E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কেন্দুয়ায় ঐতিহাসিক রোয়াইবাড়ীর প্রাচীন দূর্গ এলাকার খনন কাজ ফের বন্ধ হয়ে গেল

২০১৮ জুলাই ১২ ১৭:২১:৩৭
কেন্দুয়ায় ঐতিহাসিক রোয়াইবাড়ীর প্রাচীন দূর্গ এলাকার খনন কাজ ফের বন্ধ হয়ে গেল

সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) : নেত্রকোনা কেন্দুয়া উপজেলার ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ী প্রাচীন দূর্গ এলাকার খনন কাজ ফের বন্ধ হয়ে গেল। বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্বিক প্রাচীন স্থাপনা এটি। ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ী দূর্গের স্থাপনা হিসেবে ছাঁদ বিহীন ইমারত অবশিষ্ট রয়েছে। তবে এ সব স্থাপত্য নির্দশন সংরক্ষনের তেমন কোন উদ্যোগ নেই। 

বেতাই নদীর তীর ঘেষে কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিম কোণে রোয়াইলবাড়ী অবস্থিত। রোয়াইলবাড়ী দূর্গের নির্মানকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও প্রতœতত্ববিদগণের মতে সুলতানি আমলের স্থাপনা বলে মনে করা হয়। আবার অনেকেই এটিকে কোন মোঘল জেনারেলের তৈরী স্থাপনা বলে মনে করেন। তাদের মতে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৪৯৮ খ্রি. কামরুপের রাজা নিলেশ্বরের বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড যুদ্ধ পরিচালনা করে কামরুপ রাজ্য দখল করেন। এর কিছুদিন পর তার ছেলে নছরত শাহ কামরুপ শাসন শুরু করেন কিন্তু কিছুদিন যেত না যেতেই প্রতিপক্ষের আক্রমনের মুখে তিনি সেখান থেকে বিতারিত হন। এক পর্যায়ে কামরুপ থেকে পালিয়ে আসেন।

কথিত আছে নছরত শাহ কামরুপ থেকে পালিয়ে এসে পূর্ব ময়মনসিংহে বর্তমান নেত্রকেনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা রোয়াইলবাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৯৮০র দশকে আবিষ্কৃত এ প্রাচীন স্থাপনাটিকে ১৯৮৭ সালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে নথি ভূক্ত করে। পুরাকীর্তি ঘোষনার পর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর এখানে খনন কাজ পরিচালনা করে। এরপর দূর্গের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও দুটি ঢিবি আবিষ্কার করে। অনেকেই মনে করেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর পুত্র নসরত শাহ এ অঞ্চলে বসবাসের সময় দূর্গটি তৈরী ও সম্প্রসারন করেন। পরবর্তীতে ঈশা খাঁ ও তার পরবর্তী শাসকদের আমলেও দূর্গটির ব্যপক সম্প্রসারন কাজ করা হয়।

ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী রোয়াইলবাড়ী প্রাচীন দূর্গের বিস্তির্ণ অংশ দুই যুগ আগেও মাটির নিচে চাপা পরে ছিল। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতায় রোয়াইরবাড়ী দূর্গের খনন কাজ পরিচালনা করা হয়। দীর্ঘ সময়ের খনন কাজের ফলে মাটির নিচ থেকে বেড়িয়ে আসে প্রাচীন প্রত্নতত্ব নিদর্শন সমূহ। প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর সে সময় মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করে ইটের দেয়াল বেষ্টিত দূর্গ, মূল প্রবেশ দ্বার (সিংহদ্বার), বহুকক্ষ বিশিষ্ট একাধিক ইমারতের চিহ্ন, সান বাধানো ঘাট সহ দুটি পরিখা, বুরুজ ঢিবি ও ইমারত (টাওয়ার) ১২ দুয়ারী মসজিদ, নিয়ামত বিবি ও ডেঙ্গু মিয়া সাহেবের কবরস্থান এবং চওড়া প্রাচীর, লতাপাতা ফুলে ফলে আঁকা রঙিন প্রলেপযুক্ত কারুকার্য সংবলিত পুরামাটির অলংকৃত ইট, টালী, জ্যামিত্যিক মুটিফ, টেরাকোটা, বর্শা, প্রস্থর খন্ড, এবং লোহা ও চিনা মাটির তৈরী নানা ধরনের মূলবান সামগ্রী। এছাড়া দূর্গ এলাকায় দুটি বড় পুকুরও রয়েছে।

প্রায় ৪৬ একর ভূমির উপর রোয়াইলবাড়ীর প্রাচীন সুরক্ষিত দূর্গ এলাকাটি অবস্থিত। এর মোট আয়তন ৫৩৩*৪২৬ মিটার। সমস্ত দূর্গ এলাকাটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। মূল দূর্গের পূর্ব দিকের ইটের দেয়ালে রয়েছে সিংহদ্বার। যেটিকে লায়ন গেট বলা হয়ে থাকে। দুটি পুকুর রয়েছে দূর্গের সামনের অংশে পূর্ব দিকে। সিংহ দরজা বরাবর একটি উচুঁ রাস্তা দ্বারা পুকুর দুটি বিচ্ছিন্ন করা ছিল। দক্ষিণ দিকে মাটির দেয়ালের দুই পাশে ছিল দুটি পরিখা। অভ্যন্তরিন পরিখাটি একটি নালার মাধ্যমে পুকুর দুটির সংযুক্ত ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরো জানা যায় দক্ষিন দিকের পরিখাটি বেতাই নদী থেকে আসা নৌযান সমূহ নোঙ্গর করার জন্য ব্যবহৃত হতো বলে ধারনা করা হয়। দূর্গের উত্তর ও দক্ষিন দেয়ালে বড় বড় পাথর খন্ড দিয়ে নির্মিত আরো দুটি প্রবেশ পথ ছিল।

এছাড়া দূর্গের আভ্যন্তরিন সুরক্ষিত এলাকার উত্তর অংশে রয়েছে একটি বুরুজ ঢিবি (উঁচু ইমারত বা টাওয়ার), একটি প্রবেশ পথ ও কবরস্থান। বুরুজ ঢিবির পরিমান প্রায় ২৫ মিটার*২১ মিটার*৭ মিটার। এই বুরুজ ঢিবির পাশ থেকে খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে ৫ কক্ষ বিশিষ্ট একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ, সমান্তরাল ৩টি দেয়াল, প্রবেশদ্বার, ওয়াচ টাওয়ার (যা পর্যবেক্ষন চিলেকোঠা) ও চওড়া সিড়ি। খনন পর্যন্ত দূর্গের অভ্যন্তরে উত্তর পূর্ব দিকের প্রবেশ দুটি দেয়াল সাদা, নীল, সবুজ ও বাদামী রঙের চকচকে টালী দিয়ে বিভিন্ন ফুল, ফল, লতাপাতা এবং রঙিন নকশায় সজ্জিত। এখন এগুলো শেওলা ও ঝোপঝারে ঢেকে গেছে। ১২ দুয়ারী ঢিবির অবস্থান সিংহদরজার দক্ষিন প্রান্তে। এলাকায় এটি ১২ দুয়ারী ইমারত নামে পরিচিত।

খননের পর এখানে কারুকার্য মন্ডিত একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ধারনা করা হয় এটি দেওয়ান জালাল নির্মিত মসজিদ এ জালাল বা জালাল মসজিদ। এ মসজিদের ১৫টি গুম্বজ ছিল এছাড়া মসজিদের কাঠামোতে ছিল ১২টি দরজা, ৫টি খুদবা পাঠের মেহরাব (মিম্বর) এবং মার্বেল পাথরের তৈরী অনেক কারুকার্য খিলান। মসজিদের দেয়াল গুলো প্রায় ৭ মিটার চওড়া, এতে ঝিনুক চুন ও সুড়কির প্রলেপযুক্ত ইট ব্যবহার করা আছে। চমৎকার সূর্যমূখি ফুলের নকশায় পরিপূর্ণ ছিল এটির দেয়ালগুলো। দূর্গের দক্ষিণ দিকের খোলা ময়দানটিকে সেনাবাহিনীর প্যারেড গ্রাউন্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দূর্গের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি ভবন বা ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। কথিত আছে দূর্গের ভেতর বট গাছের নিচে একটি কবরে শুয়ে আছেন নিয়ামত বিবি। আরেকটি ১২ হাত লম্বা কবরে শুয়ে আছেন ডেঙ্গু মিয়া সাহেব (ডেঙ্গু মাল)।

প্রত্নতত্ব গবেষকদের মতে রোয়াইলবাড়ী প্রাচীন দূর্গের সমস্ত স্থাপনা সুলতানি আমলের স্থাপত্ব রীতিতে নির্মিত হলেও এর কারুকার্য অনেক বেশি নান্দনিক ও শিল্প সমৃদ্ধ। দূর্গের ধ্বংসাবশেষের পাশেই এলাকা বাসীর উদ্যোগে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে। এটির নাম রোয়াইলবাড়ী ফাজিল মাদ্রাসা। দূর্গ এলাকায় বেতাই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে রোয়াইলবাড়ী বাজার। প্রাকৃতিক সুন্দর্য্যে বেষ্টিত ঐতিহাসিক এ দূর্গের প্রাচীন নিদর্শনগুলো দেখতে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা আসেন। তারা দূর্গ এলাকায় খনন কাজ পুরোপুরি শেষ করে এসব স্থাপত্ব নিদর্শনগুলো উদ্ধার করে সংরক্ষনের মাধ্যমে দূর্গ এলাকাটি পর্যটন এলাকা হিসেবেও ঘোষনার দাবি জানান।

দাবির প্রেক্ষিতে গত বছর নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক ড. মো: মুশফিকুর রহমানের প্রচেষ্টায় প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর দূর্গ এলাকায় ফের খনন কাজ শুরু করে। কয়েক মাস কাজ করার পর বিভিন্ন নিদর্শন উদ্ধার করা হয়। সে সময় রোয়াইলবাড়ী দূর্গ এলাকায় এসব প্রাচীন নিদর্শনগুলো দেখতে ছুটে আসেন প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন। মহাপরিচালকের উপস্থিতিতে উদ্ধার করা নিদর্শনের প্রদর্শনী দেয়া হয়। কিন্তু এর পর থেকেই খনন কাজ ফের বন্ধ হয়ে যায়।

রোয়ালবাড়ী আমতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও খবর প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক এস.এম ইকবাল রুমি বলেন, রোয়াইলবাড়ীর প্রাচীন দূর্গ বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রত্নতাত্বিক স্থাপনা। নতুন প্রজন্মের কাছে এর ইতিহাস ঐতিহ্যের বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্যই খনন কাজ শেষ করে সমস্ত নিদর্শন উদ্ধার করা দরকার। আর এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষন করার মধ্যদিয়েই এখানে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। এর ফলে পর্যটকদের আগমনে সরকারের রাজস্বও আয় হবে বলে তিনি দাবি করেন।

(এসবি/এসপি/জুলাই ১২, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test