E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র সক্রিয়

দুবাইয়ে নির্যাতিত সাতক্ষীরা ও যশোরের দুই নারীর ইমোতে বাঁচার আর্তনাদ

২০১৮ সেপ্টেম্বর ০৭ ১৬:১৯:৫২
দুবাইয়ে নির্যাতিত সাতক্ষীরা ও যশোরের দুই নারীর ইমোতে বাঁচার আর্তনাদ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ‘সাংবাদিক দাদা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। ওরা  না খেতে দিয়ে ও নির্যাতন করে আমাকে মেরে ফেলবে। প্রতিদিন ঔষধ খাইয়ে আমাকে ১০ থেকে ১২ জন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করা হচ্ছে। আপত্তি করায় ইতিমধ্যেই আমার দু’ স্তন, উরু, পা ও হাত গরম ইস্ত্রি দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ডান চোখটি ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দেওয়া  হয়েছে। দু ’পাচারকারি গ্রেফতার হওয়ার পর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। তাদেরকে নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে আমাকে যে কান সময় মেরে ফেলা হবে বলে জানানো হয়েছে।’

শুক্রবার দুপুরে সৌদি আরব এর সমুদ্র বন্দর ‘দাম্মাম খাবজি’ এর নিকটবর্তী দুম্বা খাটালের মালিক ‘হায়ান ম্যাডাম অরফা’ এর কাছে বিক্রি হওয়া সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মাগুরা কর্মকারপাড়ার অষ্টাদশী এক নারী ইমো ফোনে কথা বলার সময় তার উপর নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরেন। এ সময় ওই নারী তার দেহের উপর নির্যাতনের পাশবিক দগদগে ক্ষত চিহ্নযুক্ত অত্যাচারের দৃশ্য দেখিয়ে বলেন, “আব্বু, আম্মু ও দু’ বোনকে শেষ বারের মত দেখতে চাই।”

সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সপ্তম শ্রেণী উত্তীর্ণ নির্যাতিতা ওই নারী আরো বলেন, সেবিকা হিসেবে মাসিক ৪০ হাজার টাকা বেতনে হাসপাতালে সেবিকার চাকুরি দেওয়ার কথা বলে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে চলতি বছরের ফেব্র“য়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় তাকে সৌদিতে পাঠান প্রতিবেশী নাছিমা ও তার সহযোগি খুলনা টুটপাড়ার সোহাগ বাবু। তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউপি চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান লিপুর কাছ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে পাসপোর্ট তৈরিতে ব্যবহার করেন আছমা ও সোহাগ বাবু।

আছমা নগরঘাটার মীর আলী মাষ্টারের মেয়ে হওয়ার সুবাদে চেয়ারম্যানের সঙ্গে সুসম্পর্ক কৌশলে সে এ জন্মসনদ সংগ্রহ করে। তাকে সৌদি বিমানবন্দরে আসার পরপরই সৌদি দালাল ফরহাদ তাকে চার লাখ টাকায় বিক্রি করেন সমুদ্র বন্দর ‘দাম্মাম খাবজি’ এর নিকটবর্তী দুম্বা খাটালের মালিক ‘হায়ান ম্যাডাম অরফা’র কাছে। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়। প্রথম দিন থেকেই তাকে বহু পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হয়। অপারগতা প্রকাশ করায় সারা দিনে মাত্র একটি রুটি ও পানি খাইয়ে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। এখানে শুধু সে নয়, বাংলাদেশী আরো বেশ কয়েকজন নারীকে সেখানে এনে একইভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একজন মারা ও গেছেন।

নির্যাতিতা ওই নারীর বাবা জানান, গত ২৪ আগষ্ট আন্তঃজার্তিক নারী পাচারকারি দলের সদস্য খুলনার সোহাগ বাবু পরদিন তাদের বাড়িতে এসে বড় মেয়েকে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইতিপূর্বে দাবিকৃত এক লাখ টাকা ও পাসপোর্ট বই নিতে আসেন। ওই দিন কৌশলে তাকে ছেড়ে দিয়ে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিষয়টি বরিশাল র‌্যাব-৮ এর কোম্পানী কমাণ্ডারকে জানানো হয়।

র‌্যাব-৮ এর কর্মকর্তা বিষয়টি খুলনা র‌্যাব-৬ এর কোম্পানী কমাণ্ডারকে অবহিত করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য সুপারিশ করেন। র‌্যাব এর পরিকল্পনা অনুযায়ি তিনিসহ তার বড় মেয়ে, আত্মীয় মাগুরার গফফার করিবারজ ও তার ছেলে মামুনকে নিয়ে ২৮ আগষ্ট সন্ধ্যায় খুলনা সোনাডাঙা বাসষ্টাণ্ডে এসে এক লাখ টাকা ও বড় মেয়ের পাসপোর্ট দেওয়ার কথা বলে সোহাগ বাবুকে আটক করা হয়। র‌্যাব এর কাছে সোহাগ বাবুর স্বীকারোক্তি অনুযায়ি ২৯ আগষ্ট মাগুরার কর্মকারপাড়া থেকে দালাল নাছিমাকে গ্রেফতার করে সদর থানার পুলিশ।

শুক্রবার বিকেলে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে সৌদি আরবের হায়ান ম্যাদাম অরফি এ প্রতিবেদককে জানান, চার লাখ টাকা ফেরৎ দিলে তিনি ওই মাগুরার ওই নারীকে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

সৌদি দালাল ফরহাদ এ প্রতিবেদককে জানান, ইচ্ছা করলেই এখানে আসা যায়, যাওয়াটা তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। পাচার নয়, স্বেচ্ছায় ওই নারী সৌদিতে এসে পতিতাবৃত্তি বেছে নিয়েছেন।

একইভাবে আন্তজার্তিক নারী পাচার সিণ্ডিকেডের সদস্য সোহাগ বাবু ও নাছিমা নগরঘাটা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান লিকুর কাছ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে যশোরের কেশবপুর উপজেলার সারুটিয়া গ্রামের ৫৪ বছরের এক চুলপাকা নারীর জন্ম নিবন্ধনে ৩৮ বছর দেখিয়ে চুলে কলপ করে সৌদিতে পাঠিয়েছে গত ৩ আগষ্ট। চুলে কলপ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পাকা চুল বেরিয়ে আসায় ওই নারীর কপালে জুটছে প্রতিনিয়ত একই ধরণের নির্যাতন। সৌদি বিমানবন্দরে নামার পরপরই সৌদি দালাল ফরহাদ তাকে সমুদ্র বন্দর ‘দাম্মাম খাবজি’ এলাকায় এক মালিকের কাছে দু’ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন।

নির্যাতিতা ওই নারীর স্বামী শুক্রবার দুপুরে সাতক্ষীরার স্বদেশ অফিসে বসে এ প্রতিবেদককে ইমোতে শুনাচ্ছিলেন ও দেখাচ্ছিলেন তার কঙ্কালসার স্ত্রীর হাসপাতালে শুয়ে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের বর্ণনা। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন ওই নারী। এ ঘটনায় ওই নারীর ছেলে ও জামাতা কেশবপুর থানায় যেয়ে মামলা দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন।

এদিকে সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক অনুপ কুমার দাস জানান, মাগুরার কর্মকারপাড়ার এক নারীকে পাচারের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত খুলনা শহরের টুটপাড়া জোড়াকল বাজারের আব্দুল খালেকের ছেলে আল মামুন ওরফে কামরুজ্জামান ওরফে সোহাগ বাবু ও সাতক্ষীরা সদরের মাগুরা কর্মকারপাড়ার আব্দুস সামাদের স্ত্রী নাছিমা খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বৃহষ্পতিবার আদালতে পাঁচ দিনের রিমাণ্ড আবেদন জানানো হলে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম হুমায়ুন কবীর শুনানীর জন্য আগামি মঙ্গলবার দিন ধার্য করেছেন।

বেসরকারি সংস্থা ‘স্বদেশ’ এর নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত জানান, মাগুরার ওই মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য আইন ও শালিস কেন্দ্রের সহযোগিতায় তারা বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকায় অবস্থানকারি সৌদি রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করেছেন। খুব শ্রীঘ্র আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে ফিরিয়ে আনা হবে।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test