাজার তৃতীয় তলার একটি গার্মেন্টে। কিন্তু চাকরির কিছু দিন না যেতেই ভবন ধসে মারা গেল লিপি। আমরা লিপির লাশ পেলাম ১৭ দিন পর। লাশ এনে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।’

তিনি আরও জানান, ‘স্ত্রী মারা যাওয়ার সময় জেরিনের বয়স মাত্র দেড় বছর ছিল। তখন থেকেই জেরিন দাদির কাছে বড় হচ্ছে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই দফায় প্রায় ৪ লাখ টাকা পেয়েছেন। ক্ষতিপূরণের টাকায় সামান্য জমি আর একটি মাইক্রোবাস কিনেছেন। মাইক্রোবাসের ভাড়ায় তাদের সংসার চলে। মেয়েকে ভর্তি করেছেন স্থানীয় কান্তনগর প্রি-ক্যাডেট স্কুলে নার্সারিতে। কষ্ট হলেও মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে চান তিনি।’

একই ইউনিয়নের দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামের সোনিয়া বেগম। বিয়ের দু’বছর পর বেকার স্বামীকে নিয়ে রানা প্লাজার একটি কারখানায় কাজ শুরু করেন। চাকরির ২২ দিনের মাথায় ভবন ধসের ঘটনায় চাপা পড়েন সোনিয়া। তিন দিন পর উদ্ধার হলেও সোনিয়ার ডান পা কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়।

সোনিয়া বেগম বলেন, ‘এখনো সেদিনের কথা মনে পড়লে ভয়ে আঁতকে উঠি। ভবন ধসের পর ২২ দিন হাসপাতালে ছিলাম। ক্ষতিপূরণ যা পেয়েছি তা দিয়ে বাড়ি ও ছোট একটি দোকান করেছি। পাঁচ বছর ধরে এক পা আর ক্রাচের ওপর ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছি। সামান্য আয়ে কোনও রকমে সংসার চলছে। এখনও অনেক শারীরিক সমস্যায় ভুগছি।’

সোনিয়ার স্বামী মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাড়িতে ছোট আকারে একটি মনিহারি দোকান দিয়েছি। দুজনে মিলেই তা দেখাশোনা করি। দেড় বছরের সন্তান মিম আর বাবা-মাকে নিয়ে আমাদের সংসার। ক্ষতিপূরণের টাকায় কোনও রকমে সংসার চলছে। তবে চেষ্টা করেও সংসারে সচ্ছলতা আনতে পারছি না। সরকার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো চাকরি পাইনি। চাকরি আর পুনরায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।’

শুধু লিপি বেগম আর সোনিয়াই নয়, এই ইউনিয়নের অনেকে কাজ করতেন রানা প্লাজায়। তাদের মধ্যে স্মৃতি, রেবা, সবুজ, মোকছেদ, ইউনুস আলী ও সুমিসহ ১১ জন লাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন। রানা প্লাজা ভবন ধসে সরকারি হিসাবে গাইবান্ধা জেলার নারীসহ অর্ধশতাধিক নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এছাড়া আজও নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ১৫ জন। তবে এসব নিহত, আহত ও নিখোঁজদের অধিকাংশের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলায়।

সরেজমিন দামোদরপুর ইউনিয়নে গিয়ে কয়েকজন নিহত ও আহত শ্রমিকদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভালো নেই তাদের পরিবার। দুর্ঘটনা শুধু আপনজনদেরই কেড়ে নেয়নি, নিয়ে গেছে পরিবারগুলোর সব স্বপ্ন ও আনন্দ উল্লাস। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাদের তাড়া করে ফেরে। ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ অনেকের লাশের সন্ধান না পাওয়ায় স্বজনদের আহাজারি এখনো থামেনি। তাদের অনেকেই পায়নি কোনও ক্ষতিপূরণ।

দক্ষিণ ভাঙামোড় গ্রামের বীথি রোজগারের আশায় বড় বোনের সঙ্গে চাকরি নেয় রানা প্লাজায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে বড় বোন। নিখোঁজ বীথির লাশ আজও খুঁজে পায়নি পরিবার। সন্তান হারানোর শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি তার পরিবার। বীথির বাবা-মা কোনও অর্থ সাহায্য পাননি।

দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও গাইবান্ধা জেলা পরিষদের সদস্য মনোয়ারুল হাসান জিম মণ্ডল বলেন, ‘ভবন ধসের পরপরই নিহত ও আহতদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়েছিল। সহযোগিতার অর্থ দিয়ে কোনও পরিবারই আজও ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারেননি। অনেকে নানা কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাছাড়া দামোদরপুর ইউনিয়নের নিখোঁজ অনেকের লাশ পায়নি পরিবার। এমনকি তাদের দেওয়া হয়নি কোন সাহায্যও। খোঁজ-খবর নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের তালিকা তৈরি করে সহযোগিতার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার দাবি জানাই।

জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ পাল বলেন, ‘হতাহত পরিবারগুলোকে তালিকার মাধ্যমে সহযোগিতা করা হয়েছে। তাছাড়া এসব পরিবারকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করে আসছেন জনপ্রতিনিধিরা। তবে সামনে কোনও সুযোগ সৃষ্টি হলে অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করা হবে।

(এসআইআর/এসপি/এপ্রিল ২৪, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test