E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নড়াইলে ভুয়া এতিমখানার ছড়াছড়ি

এতিমখানায় এতিম নেই, সরকারি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সুপার ও সমাজসেবার কর্মকর্তারা!

২০১৮ মে ০৯ ১৬:২৯:০৩
এতিমখানায় এতিম নেই, সরকারি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সুপার ও সমাজসেবার কর্মকর্তারা!

রূপক মুখার্জি, নড়াইল প্রতিনিধি : এতিমখানা খুলে সমাজসেবার বদলে এতিমদের বাসস্থান ও খাবারের নামে বছরের পর বছর ধরে নড়াইলে এতিমদের টাকা লুট করে খাচ্ছে এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র। সমাজসেবা অফিসের সাথে যোগসাজসে ভূয়া এতিমখানা ও মাদ্রাসা খুলে নিয়মিত টাকা তুলে নিজের পকেটে ভরছেন তারা। সম্প্রতি নড়াইলের প্রত্যন্ত অঞ্চল সহ কয়েকটি এলাকায় বেশ কয়েকটি এতিমখানা ঘুরে ভূয়া এতিমখানার সত্যতা পাওয়া গেছে। আপন চার ভাইয়ের ৪টি এতিমখানা খুলে বছরের পর বছর সরকারী ক্যাপিটেশন গ্রান্ড এর কোটি টাকা আত্মসাৎ করার মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটলেও তা সবার অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। আর এ সবই ঘটছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।

নড়াইলে কালিয়া উপজেলার পাঁচগ্রাম ইউনিয়নের যাদবপুর গ্রামে খেয়াঘাটের পাশে ‘যাদবপুর মাজেদিয়া এতিমখানা’। এতিমখানার খোঁজ নিতেই স্থানীয় বাবু মোল্যা নামে এক যুবক জানালেন, এখানে কোন এতিম থাকেনা,নামেই এতিমখানা। কথা বলতে বলতেই হাজির এতিমখানার মালিক কাম সুপার এস. এম. জাকারিয়া। যিনি এলাকায় মাওলানা জাকারিয়া নামেই অধিক পরিচিত,যদিও তিনি নিজের নাম এম.এম. জাকারিয়া বলে জানান। যুবকের কথা কেড়ে নিয়েই তিনি তার এতিমখানার ফিরিস্তি দিতে শুরু করলেন।

জেলা পরিষদ নির্মিত টিনশেড এতিমখানা ভবনের ভিতরে গিয়ে দেখা গেল, একজন খতিবের থাকার জায়গায় একটি খাটে বিছানা পাতা, আর ৩/৪টি বিছানার বান্ডিল রাখা আছে একটা তাকে। একটু পরে ৩ জন শিশুকে জোগাড় করে আনা হলো। বাকি এতিমদের কথা জিজ্ঞেস করলে জাকারিয়া বললেন,এদিক ওদিক আছে’। এতিমখানার পাশেই জাকারিয়া সাহেবের বাড়ি,কিন্ত তিনি থাকেন আরেকটি কক্ষে। অগোছালো অন্ধকার কক্ষটি ঘুরে এলোমেলো কিছু কাগজগত্রের সাথে বিভিন্ন দোকানের বান্ডিল করা গোটা দশেক ভাউচার এর বাধাই করা বই পাওয়া গেলো,কোনটি কাঠগোলা আবার কোনটি মুদি দোকানের আবারকোনটি টেলার্স এর। বোঝা গেলো এগুলো দিয়ে তিনি এতিমদের খাওয়ার বিল তৈরী করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ১৯৯১ সালে সমাজসেবার নিবন্ধনকৃত এই এতিমখানাটি ৪০জন এতিমের সরকারী অনুদান পায়। ২৭ বছর ধরে চলা এই এতিমখানায় ৩জন এতিম শিশুকে আনাগোনা করতে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে এরা এতিম নয়। সাজানো ৩ জন এতিমের একজন একই গ্রামের আলমগীর হোসেনের ১২ বছরের ছেলে শামীম, বাবা ঢাকাতে রিক্সাচালায়, মা বাড়িতে থাকে। আরেকজন ১১ বছরের ওমর ফারুক এর বাবা মা দুজনই বেনাপোলে কাপড়ের ব্যবসা করে। পাশের চানপুর গ্রামের ফসিয়ার শেখের ছেলে ১১ বছরের আবিদ। তার বাবা মা প্রত্যেকেই জীবিত। খোজ নিয়ে জানা গেলো, এরা প্রত্যেকেই পাশের যাদবপুর মাদ্রাসার ছাত্র।

রুমের ভিতরে একটি হাড়িতে ২ জনের খাবার থাকলেও মাদ্রাসা সুপার জাকারিয়া ছেলেপেলে হাটে আছে,এদিক ওদিক আছে বলে ৪০ এতিম থাকার কথা বিশ্বাস করাতে চাইলেন।

এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করা সময়ে নিজেকে নড়াইলের একজন মুক্তিযোদ্ধা সাজানোর চেষ্টা জাকারিয়ার বলেন‘ এম এন এ খন্দকার হাফিজ, লেপ্টনেন্ট মতিয়ার এরা আমার আত্মীয়, এদের সাথে আমি নড়াইলে যুদ্ধের পতাকা উড়িয়েছি। একটু পরে কবরের দোহাই দিয়ে নিজেকে সত্যি প্রমানের চেষ্টা।

একসময়ে জাকারিয়া স্বীকার করলেন কম এতিম থাকার কথা, এই অবস্থায় আপনারা সরকারী অনুদান পান কিভাবে? এমন প্রশ্নে জাকারিয়ার জবাব “আমরা যতবার টাকা পাই সমাজসেবা অডিট ভিজিট করেই আমাদের টাকা দেয়। আর নানা অজুহাতে সমাজসেবার কর্মকর্তারা অর্ধেক টাকা কেটে রেখে বাকি টাকা দেয়। সমাজসেবার আগের উপজেলা অফিসার যিনি পরে উপ-পরিচালকের দ্বায়িত্বে ছিলেন, সেই অসিত বাবু (অসিত কুমার সাহা ) বিল দেবার সময় নানা খরচের কথা বলে আধাআধি টাকা নিয়ে গেছে, আমাদের শেষ করে দিয়ে গেছে।

জাকারিয়ার এতিমখানার একঘর পরেই ‘যাদবপুর ওয়াজেদিয়া বালিকা এতিমখানা’। এটি পরিচালনা করেন জাকারিয়ার চাচাতো ভাই মাওলানা গোলাম কুদ্দস। সেখানে গিয়ে কোন এতিমখানার সন্ধান পাওয়া গেলো না। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে গোলাম কদ্দুস ও তার স্ত্রী তড়িঘড়ি করে গোয়ালঘর থেকে একটি সাইনবোর্ড বের করে তা গোয়ালঘরেই ঝুলিয়ে দেন। ২০০৩ সালে নিবন্ধন পাওয়া এই এতিমখানায় সরকারী ভাবে ১৭ জন এতিম বালিকা থাকার কথা থাকলেও এতিম দুরে থাক এতিমখানারই কোন অস্থিত্বই পাওয়া গেল না। নিজের ঘর দেখিয়ে সেটিকে এতিমখানা সাজানোর চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু কাউকে পাওয়া গেল না। এতকিছুর পরেও মাওলানা কুদ্দুসের দাবী তিনি ১৭ জন এতিম লালন-পালন করছেন।

তিনিও বলেন, এতিম প্রতি মাসিক এক হাজার টাকা করে দেয় এতে এমনিই চলে না,তার উপর সমাজসেবার অফিসের একটা খরচ,এজি অফিসের খরচসহ নানা ধরনের খরচ দিয়ে আসতে হয়। যাদবপুর বাজারের চা দোকানদার হাদিউজ্জামান বলেন,সকালে বিকালে কিছু ছেলে-মেয়ে এখানে আরবী পড়ালেখা করতে আসে, তবে এখানে কোন এতিম থাকে বলে মনে হয় না।

ইউনিয়নের অপর প্রান্তে মহিষখোলা গ্রাম। এখানে ‘মহিষখোলা হামিদাতুন্নেছা এতিমখানা’ পরিচালনা করেন জাকারিয়ার আপন ছোটভাই আব্দুল শহিদ। মাটির রাস্তা পেরিয়ে এতিমখানায় পৌঁছানোর সময় দেখা গেলো, শিশুরা এতিমখানার দিকে ছুটছে। সাংবাদিক আসছে এই খবর পেয়ে এলাকার ১৫/২০ জন শিশুকে এতিমখানায় পাঠিয়ে আরবী পড়তে বসিয়ে দেন শহিদ। ইটের গাঁথুনি জানালা-দরজা বিহীন মাদ্রাসার চারিদিকে খোলা, একটি মাত্র খাটে এলোমেলো বিছানা। এতিম কেন কোন মানুষই এখানে থাকার পরিবেশ নেই। বড় ভাইয়ের এতিমখানায় সাংবাদিক এসেছে শুনেই তিনি নিজের এতিমখানা ঠিক করতে লেগে পড়েছেন, সামনে পড়তেই ঘামছেন আর কাপছেন। রান্নাঘর বলে যেটাকে দেখানো হলো সেথানে একটি ছোট হাড়ি বসানো। একজন মহিলাকে বাবুর্চি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলেও এখানে কোন রান্না হয় না বলে ঐ বাবুর্চি জানান। এলাকার কয়েকজন শিশুকে এতিম সাজিয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা ঐ সুপারের। সাজানো এতিমের একজন তৌহিদ পাশের একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র। আরেকজন জালাল মোল্যার মেয়ে খাদিজা, সে সকালে এখানে আরবী পড়ার জন্য আসে আবার বাড়ি চলে যায়। ১২ জন এতিমের জন্য মাসিক অনুদান পেলেও এই এতিখানায় একজনও থাকে না। সাজানো এতিম শিশুরা প্রথমে শহিদের ভয়ে মিথ্যা বললেও পরে নিজদের বাড়িতে গিয়ে সত্যি কথা বলেছে। নানা প্রশ্নের পরে এতিমখানা হিসেবে উপস্থাপন করতে না পেরে অবশেষে এতিমখানার পরিচালক মো.শহীদ স্বীকার করলেন এতিম না থাকার কথা। রাস্তাঘাট ঠিক নাই,ঘরের পরিবেশ করা যাচ্ছে না,এমন সব অযুহাত দাড় করালেন এই কথিত সমাজসেবক।

তিনি বলেন,এতিমের জন্য জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ এক হাজার টাকা করে ৬য় মাসে বরাদ্দ দেয় সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ। তা দিয়ে ঠিকমতো চালানো যায় না। সমাজ সেবা অফিসাররা আমাদের নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা কেটে নিয়ে যায়। এভাবে টাকা কেটে নেবার ফলে আমরা এতিমখানা চালাতে পারি না। নদীর ওপারে ‘কুলশুর মাজেদিয়া বালিকা এতিমখানা’সেটার সপুার জাকারিয়ার সেজ ভাই আয়ুব আলী। সেখানেও কোন এতিম থাকে না। নামমাত্র একটি ঘর থাকলেও কোন সাইনবোর্ড কিম্বা এতিমখানার পরিচালক আয়ুব আলীকে খুজে পাওয়া গেলো না।

এতিমখানার ব্যাপারে এলাকাবাসী মুখ খুললেও কেউ বাধা দেয় না। পাঁচগ্রাম ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড মেম্বর লাহুদ্দিন গাজী, মনা মেম্বর, জামান মেম্বর, রাজা শেখ,হাসান মোল্যা জানান, এখানে কোন এতিম কখনোই থাকতে দেখিনি, কেউ এতিমখানা পরিদর্শনে এলে বাচ্চাদের চকলেট দিয়ে ঘরে নিয়ে আরবী পড়ায়। ওখানে গরু আর ওদের মালামাল রাখে, ১০/১২ বছরের মধ্যে কখনোই কোন এতিম থাকতে দেখিনি।

নড়াইল পৌর এলাকার বরাশুলা গ্রামে ১৯৭৬ সালে গড়ে ওঠা জেলার সর্ববৃহৎ পুরাতন এতিমখানা ‘বরাশুলা এতিমখানা কমপ্লেক্স’। কয়েকটি ভবন এবং বেশ বড় জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এই এতিমখানার বেশ সুনামও রয়েছে। সর্বশেষ জুলাই-ডিসেম্বর এই সময়ে এই ১৭২ জন এতিমের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে ১০ লক্ষ বত্রিশ হাজার টাকা। নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দের দ্বিগুন এতিম থাকার কথা থাকলেও এখানে সাকুল্যে এতিম থাকে ৭০জন। এ ব্যাপারে এতিমখানার ছাত্ররা শেখানো কথা বললেও আসল তথ্য বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। সেখানকার একজন নারী পাচক জানান, যখন সব ছাত্ররা একসাথে থাকে তখনো এখানে ছাত্র আর কর্মকর্তা মিলে সাকুল্যে ৯০/৯৫ জনের রান্না হয়।

বরাশুলা এতিমখানা কমপ্লেক্স এর পরিচালক মোঃ ইউসুফ আলীর সাথে কথা বললে তিনি প্রথমে ১৭৫ জন থাকার কথা বললেও পরে নানা অজুহাত দেখিয়ে ১’শ জন থাকার কথা স্বীকার করেন। জেলা বেসরকারি এতিমখানা সমিতির সাধারন সম্পাদকও তিনি। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো কম এতিম রাখেন কেন? উত্তরে তিনি জানান,সরকারীভাবে জনপ্রতি মাত্র একহাজার টাকা দেয় খাবার ও অন্য কাজের জন্য, এতে করে এতিমদের চলে না তাই কম এতিম রেখে অন্যদের চালানো হয়। সমাজসেবার দুর্নীতির কথা স্বীকার করে তিনি এতিমশূন্য এতিমখানার জন্য নিজেদের লজ্জিত বোধ করেন।

জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সমাজসেবার তত্ত্বাবধানে ৩ উপজেলার মোট এতিমখানার সংখ্যা ৪৬ টি। ছোট বড় মিলিয়ে এসব এতিমখানায় মোট ১হাজার ২’শ ৭২ জন এতিম রয়েছে। জন প্রতি মাসিক বরাদ্দ একহাজার টাকা হিসেবে এসব এতিমখানায় মাসে মোট বরাদ্দ দেয়া হয় ১২ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। বাৎসরিক দেড় কোটি টাকা। ক্যাপিটেশন গ্রান্ড পাবার শর্ত অনুযায়ী প্রত্যেকটি এতিমখানা নিজস্ব পরিচালনায় যে কয়েকজন এতিম পালন করেন তার দ্বিগুন এতিম থাকলেই কেবল অনুদান পাবার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জেলার প্রত্যেকটি অনুদান প্রাপ্ত এতিমখানাতেই সঠিক সংখ্যক এতিম না থাকলেও তারা বছরের পর বছর ধরে এতিমদের নামে টাকা তুলে নিজেদের এবং সমাজ সেবার কর্মকর্তাদের পকেট ভরাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন আলেম বলেন, ভুয়া এতিমখানা টিকিয়ে রেখে মুলত সমাজসেবার অফিসাররা তাদের পকেট ভরছেন, যারা এতিমদের টাকা তুলে খাচ্ছেন তারা চরম গোনার কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। সকল ভূয়া এতিখানা বন্ধের তাগিদ এইসব আলেমদের।

সমাজসেবা কর্মকর্তাদের দুনীর্তি এবং ভূয়া এতিমখানা বিষয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয় এর উপ-পরিচালক রতন কুমার হালদার বলেন, অনুদানপ্রাপ্ত এতিমখানা নিয়ে আমরা কিছুটা বিব্রত আছি। আগের উপ-পরিচালনক অসিত বাবুর কথা আমি বলতে পারবো না। তবে আমি একটি ভুয়া এতিমখানা বন্ধ করে অনেক চাপে ছিলাম। এতিম নেই এমন কোন অভিযোগ আমার কাছে আসেনি,আসলে আমরা তাদের বরাদ্দ বাতিলের সুপারিশ করবো। আমরা অনেকসময় সংশোধনের সুযোগ দেই। বর্তমান সময়ে কোন অনিয়ম হচ্ছে না বলে দাবি এই কর্মকর্তার।

নড়াইল জেলা প্রশাসক মোঃ এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ক্যাপিটেশন গ্রান্ড পাওয়া এতিমখানায় সঠিক পরিমান এতিম না থাকা বড় ধরনের অন্যায়। সমাজ সেবাই এটি পরিদর্শন করে। তবে এ ধরনের ঘটনা সত্য হলে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিব।

(আরএম/এসপি/মে ০৯, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test