E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রশাসনই পারে নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে

২০১৮ জুন ২৫ ১২:৫০:২৭
প্রশাসনই পারে নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : কেবলমাত্র প্রশাসনই পারে নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে। প্রশাসন এ ব্যাপারে তৎপর না হলে সাতক্ষীরায় উগ্র মৌলবাদ যেভাবে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছে তাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ ব্যতীত কোন উপায় থাকবে না। তবে সংখ্যালঘুদের সার্বিক স্বার্থে একতাবদ্ধ হওয়ার কোন বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য গোষ্ঠ বিহারী মণ্ডল জানান, ’৭১ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে বেশ কয়েকবার। তবে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করার পর দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন অনেক কম ছিল। একইভাবে জাতীয়তাবাদি দল বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় এলেও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন অনেক কম হয়েছে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসার পরও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নেহাৎ কম হয়নি। তবে বিএনপি- জামায়াত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। বর্তমানে সে নির্যাতনের মাত্রা চার দলীয় জোট সরকারের সময়ের চেয়ে কম নয়। সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলকে ভোট দেওয়ায় নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া আর উপায় নেই।

গোষ্ঠ বিহারী মণ্ডল বলেন, বিএনপি, জামায়াত অথবা তাদের সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক আর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হোক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের কাছে ভোট চায় না বললেই চলে। সংখ্যালঘুরা যেন জন্ম থেকেই আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এমনটি বদ্ধমূল ধারণা থাকায় তারা স্বাভাবিক ভাবে মেনেই নেয় যে এখানে ভোট চেয়ে লাভ নেই। সেক্ষেত্রে ভোটের আগে সংখ্যালঘুরা যাতে কেন্দ্রে যেতে না পারে সেজন্য নানা হুমকি ধামকি চলে। ভোটে জেতার পর জমি দখল, মিথ্যা মামলায় জড়ানো, মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন হুমকি ধামকি দেওয়া হয়।

এ ছাড়া পুকুরে বিষ দিয়ে মাছ নিধন, ফসল কেটে নেওয়া, জমির সীমানার গাছ কেটে নেওয়া, গরু ও ছাগল চুরি করে বড় ধরনের বিপদ ঘটানোর হুমকি দেওয়া হয়। মন্দির ভাঙচুর, প্রতিমা ভাঙচুর,শ্মশানের জায়গা দখলসহ জাল দলিলের মাধ্যমে বাড়ি ও জমি দখলের হুমকি দেওয়া হয়। যা পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করা হয়। এ সব নির্যাতনে শুধুমাত্র সংখ্যাগুরু নয়, সংখ্যালঘুদের প্রতিপক্ষদের কাজে লাগিয়ে ফায়দা লোটা হয়। সময় ও ক্ষমতা ভেদে বিএনপি , জামায়াত, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির নেতা কর্মীরা জড়িত থাকে। তবে ওয়ান ইলাভেনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা জেল খেটেছেন। তাতে দু’ একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন থাকলেও তা নিয়ে বেশি কথা হয়নি।

সাতক্ষীরা সিটি কলেজের শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাশ জানান, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে জেলায় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি কৌশলে রাজনৈতিক দল পরিবর্তণ করে ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ করে তাদের ফয়দা হাসিল করে যাচ্ছে।

এ ছাড়া একই পরিবারে কেই জামায়াত, কেউ বিএনপি, কেউ আওয়ামী লীগ কর্মী নেতা কর্মী হওয়ায় রাজনৈতিক পালাবদলে তাদের কোন সমস্যা হয় না। তারা যে কোন প্রকারে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের মাত্রা ও পরিকল্পনা অব্যহত রাখে। ক্ষেত্র বিশেষ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীদের মধ্যে কোন্দলকে ঘিরে বলির পাঠা হয় সংখ্যালঘুরা। এতে অত্যাচারের মাত্রা এতই বাড়তে থাকে যে ন্যয় বিচার বা প্রতিকার পাওয়ার কোন জায়গা থাকে না। এ ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সংখ্যালঘুরা আরো সমস্যায় পড়ে।

তিনি আরো বলেন, বিএনপি জামায়াতের সময় চাকুরি পাওয়া পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা গিরগিটির মত রঙ পাল্টে অতি আওয়ামী লীগার সেজে সংখ্যালঘুদের উপর কৌশলে নির্যাতন চালায়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পুলিশের একাংশের সহায়তায় সংখ্যালগুদের জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে যাচ্ছে। নব্য আওয়ামী লীগার সেজে দেবহাটার পারুলিয়ার তপন বিশ্বাসের গুদামঘর ও জমি জবরদখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এক সময়কার বিএনপি’র পৃষ্টপোষক, চোরাকারবারি, বাঘের চামড়া পাচারকারি নুর আমিন গাজীও তার সহযোগীরা। তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমান মিন্নুর, প্রিন্সসহ ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ। আশাশুনির খড়িয়াটি শ্মশানের জায়গা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে তা জবরদখল করানো হয়েছে এ সরকারের আমলে।

শ্যামনগরের নকীপুর শ্মশানের জায়গা দু’ মুসলিম পরিবারের কাছে ডিসিআর দেওয়া হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের বাঘ বিধবার মেয়ে পারুলকে গণধর্ষণের পর হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা। অসহায় পরিবারের পক্ষ থেকে বিচার চেয়েও লাভ হয়নি। দেবহাটার মাঘরী গ্রামে অশোক ঘোষের পৈতৃক জমি জবর দখলের চেষ্টা চালিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঝামেলা করে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হোসেন রতন ও তার সহযোগিরা। শ্যামনগরের ভুরুলিয়া গ্রামের দেবেন মণ্ডলের বড় ছেলের হত্যাকারিরা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সহযোগিতা নিয়ে নতুন করে বর্বোরচিত হামলা চালিয়ে একই পরিবারের তিনজনকে মৃত্যুমুখে পতিত করলেও তাদের বিচার হয়নি। এ ছাড়া আশাশুনির লাউতাড়ায় দু’ সংখ্যালঘু সম্পদায়ের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে রাজাকার মোজাহারের ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা শাহানেওয়াজ ডালিম শালিসি বৈঠকে শ্বশুর ও জামাতাকে যেভাবে পিটিয়ে জখম করেছে তার বিচার হয়নি।

দেবহাটার টিকেট গ্রামে প্রতিমা ভাঙচুর, আশাশুনির কচুয়া গ্রামে প্রতিমা ভাঙচুরের সাথে মন্দির কমিটির লোকজনকে পিটিয়ে জখম করার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা জড়িত থাকলেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।সাতক্ষীরা শহরের ঝুটিতলায় নামযজ্ঞ চলাকালে হামলা হলেও ওই সব আওয়ামী লীগ নেতাদের কিছুই হয়নি। ২০১২ সালে কালিগঞ্জের ফতেপুর ও চাকদাহে ১২টি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি ও সম্পদ পুড়িয়ে সর্বশান্ত করে দেওয়ার পিছনে যে সব আওয়ামী লীগ নেতা জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু পুলিশের মাধ্যমে গ্রেফতার বানিজ্য ও ছাড়া বানিজ্য করে অনেকেই আখের গুছিয়েছেন। শ্যামনগরের গোপালপুরে চলতি বছরে গীতাপাঠ অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে চারজনকে জখম করা হলে পুলিশ তিনজনকে জেলে পাঠালেও তারা এখন মামলা তুলে নিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে যাচ্ছে।

এ ছাড়া পাটকেলঘাটায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একটি মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করায় অলিক দাসকে পুলিশের সহযোগিতায় ২০০ গ্রাম গাজা দিয়ে মোবাইল কোর্টে সাজা দেওয়া হয়। এ সময় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট করা হয়েছে। এ ছাড়া জমি দখল, ঘের দখল, বাড়ি দখলসহ বিভিন্ন স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ লুটপাটের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সদর উপজেলার চুপড়িয়া গ্রামে অশোক দাসের স্ত্রীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করায় ওই পরিবারের দু’ নারী ও তাদের দু’সন্তানকে দরজার গ্রীলে তালা লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া কালিগঞ্জের চণ্ডিতলাসহ কয়েকটি স্থানে হিন্দু মেয়েদের অপহরণ করে ধর্মান্তরিত করার সঙ্গে ক্ষতাসীন দলের নেতাদের সংশ্লিষতা প্রমাণিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।

সাতক্ষীরার বিশিষ্ঠ জনেরা বলেন, এদেশের সংখ্যালঘুদের সম অধিকার নিশ্চিত না করতে পারলে তাদের উপর অত্যাচার কমবে না। সেজন্য আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। রাষ্ট্রই যদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে তাদেরকে দেশ ছাড়তে হবে। তবে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক কমিটমেণ্ট দরকার রয়েছে। সর্বোপরি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নিজের অধিকার অর্জন করতে একতার কোন বিকল্প নেই।

তারা বলেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় স্থানীয় সংখ্যাগুরুদের আগে ভুমিকা রাখতে হবে। তাদেরকে একই মায়ের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তবে যারা উগ্রমৌলবাদে বিশ্বাসী তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে পারে একমাত্র সরকার। এজন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে। সংখালঘুদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের সতর্কতা ঢিলে ঢালা হওয়ায় অনেকেই দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। আগামিতে এ সতর্কতা বাড়ানো না গেলে অচিরেই বাংলাদেশ সংখ্যালঘু বর্জিত দেশে পরিণত হবে।

(আরকে/এসপি/জুন ২৫, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test