E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তুষারের স্বপ্ন অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে জল

২০১৮ জুন ২৯ ০০:০০:৩৪
তুষারের স্বপ্ন অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে জল

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : লম্বা গড়ন, শ্যামা গায়ের বরণ, নম্র-ভদ্র ও হাস্যজ্জ্বল মুখের অধিকারী আজিজুল ইসলাম তুষার। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা অধ্যাপক ডা. গোপাল স্যারের ফিজিওলজি ক্লাসে। এরপর পরিচয় সেখান থেকে বন্ধুত্ব। এক সাথে ক্লাস করা, গ্রুপ স্ট্যাডি, ভিসেরা স্টাডি আর মাঝে মাঝে আড্ডাবাজি।

এভাবেই বলছিলেন,সিরাজগঞ্জ নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের ১৩ তম ব্যাচের ছাত্র ডা. মাহমুদুল হাসান নাঈম। নাঈম তাঁর বন্ধু তুষারের গল্পের গালিচা খুলে বললেন, সিরাজগঞ্জ শহরের স্থানীয় বাসিন্দা হলেও তুষারের মধ্যে কোন ঔদার্য্য ছিল না। বিপদে-আপদে সবার পাশে থাকত তুষার। কলেজের যেকোন অনুষ্ঠান বা খেলাধুলায় তুষার ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ও প্রাণবন্ত। ফুটবল ও ক্রিকেট ছিল তুষারের পছন্দের খেলা। মেডিকেলের কঠিন চাপযুক্ত জীবনে তুষার চাপমুক্ত থাকতে পছন্দ করত। সব কিছু উপভোগ করতে চেষ্টা করত।

দেখতে দেখতে কেটে গেছে মেডিকেল জীবনের ৩ বছর। এখন আমরা সবাই ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী। আর মাত্র ২ বছর পড়াশোনা করে এমবিবিএস পাশ করলেই ডাক্তার হতে পারবো। সবার মত তুষারও বড় ডাক্তার হবার স্বপ্ন বুনে ছিল। গ্রামের চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিল তুষারের। দিনটি ছিল রবিবার।

যেকোন কারণে ক্লাসে যাইনি। দুপুর ১টায় অধ্যাপক রফিক স্যারের কমমেড ক্লাস। বন্ধু আজিজুল ইসলাম তুষার সকাল থেকে সবগুলো ক্লাস করেছে। দিয়েছে প্যাথো-আইটেমও। কিন্তু কমমেড ক্লাস না করে তুষারসহ আমার আরো ৪
জন বন্ধু যমুনা নদীর পাড়ে মেডিকেল হোস্টেল মাঠে ফুটবল খেলতে যায়।

সেখান থেকে গোসলের জন্য যায় খরস্রোতা যমুনায়। সিনিয়ার-জুনিয়ার মিলে ২০-২২ জন যৌবনের উচ্ছাসে যমুনায় গা ভাসাচ্ছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় ৪/৫ জন ছাড়া বাকীরা কেউই সাতার জানত না। সাতার না জানার দলে ছিল তুষারও। তাই কোমড় পানিতে গোসল করছিল। পাশেই ছিল ড্রেজারে কাটা ৩০ ফিট গভীর মরণ ফাঁদ (খাদ)।

যেকোন ভাবে এই খাদে পা চলে যায় তুষারের। তুষারকে বাঁচাতে দুই বন্ধু এগিয়ে গেলেও তারাও আধা পারদর্শী সাঁতারু হওয়ায় শেষ রক্ষা হয়নি। তুষার একবন্ধুর গেঞ্জি ছিড়ে চলে যায় খাদের গভীরে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তুষারকে পাওয়া যাচ্ছিল না। কমমেড ক্লাস শেষ করে রুমে এসে এক বন্ধু বলল এই ঘটনা।

বুঝতে বাকি রইলনা ঘটনা কোন দিকে মোড় নিবে। ঘটতে চলছে বড় ধরণের কোন দুর্ঘটনা। রুমে এসে তড়িঘড়ি করে পাঞ্জাবীটা খুলে গামছা কাঁধে নিয়েই দিলাম দৌড়। ঘটনাস্থলে যেয়ে দেখি শতশত মানুষের ভীর। সময় ততক্ষনে অনেক গড়িয়েছে। বুঝলাম আর কাজ হবে না। জেলেরা এসে খোঁজাখুঁজি করছিল আর ডুবুরি রাজশাহী থেকে সিরাজগঞ্জের পথে।

এরপর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ডুবুরিরা হাঁস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত ছেলেটির লাশ উদ্ধার করে। কিছু সময় আগে যে ছেলেটি বন্ধুরদের সাথে মাটির উপর খেলাধুলা করছিল এখন সেই ছেলেটির নিথর দেহ পড়ে আছে মাটিতে। তুষার বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তাদের স্বপ্নের ডাক্তার। মাত্র ২ বছরব পরেই এমবিবিএস পাশ করে বড় ডাক্তার হবে তাদের ছেলে।

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছে বাবা-মা। ভারী হয়ে গেছে আশেপাশের পরিবেশ। এমন বাবা-মার আহাজারি চোখে দেখে সহ্য করার মত নয়। এরপরের দৃশ্যগুলো দেখে শুধু চোখের জলে বুক ভাছিয়েছি।

পরের দিন তুষারে নামাজে জানাযা শেষে খাটিয়া ধরলাম শেষ গন্তব্যে রেখে আসবো বলে। কবরের পাশে খাটিয়া রাখলাম। ওই অন্ধকার মাটির গর্তে রেখে আসতে হবে তুষারকে। ওটাই যে ওর বর্তমান ঠিকানা। তুষারের পরিবারের সবার অবস্থা খুবই করুণ। সবাই বেদনাবিদ্ধস্ত। তুষারকে কে নামবে ঐ ভয়ানক মাটির কুঠুরিতে।

তুষারের বৃদ্ধ কাকা সাথে আমি নামলাম কবরে। জীবনে কখনো এত কাছ থেকে কাউকে কবর দিতে দেখিনি। সেখানে নিজেই নামলাম ঐ কবরে। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলাম। তারপর নিথর দেহটি কঠিন মাটির নিচে রাখলাম। একটি একটি করে বাঁশ দিয়ে মাটির ঘরটির ছাউনি তৈরি করে উপরে উঠে আসলাম।

বুকের উপর মাটি চাঁপা দিয়ে অনন্তকালের মত বিদায় জানালাম আপন বন্ধুকে। ওর জন্য দাঁড়িয়ে দোয়া করলাম। কিভাবে কালকের তাজা প্রাণটিকে আজ মাটির নিচে রেখে এলাম মনে পড়াতেই নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। একটুও ভুলতে পারছিলাম না ঐ দৃশ্য। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। মাটিই যে সবার শেষ ঠিকানা।

কবির ভাষায়--
"এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি সেই সোনা মুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।"
আজ ২০১৮ সালের ২৮ জুন। বলছিলাম ২০১৪ সালের ২২-২৩ জুনের কথা। দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৪ বছর। আমরা সবাই এমবিবিএস পাশ করে ডাক্তার হয়েছি। শুধু ডাক্তার হতে পারলো না তুষার। স্মৃতিগুলো আজও আমাদের কাদায়।

তুষারের বাবা মার চোখের পানি আজও শুকায় নি। আল্লাহ যেন তুষারের বাবা-মাকে এই শোক সহ্য করার ক্ষমতা দেন। সবাই তুষারের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন ওকে জান্নাত দান করেন। প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার অহরহ সংবাদ আমরা শুনতে পাই। সাঁতার না জানা, অসাবধানতা ও অসর্তকতা এর মূল কারণ। এই কারণে আমার প্রিয় বন্ধু তুষারকে হারিয়েছি।

এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যেন আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়। দয়া করে এসব ব্যাপারে সবাই সর্তক হবেন। আর আপনার সন্তানকে অবশ্যই সাঁতার শিখাবেন। উল্লেখ্য,সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে বন্ধুদের সঙ্গে গোসল করতে গিয়ে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আজিজুল ইসলাম তুষার (২৩) ২০১৪ সালের ২২ জুন স্রোতের মধ্যে পড়ে নিখোঁজ হয়ে যায়।

পরে রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা এসে প্রায় এক ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে সন্ধ্যার দিকে যমুনা নদীতে থাকা পল্টনের নিকট থেকে তার লাশ উদ্ধার করে। এ মর্মান্তিক মৃত্যু এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তুষার সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার ভাঙ্গাবাড়ি মহল্লার ব্যাংক কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের ছেলে।

(এমএএম/এসপি/জুন ২৮, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test