E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মামলার গ্রাম পাথাইরকোনা, বিরোধে ৫০ একর জমি পতিত

২০১৮ জুলাই ১৫ ১৮:৩৩:৫০
মামলার গ্রাম পাথাইরকোনা, বিরোধে ৫০ একর জমি পতিত

সমরেন্দ্র বিশ্বশর্মা, কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) : মামলার গ্রাম হিসেবেই খ্যাত হয়েছে পাথাইরকোনা। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার ১২ নং রোয়াইলবাড়ী আমতলা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত পাথাইরকোণা গ্রাম। এই গ্রামের দুই গ্রুপের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দাঙ্গা হাঙ্গামা ও সংঘর্ষের ঘটনায় মামলার সংখ্যা ১১টি। আর এই ১১ মামলার আসামীর সংখ্যা ৩ শতাধিক। ১১ টি মামলাতেই থেমে থাকবে না। আগামী দিনে আরো দাঙ্গা হাঙ্গামা ও মামলার পরিকল্পনা প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই গ্রুপের লোকজন। সবচেয়ে বিশ্বয়কর বিষয় হলো দুই গ্রুপের বিরোধ ও মামলার মোকদ্দমার জের ধরে হাওরের অন্তত ৫০ একর ফসলী জমি পতিত অবস্থায় পরে আছে।

কৃষকরা জানান, একটি আমন ও দুটি বোরো ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। এবারও আমনের চারা রোপন করা হবেনা এই ৫০ একর জমিতে। একে অপরকে হামলার আশংকায় এসব জমি চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি বলে তাদের দাবী। তিনটি ফসল উৎপাদন করতে না পারায় প্রায় ৪০ কোটি টাকার খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা।

রবিবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে জানাযায়, ওই গ্রামের ফসলী জমিতে সেচ দিয়ে আবাদের জন্য প্রায় ৩০ বছর আগে একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছিল। মাঝপথে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় গভীর নলকূপটি বেশ কিছুদিন বন্ধও ছিল। পরে এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ হলে বিদ্যুৎ চলিত একটি সেলু মেশিন (মটার) স্থাপন করা হয়। গভীর নলকূপের স্কিমের আওতায় অগভীর নলকূপ স্থাপন করা নিয়ে গভীর নলকূপের ম্যানেজার রেনু মিয়া ও অগভীর নলকূপের ম্যানেজার হক মিয়া এবং তাদের লোকদের মধ্যে দুইবছর আগে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এ বিরোধ থেকেই দুই গ্রুপের লোকদের মধ্যে একের পর এক পাল্টাপাল্টি হামলা সংঘর্ষ এবং এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি মামলা মোকদ্দমা।

পাথাইরকোনা গ্রামের ৬০ উর্ধ্ব বয়সের মুরুব্বি মোতালিব শাহ্ বলেন, গভীর নলকূপের স্কিমের আওতায় বেআইনি ভাবে একটি সেলু মেশিন বসানোর পরেই দুই গ্রুপের লোকদের মধ্যে মারামারি ও মামলা মোকদ্দমা শুরু হয়। বর্তমানে ১০/১১ টি মামলা চালু আছে। তিনি বলেন, এই মামলা মোকদ্দমার কারনে আমাদের কৃষকদের প্রায় ৪০ একর জমিতে তিনটি ফসল উৎপাদন করতে পারছিনা।

একই গ্রামের কৃষক আঃ রাজ্জাক, আলাল উদ্দিন, রিয়াজ উদ্দিন, জালাল উদ্দিন, জামাল মিয়া ও গভীর নলকূপের বর্তমান ম্যানেজার (রেনু মিয়ার পরিবর্তে) মো: আলম শাহ্ বলেন, আমাদের গভীর নলকূপের স্কিমের আওতায় হক মিয়া ও তার লোকেরা অন্যায় ভাবে একটি অগভীর নলকূপ বসায়। আর এ থেকেই বিরোধের সৃষ্টি।

আলম শাহ বলেন, দুই গ্রুপে মামলা মোকদ্দমার সংখ্যা বর্তমানে ১১টি। গ্রামের অন্যান্য কৃষকরা বর্তমানে আমনের চারা রোপন করার জন্য জমি চাষাবাদ করছে। কিন্তু বিরোধের কারনে দুই গ্রুপের ৫০ একর জমি চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। একটি আমন ও দুটি বোরো ফসল থেকে আমরা বঞ্চিত।

গ্রামের নেতৃস্থানীয় কৃষক জামাল উদ্দিন বলেন, দুই গ্রুপের বিরোধ মিমাংসার জন্য কেন্দুয়া পৌরসভার মেয়র মো: আসাদুল হক ভূঞা ও রোয়াইলবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান এস.এম ইকবার রুমি বার বার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। জমি পতিত থাকায় কৃষকরা আর্থিক ভাবে অনেক কষ্টে আছেন।

কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, শত্রুতা বশত প্রতিপক্ষের লোকজন তার বাগানের অর্ধশতাধিক সুপারি, আম, জাম্বুরা, ভূবি (লটকন) গাছ কেটে ফেলেছে। গাছ থেকে কাঠাঁল কেটে নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে কয়েক দিন আগে প্রতিপক্ষের ২৬ জনকে আসামী করে কেন্দুয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।

তিনি বলেন, তাদের অত্যাচারে এই গ্রামের লেহাজ উদ্দিন, আব্দুল খালেক এবং নজরুল এই তিন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা দেড় বছর ধরে বাড়ি ছাড়া। তারা অন্যের বাড়িতে বসবাস করছেন। এই তিন পরিবারের মেয়ে ছেলেরা আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

অপর দিকে এই গ্রামের কৃষক আলী আকবরের ছেলে রাসেল, আসাদুল ইসলামের ছেলে মিজান, আব্দুর রাশিদের ছেলে পলাশ ও জালাল উদ্দিনের ছেলে আনারুল জানান, প্রতিপক্ষের লোকদের কারনে তাদের জমিও পতিত রয়েছে। তাদের দাবি, রেনু মিয়ার লোকেরা নিজেরাই জমি চাষাবাদ করতে আসেনা। জমি চাষাবাদ করতে আসলে এতে আমরা কোন বাধাঁ দিবনা। তাছাড়া ফসলের মাঠে গভীর ও অগভীর নলকূপ দুটি চালু থাকলেই বিরোধ মিমাংসা হবে বলে তারা বলেন।

রোয়াইলবাড়ী আমতলা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সভাপতি পাথাইরকোনা গ্রামের বাসিন্দা মোকারম হোসেন বলেন, গভীর নলকূপের স্কিমে অগভীর নলকূপ বসানো নিয়ে দুই গ্রুপের বিরোধে পাল্টাপাল্টি হামলা সংঘর্ষে ১০/১১ টি মামলা হয়েছে। মামলার কারণে তাদের প্রায় ৪০/৫০ একর জমি পতিত রয়েছে। পৌরসভার মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যান উদ্যোগ নিয়েও বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেননি।

রোয়াইলবাড়ী আমতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস.এম ইকবাল রুমি বলেন, উভয় পক্ষের লোকদের নিয়ে কয়েক মাস আগে আমরা পরিষদে বসেছিলাম। একরকম শেষও হয়েছিল। কিন্তু দুই পক্ষের লোকজন শর্ত দিতে থাকায় অবশেষে শেষ হয়েও হলো না শেষ। ফসলী অনেক জমি পতিত থাকায় কৃষকরা কষ্টে আছেন বলেও তিনি জানান।

এদিকে পেমই তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর উজায়ের আল মাহমুদ আদনান জানান, তদন্ত কেন্দ্রে তার চাকরির বয়স দেড় বছর। এই দেড় বছরে পাথাইরকোনা গ্রামের ৫টি এফ.আই.আর ও ৫টি নন এফ.আই.আর মামলা হয়েছে বলে তিনি স্বিকার করেন। বর্তমানে গাছ কাটা ও দাঙ্গা হাঙ্গামার দুটি মামলার তদন্ত চলছে।

তিনি বলেন, দুই পক্ষের বিরোধের কারনে অনেক জমি পতিত আছে। কিন্তু তাদের বিরোধ কোন ভাবেই শেষ করা যাচ্ছে না।

(এসবি/এসপি/জুলাই ১৫, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test