E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্টোরে নষ্ট হচ্ছে সাপের কামড়ের ইনজেকশন

নড়াইল হাসপাতালে মারা যাচ্ছে একের পর এক রোগী, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার 

২০১৮ জুন ০৪ ১৬:১১:০৭
নড়াইল হাসপাতালে মারা যাচ্ছে একের পর এক রোগী, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার 

রূপক মুখার্জি : গত ৫ বছরে নড়াইল জেলায় সাপে কামড়ে মারা গেছে অন্ততঃ শ’খানেক রোগী। যার মধ্যে অন্ততঃ ৫০ জন সদর হাসপাতালে এসে চিকিৎসা না পেয়ে  মারা গেছে। সর্বশেষ ১ জুন রাতে সাপে কেটে মেরে ফেলে দুইজন কে। সদর হাসপাতালে  আসার পর চিকিৎসা না পেয়ে এদের মৃত্যু হয়। এদের একজন কালিয়া উপজেলার কালডাঙ্গা গ্রামের ওহিদুল মোল্যার ছেলে ১৩ বছরের শিশু সামিউল। অপরজন লোহাগড়া উপজেলার নলদী ইউনিয়নের নালিয়া গ্রামের বিশ্বজিত দে’র ছেলে শান্ত দে (৩৫)। 

১ জুন সন্ধ্যা ৭টার দিকে সাপে কাটার পরে সদর হাসপাতালে ভর্তি হন শান্তু দে। এর কিছুক্ষন পরেই তিনি মারা যান। সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসা নিতে আসেন সামিউল,তাকে ভর্তিও করা হয়। হাসপাতালে এসে চিকিৎসকের কাছে এন্টিভেনাম নাই এই কথা শুনে এবং অপর রোগীর মৃত্যুর কথা জানতে পেরে তারা হাসপাতাল ত্যাগ করে।

সামিউলের পরিবার জানায়, সন্ধ্যার দিকে স্থানীয় মাঠে খেলতে গিয়ে সাপে কাটে সামিউলকে। এর পরপরই ভ্যানে করে তাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে আনা হলে জরুরী বিভাগে কোন চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। এসময় চিকিৎসকের সহকারী মহিলার কাছ থেকে তারা জানতে পারেন যে,এই হাসপাতালে সাপেকাটা ইনজেকশন নাই। অন্য একজন সাপেকাটা রোগীর মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। ধোপাখোলা মোড়ে এসে ওঝার সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে ৩ জন ওঝা মিলে আধাঘন্টা চিকিৎসার পরে মারা যায় সামিউল।

এই দুইজন রোগী মৃত্যূর ক্ষেত্রে সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে সাপের কামড়ের এন্টিভেনাম না থাকার অযুহাত দিলেও নড়াইল সদর হাসপাতালে গত ৫ বছরে মেয়াদ উত্তীর্ন হয়ে স্টোরে নষ্ট হয়েছে ৮’শ এন্টিভেনাম। অনুসন্ধানের পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসলেও দায় নেয়নি কেউ। চিকিৎসকদের দুই ধরনের বক্তব্যে সদর হাসাপাতালের এই বিষয়ের চিকিৎসায় আরো হতাশ হয়ে পড়ছেন স্থানীয়রা।

২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৫ বছরে সাপেকাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে সরবরাহকৃত ৮’শ ঔষধ নড়াইল সদর হাসপাতালের স্টোরে থেকে নষ্ট হয়েছে। পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ থাকলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে গত ৫/৬ বছরে একটিও সাপেকাটা রোগীর চিকিৎসা হয়নি।

সদর হাপাতালের স্টোরে থাকা সরকারিভাবে সরবরাহকৃত এন্টি স্নেক ভিনম ( Anti Snake Venom) নামের ঔষধের চিত্র। যার সবই ২০১৭ সালের অক্টোবরে মেয়াদ উত্তীর্ন হয়ে গেছে।

তারিখ বিবরণ জমা/খরচ সর্বশেষ অবস্থা

২৩.০৯.১৩ পূর্বের জমা ৩০০ ইনজেকশন
২১.০৪.১৪ ওয়ার্ডে দেয়া খরচ- ২০টি ইনজেকশন ২৮০ ইনজেকশন
১৩.০৭.১৫ নতুনভাবে প্রাপ্ত জমা- ৪০০ ইনজেকশন ৬৮০ ইনজেকশন
০৫.০৬.১৬ নতুনভাবে প্রাপ্ত ১০০ ইনজেকশন ৭৮০ ইনজেকশন
০৯.১১.১৬ বাজেয়াপ্ত করা হয় ৪৬০ ইনজেকশন ৩২০ইনজেকশন

সদর হাসপাতালের স্টোর কিপার গোলাম রহমান বলেন, সদর হাসপাতালে সাপে কাটা রোগী আসে না, আমিতো ওয়ার্ডে ইনজেকশন দিয়েই রাখি কিন্তু নার্সরা বলে যে,ডাক্তাররা ভয়ে সাপেকাটা রোগীদের চিকিৎসা করতে চান না।

সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর খুজে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৫ জুন সদর হাসপাতালে পাঠানো ১’শ ঔষধ পাঠানো হয়। ৪ বছর মেয়াদী এই ঔষধ যখন হাসপাতালে পাঠানো হয় তখন তার মেয়াদ ছিলো মাত্র এক বছর।

এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন অফিসের সহকারী স্টোর কিপার শরীফ নাজমুল হাসান জানান,আমাদের কাছে ঔষধ আসলে তা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। মেয়াদের ব্যাপারটা আমরা জানি না।

২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় মিঠাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাগডাঙ্গা গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের। রাত ১০ টার দিকে বাড়ির পাশের খড়ের পালা থেকে একটি বিষধর সাপ দংশন করে। স্থানীয় ওঝা আর বৈদ্যের চিকিৎসার পরে শেষ আশ্রয় হিসেবে তাকে সদর হাসপাতালে আনা হলেও সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়নি। খুলনা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়, সেখানে নেবার পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাজ্জাকের বোন আসমোত আরা বলেন, নড়াইল সদর হাসপাতালে সাপে কামড়ানো ইনজেকশন নাই, আমরা বললাম বাইরে থেকে কিনে এনে দিই কিন্তু ডাক্তার আমাদের কথা না শুনেই তাড়িয়ে দেন। ডাক্তার আন্তরিক হলে আমার ভাইয়ের এভাবে মরতে হতো না।

মৃত রাজ্জাকের মেয়ে সাথী খন্দকার বলেন, সদর হাসপাতালে ঐদিন চিকিৎসা হলে আমার বাবাকে এভাবে হারাতে হতো না। নড়াইল হাসপাতালে যদি ঔষুধ না পাওয়া যায় তাহলে কোথায় আমরা চিকিৎসা পাবো। খুলনা -যশোর এগুলো অনেক দুরের পথ,তাহলে আর হাসপাতাল আমাদের কি সেবা দিতে পারছে।

একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে নড়াইল সদর উপজেলার বলরামপুর গ্রামের তাইজুল ইসলামের মেয়ে ৩য় শ্রেনীর নূসরাত খানমের। বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় ভোর রাতের দিকে বিষধর সাপে তাকে দংশন করে। পরিবারের লোকেরা নূসরাতকে স্থানীয় কবিরাজের (ওঝা) কাছে নিয়ে যান। এরপর নড়াইল সদর হাসপাতালে নিয়ে এলেও কোন চিকিসা পায়নি। পরে সে মারা যায়।

আগষ্ট মাসে নড়াইল পৌর এলাকার আলাদাতপুর গ্রামের পান্না মিয়ার ছেলে শিশু নূর মোহাম্মদ (১৪) এর সাপে কেটে মৃত্যু হয় । পরিবারের লোকজন প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। বাড়িতে নিয়ে গেলে পুনরায় শিশুটি নড়েচড়ে ওঠলে গোবরা এলাকায় এক ওঝার কাছে নিয়ে যায়। কিছুক্ষন ঝাড়ফুক করার পর তার মৃত্যু হয় ।

নড়াইল জেলা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মিলন খান বলেন, চিকিৎসার ঔষধ আছে অথচ চিকিৎসকদের নানা অযুহাতে সাপে কাটা রোগীরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, এই মৃত্যুর দায় কাদের। যাদের অবহেলায় গুরুত্বপূর্ন দামী এসব জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ষ্টোরে নষ্ট হলো তাদের শাস্তি দাবী করছি।

নড়াইল সদর হাসপাতালে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কমিটির সদস্য সাংবাদিক এনামুল কবীর টুকু বলেন, এতদির ধরে হাসপাতালের সাপে কাটা ইনজেকশন নিয়ে নানা ধরনের টালবাহানা চলছে, অথচ আজো পর্যন্ত এর কোন সুরাহা হোল না। কার দোষে যে চিকিৎসার এই হাল তাতো বুঝতে পারছি না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালে সাপেকাটা রোগীদের ইনজেকশন আছে কি নেই এটা একমাত্র আর এম ও স্যারের জানার কথা, আমরা অন্য চিকিৎসকরা এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা। তাই রোগীকে বিষধর সাপে কাটার লক্ষন দেখেই খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরন করি।

নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা.মশিউর রহমান বাবু জানান, সাপে কাটা রোগের ইনজেকশন না থাকার কারনে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। সরবরাহ থাকলে আমরা চিকিৎসা দিতে পারবো। যদিও এই চিকিৎসা কিছুটা ঝুকিপূর্ন, সাইড ইফেক্ট আছে অনেক সময় রোগীর স্বজনেরা এটা মানতে চায় না। সকল স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোতে এন্টিভেনাম সরবরাহ এবং ডাক্তার ও নার্সদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষন জরুরী।

সদর হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক ডাঃ জসিমউদ্দিন হাওলাদার বলেন, আমি গত মার্চ মাসে যোগদান করেছি, আমার জানা নেই যে স্টোরে এর আগে এন্টিভেনাম নষ্ট হয়েছে কি না। তবে আর এম ও সহ আমাকে কয়েকজন সিনিয়র চিকিৎসক বলেছেন তারা সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা দিতে পারবেন। আমি সাপেকাটা ঔষধের চাহিদাপত্র দেবো।

নড়াইলের সিভিল সার্জন ডা.আসাদ-উজ-জামান মুন্সী জানান, সিভিল সার্জন অফিসে সাপে কাটা ইনজেকশন “এন্টিভেনাম” আছে। তবে, সদর হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার অভিজ্ঞতা না থাকায় হাসপাতালে এন্টিভেনাম সরবরাহ করা হয়নি। হাসপাতাল চাহিদা দিলেই ঔষধ সরবরাহ করা হবে।

নড়াইলের জেলা প্রশাসক মো.এমদাদুল হক চৌধুরী জানান, সিভিল সার্জন অফিস ও সদর হাসপাতালে সাপে কাটা ঔষধ নিয়মিত থাকার ব্যাপারে আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। ডাক্তারদের চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষনের জন্য ব্যবস্থা করা হলে আশা করি দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে।

আটলক্ষ মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতাল। বিল প্রধান এলাকায় প্রতিবছরই বর্ষা এবং গরমের সময় সাপে কেটে অসংখ্য রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সাপে কাটা কোন রোগী আসলে তাকে ভর্তি না করে খুলনা বা যশোরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আর সময় ক্ষেপনে বাইরের হাসপাতালে নেবার আগেই রোগী মারা যায়। স্থানীয়দের ক্ষোভ থাকলে ও চিকিৎসকদের গাফিলতির কারনে রোগী মারা গেলে আধুনিক সদর হাসপাতালের কোন দায় থাকে না। আতঙ্কিত রোগীরা গ্রাম্য ওঝা ও ঝাড়ফুকের উপরই ভরসা করে ই মরতে হচ্ছে।

(আরএম/এসপি/জুন ০৪, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test