E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পরিকল্পনাহীন নগরায়নের ছোবলে বৈচিত্র্য হারাচ্ছে কর্ণফুলী উপজেলা

২০১৮ সেপ্টেম্বর ১০ ১৬:০০:০০
পরিকল্পনাহীন নগরায়নের ছোবলে বৈচিত্র্য হারাচ্ছে কর্ণফুলী উপজেলা

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : কর্ণফুলীতে গড়ে ওঠেছে অপরিকল্পিত নগরী। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উপজেলায় বসবাস করা মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে সম্প্রসারিত হচ্ছে অবকাঠামো সুবিধাও। এতে উপজেলায় নগরায়নের ফলে কমছে কৃষিজমি। ফসলি মাঠে গড়ে ওঠছে বহুতল ভবন।

অপরিকল্পিতভাবে মিল ফ্যাক্টরী, কারখানা, ইটভাটা ও বসতবাড়ি নির্মাণের কারণে কর্ণফুলীতে দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গত দুই দশকে উপজেলায় কৃষিজমি কমেছে কমপক্ষে সহস্র একর।
এতে আগামী ২৫বছরে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া, ভবিষ্যত মানুষের বসবাস করার বসতি কোথায় হবে সে আশঙ্কা ও কম গুরুত্ব নয়। কংক্রিট কিংবা ইট পাথরের দালানে গ্রাস করছে উবর্র শক্তির ফসলি ধানি জমিগুলো।

বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা নির্মাণে ব্যবহারের কারণে প্রতিদিনই কমছে কৃষি জমি। জলাভূমিও ভরাট করে ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যাতায়াতে কর্ণফুলী নদীর শাখা খাল প্রভাবশালীদের দখলে অধিকাংশ। অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, পুকুর খনন, মাছ চাষ ও নদীভাঙনের ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।

এ যেন দেখার কেহ নেই। আবার বড় বড় কোম্পানীর কাছে নগদ টাকার লোভে জমি বিক্রি করে বাস্তুহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট। আবার কোথাও কোথাও সরকারী ভূমি কতিপয় কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।

মোদ্দাকথা পরিকল্পনাহীন নগরায়ণের ছোবলে বৈচিত্র্য হারাচ্ছে কর্ণফুলী উপজেলা। ইছানগর ও জুলধায় ইটভাটার জন্যও প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। নানাভাবে কৃষি জমি উৎপাদনহীন কর্মকান্ডে ব্যবহার চলছে।

অচিরেই মানুষের বসবাসে পরিকল্পনা না নিলে সামনে বিপন্নতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই বিপন্নতা মোকাবিলায় সরকারের নানা সুরক্ষার পদক্ষেপ ও আইন থাকলেও তা বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসন উদাসী এবং কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেই বল্লে চলে।

স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। সাড়ে তিনহাজার মতো রোহিঙ্গা প্রবেশের কথাও রয়েছে। তার প্রভাব পড়ছে ফসলি জমির ওপর। পরিবার বিভক্ত হলে তার প্রথম ধকলটিই পড়ে কৃষি জমিতে। এক বাবার চার সন্তান পৃথক হওয়ার পরক্ষণেই আবাদি জমিতে যার যার বাড়িঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ দেখা যায়।

অনেকে চাকরির ওপর নিভর্রশীল হওয়ায় কৃষি জমির কোনো প্রয়োজনবোধ করছেন না। এরপরও আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল। প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বহু হেক্টর জমি। আবাসন ও নির্মাণকাজে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমছে, তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে জমির উবর্রতা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ মিল কারখানা তৈরীতে রয়েছে সরকারী নানা নির্দেশনা। যা কেহ মানছেনা।

সরকারি কর্মকর্তাদের গাফলতি কারনেও কমছে কৃষি ও সরকারী খাস জমি এমন অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। জমির দাম বাড়ায় বিভিন্ন ইউনিয়নে সরকারী খাস জমি বা পুকুর ভরাট করে শ্রেনী পরিবর্তন করে দখল নিচ্ছে খাসজমি।

স্থানীয়রা জানায়, তবে প্রস্তাবিত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে কৃষি জমিতে আবাসন, শিল্পকারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো রকম অকৃষি স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। জমি যে ধরনেরই হোক না কেন, তা কৃষি জমি হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। দেশের যে কোনো স্থানের কৃষি জমি এ আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত হবে এবং কোনোভাবেই তা ব্যবহারে পরিবর্তন আনা যাবে না।

কোনো অবস্থাতেই উর্বর জমিতে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেয়া যাবে না। যে কোনো ধরনের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। আইনে বিচার ও দন্ড হিসেবে বলা হয়েছে, আইন লঙ্ঘনকারী বা সহায়তাকারীর অনূর্ধ্ব দুই বছর কারাদন্ড বা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ দন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে।

এ আইনের অধীনে অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য হবে এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্মকর্তা বা বন ও মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মামলা করতে পারবেন।
চট্টগ্রাম শহরের অতি পার্শ্ববর্তী হওয়ায় কর্ণফুলীতে যত্রতত্র গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্পসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিবেশের ছাড়পত্র কিংবা সরকার বিধি মেনে এসব শিল্পকারখানা কর্ণফুলীতে গড়ে ওঠেছে কিনা সেটাও জানা যায়নি।

তবে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এস আলম সিআর কয়েল লিঃ শিকলবাহা,এস আলম স্টীল লিঃ,এস আলম ভেজিটেবল লিঃ, এস আলম সিমেন্ট লিঃ,চেমন ইস্পাত লিঃ,ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড,এস আলম ঢেউটিন লিঃ, মর্ডান পলি ইন্ডাস্ট্রিজ, মমতা টেক্সটাইল, শিকলবাহা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যু কেন্দ্র,বার্জমাউন্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এহসান স্ট্রিল মিল,এহসান সি রিসোর্স লিঃ, কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স, এস আলম সুগার রিফাইনারি, এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্ট, ফোর এইচ বেলামি টেক্সটাইল, ব্যাঞ্চমার্ক এপারেল গার্মেন্টস, গোল্ডেন সন লিঃ,ইছানগর ড্রাই ডগ, ডিভাইন টেক্সটাইল লিঃ,ডায়মন্ড সিমেন্ট লিঃ, মাসুদ এগ্রো ফিড লিঃ, এস আলম ওয়েল রিফাইনারী, কর্ণফুলী শিপ ইয়ার্ড,মোস্তফা ব্রিকস মিলস, পেট্রো কেমিকেল লিঃ,আবু মেরিন শিপ বিল্ডার্স, এসএ গ্রুপের তেল শোধানাগার,স্টার ফার্নেস ওয়েল, এফ এইচ কেল রিফাইনারী ইন্ডাস্ট্রিজ, সী সোর কোম্পানী লিঃ, প্রিমিয়াম সিমেন্ট লিঃ, হাবিন বিন এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট,আবুল খায়ের ক্যারিয়ার শিপিং ওয়ার্কশপ, ইছানগর ব্রিকস, ইন্ডাস্ট্রিজ পার্ক তেল শোধনাগার সহ দেড় শতাধিক ছোটবড় শিল্প প্রতিষ্ঠান।

পরিবেশেও মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। অপরিকল্পিত বাড়িঘর শিল্প-কারখানা বা রাস্তাঘাট তৈরি রোধ করে ভূমির শ্রেণী ও প্রকৃতি ধরে রেখে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখা জরুরি হয়ে পড়ছে।
একটি আদর্শ ও মডেল উপজেলা গঠনে পরিকল্পিত নগরায়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে একটি সম্ভাবনাময় নবসৃষ্ট উপজেলা কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন থেকে ছিটকে পড়ে। আমাদের শহরগুলোও দিনে দিনে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। একটি সুন্দর বসবাসযোগ্য দেশ গঠনের পূর্বে একটি পরিকল্পনা জরুরী।

একবিংশ শতাব্দীতে উন্নত নগরায়ন মানুষের প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে। জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনে মানুষ এখন নগরমুখী। সে কারণেই নগরায়নকে পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যকর ও সুষম হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বলা যায়, নগরজীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য, পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও উন্নয়নমুখি করা এখন সময়ের দাবি।
পরিকল্পিত নগর বলতে বুঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। কোথায় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল হবে, অফিস-আদালত কোথায়, কোথায় বসবাসের জায়গা সবকিছুই হবে পরিকল্পনামাফিক।

পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃঙ্খলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু এই নগরই আবার পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে উঠে। জনজীবনকে তা বিপর্যস্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না। এজন্য নতুন উপজেলার কাঠামোগত উন্নয়ন করার শুরুতেই দরকার একটি স্বচ্ছ পরিকল্পনা বলে মন্তব্য করেন বসবাসরত স্থানীয় জনগণ।

নবসৃষ্ট র্কণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ফারুক চৌধুরী বলেন, “কর্ণফুলী উপজেলায় বসবাসযোগ্য করার জন্য মাষ্টার প্ল্যানে হাত দেবো, অপরিকল্পিতভাবে মিল ইন্ডাষ্ট্রী বা বাড়ীঘর করতে সরকারী ভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে” ।

এমনকি তিনি আরো জানান, উপজেলা থেকে অনুমতি ছাড়া কোন স্থাপনা করা যাবে না। যদিও অনেকের কাছে সেই খবর নেই’।

(জেজে/এসপি/সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test