E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পদ্মার আগ্রাসী ছোবল : মানবিক বিপর্যয়ের মুখে এক বৃহৎ জনপদ

২০১৮ সেপ্টেম্বর ১৩ ১৫:১০:৩০
পদ্মার আগ্রাসী ছোবল : মানবিক বিপর্যয়ের মুখে এক বৃহৎ জনপদ

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : শতাব্দীর ভয়াবহতম ভাঙ্গনের কবলে পরেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার একটি বৃহৎ জনপদ। সমাজের হতদরিদ্রদের পাশাপাশি স্বচ্ছল পরিবারগুলো তাদের শত বছরের আবাসস্থল হারিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে অন্যের জমি বা বাড়িতে। গত এক মাসে পদ্মা নদীর আগ্রাসী ছোঁবলে বিলীন হয়েছে ৬ হাজারেরও বেশী মানুষের বসত বাড়ি, ফসলি জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিক, মসজিদ, মন্দির, পাকা সড়ক, বিদ্যুৎ লাইন, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ মানুষের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদ। 

নড়িয়া পৌর এলাকা, মোক্তারেরচর ইউনিয়ন ও কেদারপুর ইউনিয়নের প্রায় ১০ কিমি এলাকা হারিয়ে গেছে নদী গর্ভে। ফলে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে নড়িয়ার মানচিত্র। হাজার হাজার বাস্তু হারা মানুষের মাথা গোজার ঠাঁই না হওয়ায় আর প্রয়োজনীয় ত্রান সহায়তা না পাওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পরেছে। ঠিকমত দু‘বেলা খাদ্য আর চিকিৎসা সেবার সুযোগ না থাকায় গোটা এলাকা জুরে হাতছানি দিচ্ছে এক মানবিক বিপর্যয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়হীন মানুষদের জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়নি।

প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, নড়িয়া উপজেলায় ২৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। প্রয়োজনে সেখানে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা আশ্রয় নিবেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছেন, এ বিষয়ে জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে কোন ধরনরে নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি এমনকি কোন ধরনের মাইকিং বা প্রচারণার মাধ্যমেও ক্ষতিগ্রস্তদের জানানো হয়নি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে সব হারানোদের চরম দুর্দশার চিত্র, শুনা গেছে মানুষের গগণ বিদারী বুক ফাঁদা আর্তনাদের করুণ শব্দ। কথা বলি, কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ঈমাম হোসেন দেওয়ানের সাথে। আশ্রয় নিয়েছেন নড়িয়া পৌর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তিনি ১৫ বছর ছিলেন এই ইউনিয়নের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। চাচা আব্দুল করিম দেওয়ান চেয়ারম্যান ছিলেন ৫০ বছর। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যও ছিলেন দীর্ঘদিন। ঈমান হোসেন দেওয়ানের ৫ একর জমি সমেত একটি সাজানো বসত বাড়ি ছিল। আরো ৫০ একর ছিল ফসলি জমি। বাড়িতে পাকা-সেমি পাকা ঘর ছিল অন্তত ১২টি।

মাত্র কয়েকদিন আগেও ঈমাম হোসেন দেওয়ানের সকাল শুরু হতো বৈঠক খানায় শত মানুষের কোলাহলের মাঝে। আজ সেই ঈমাম দেওয়ান নি:স্ব। আজ বাজারে তার বহুতল পাকা ভবন নেই, বাড়িতে সাজানো সাঁড়ি সাঁড়ি ঘর নেই। নেই দামী বিছানা-আসবাব। সব কিছুই কেড়ে নিছে রাক্ষুসী পদ্মা। তার বুক ফাঁটা কান্না শুনলে কোন সুস্থ্য মানুষ স্থির থাকতে পারেনা।

ঈমাম হোসেন দেওয়ান প্রলাপের সাথে বলছিলেন, “ এখন আর কাঁদতেও পারিনা। চোখের সব পানি শুকিয়ে গেছে। আমরা হাজার হাজার মানুষ সব হারিয়েছি নদী গর্ভে। সরকার আমাদের রক্ষার জন্য হাজার কোটি টাাক বরাদ্দ দিল, সময় মত প্রতিরক্ষা বাধ দিলে স্মরণ কালের এই ভয়ংকর ভাঙ্গনের শিকার আমরা হতামনা। আর কিছুই চাইনা, সরকার যেন এই এলাকাটিকে দূর্গত এলাকা ঘোষনা করেন, যেন মানুষের মাথা গোজার একটু আশ্রয় করে দেয়”। শুধু ঈমান হোসেনই নন, তার আপন ৫ভাই, চাচাতো ভাই, বংশের অন্য সকলের অন্তত ২ শত একর জমি, বাজারের মার্কেট, বাড়ির পাকা বহুতল ভবন, ক্লিনিক সহ অন্তত শত কোটি টাকার সম্পদ বিলীন হয়েছে নদী ভাঙ্গনে।

উত্তর কেদারপুর জেলে পাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে আরেক করুণ চিত্র। ওই গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বিদের আবাস। বেশীরভাগ লোকই মৎসজীবী। গ্রামে ছিল শত বছরের পুরনো সত্য নারায়ন সেবা মন্দির। চোখের সামনেই বিলীন হলো শত ফুট উঁচু মন্দিরের মঠ সহ উপসনালয়ের সবগুলো চিহ্ন। এই মন্দিরের সভাপতি কার্ত্তিক চন্দ্র ঢালী ও তার স্ত্রী বীনা রানীর কান্নায় ভারী হয়ে উঠছিল বাতাস। তাদের আর্তনাদে সব কিছু যেন নিথর-স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। কার্ত্তিক চন্দ্র বার বার মূর্ছা যাচ্ছিল আর বলছিলেন, “ ৭১‘এ সব হারিয়েছি হানাদারদের ছোঁবলে। তবুও টিকে ছিলাম বাপ-দাদার ভিটে মাটি আকড়ে ধরে। আজ রাক্ষুসী পদ্মা সব কিছু ছিনিয়ে নিল। এখন কোথায় থাকবো, কি খাব, কার কাছে যাব, আর ঠাকুরের নামে পূঁজা অর্চণাই বা করবো কোথায় গিয়ে”।

চলতি বছরের ২ জানুয়ারী জাজিরার কুন্ডেরচর থেকে নড়িয়ার সুরেশ্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মার ডান তীর প্রতিরক্ষার জন্য স্থায়ী বাধ নির্মানে সরকার ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। কিন্তু নানা জটিলতায় সুষ্ক মৌসুমে বাধ নির্মানের কাজ শুরু না করায় এ বছরও ভাঙ্গন শুরু হয়েছে ব্যাপক এলাকা নিয়ে। বর্তমান ভাঙ্গন কবলিত চার কিলোমিটার এলাকায় জরুরী প্রতিরক্ষামূলক কাজ করার জন্য ২০ কোটি টাকার আবেদন করা হলে অনুমোদন পাওয়া গেছে মাত্র ২ কিলো মিটার ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় বালু ভর্তি জি,ও ব্যাগ ফেলার জন্য তিন দফায় ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং এত টাকা খরচ করেও ফল আসেনি সিকিভাগ । এদিকে সময় মত মূল প্রকল্পের কাজ না করায় ক্ষোভ জমেছে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। তাদের দাবী স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতাদের রেষারেষি এবং সমন্বয় হীনতার কারনেই গত শুষ্ক মৌসুমে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি।

স্থানীয়রা জানান, জুন মাসের শেষ দিক থেকে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর, কুন্ডেরচর ইউনিয়ন এবং নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়ন, ঘড়িসার ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌর এলাকায় পদ্মা নদীর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের ফলে গোটা এলাকায় ৬ হাজারেরও অধিক পরিবার তাদের বসত বাড়িসহ সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।

এর মধ্যে শুধু নড়িয়া উপজেলাতেই রয়েছে সাড়ে ৫ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত।ভাঙ্গন ঝুঁকিতে রয়েছে নড়িয়া বাজার, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, খাদ্য গুদাম, পৌরসভা ভবন, নড়িয়া বালিকা বিদ্যালয়, নড়িয়া বিহারীলাল উচ্চ বিদ্যালয়, নড়িয়া সরকারি কলেজ, ডজন খানেক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক, মুলফৎগঞ্জ বাজার, বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ হাজার হাজার জনবসতি । ইতমধ্যে মূলফৎগঞ্জ বাজারের তিন শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দুইটি প্রাইভেট ক্লিনিক, ৫০ শয্যা উপজেলা হাসপাতালের নতুন ভবন, অন্তত ২ শত বহুতল পাকা বাড়ি, বাঁশতলা বাজার, সাধুর বাজার নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

কেদারপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছানাউল হক জানান, এই ইউনিয়নের অন্তত তিন হাজার পরিবারের সব ধরনরে সম্পদ নদীতে ভেংগে নিয়ে গেছে। দুইটি ওয়ার্ড সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে। আরো ৪টি ওয়ার্ডের ৬টি গ্রামের ৮০ শতাংশ ভেঙ্গেছে গত এক সপ্তাহে। ক্ষতিগ্রস্তদের ৩০ কেজি ত্রানের চাউল ছারা কোন সরকারি সহায়তা দেয়া হয়নি।কয়েক শত পরিবারকে দুই বান্ডেল করে ঢেউ টিন দেয়া হবে বলে তিনি শুনেছেন। তিনি সরকারের কাছে এই ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য সকল মানবিক সহায়তা দাবী করেছেন।

ভাঙ্গনকবলিত এলাকার বাসিন্দা শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক এ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, জানুয়ারীর ২ তারিখে বছরের প্রথম বৈঠকে একনেকের সভায় পদ্মার ডানতীর রক্ষার জন্য ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হলেও একটি মহলের অবহেলার কারনে গত শুস্ক মৌসুমে বাধ নির্মানের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এখন জরুরী প্রতিরক্ষামূলক কাজে যে জি,ও ব্যাগ ফেলানো হচ্ছে তা অপরিকল্পিত। এতে কোন উপকার হচ্ছেনা। নদী যেভাবে ভাংছে তাতে আমাদের নড়িয়া সদরের অস্তিত্ব আগামী এক মাসের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। ছোট হয়ে যাবে নড়িয়া উপজেলার মানচিত্র।

নড়িয়া পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম বাবু রাড়ি বলেন, এ বছরের ভাঙ্গনে আমার পৌরসভার ২ ও ৪ নং ওয়ার্ডের ৮০ শতাংশ পরবিারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭ শতটি পরিবারের বাড়ি নদী গর্ভে চলে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফলতি আর রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়হীনতার কারনে আজ আমরা আমাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছি। এখনো যদি স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ নির্মানের কাজ শুরু না করা হয়, তাহলে নড়িয়া বাজারসহ অন্তত ২০টি স্কুল-কলেজ, পৌর ভবন, উপজেলা কমপ্লেক্স, হাসপাতাল, খাদ্য গুদাম সব কিছু বিলীন হয়ে এই উপজেলার মানচিত্র থেকে নড়িয়া উপজেলা শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে ভাঙ্গন কবলিতদের আশ্রয় গ্রহনের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন বা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি বা কোন ঘোষনাও দেয়া হয়নি।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় জি,ও ব্যাগ ফেলে জরুরী প্রতিরক্ষার কাজ চলছে। ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। প্রয়োজনে আরো বরাদ্দ বাড়ানো হবে। ৮ দশমিক ৯ কিলোমিটার এলাকার স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ নির্মমের জন্য গত ২৬ আগষ্ট বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান খুলনা শীপ ইয়ার্ড দরপত্র দাখিল করেছে। দরপত্র মূল্যায়নের পর ক্যাবিনেট কমিটিতে দরপত্র অনুমোদন দেয়া হলে কার্যাদেশ প্রদান করা সম্ভব হবে। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে আগামী শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাস নাগাদ স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাধ নির্মানের কাজ শুরু করা যেতে পারে। আরো আগে কেন প্রতিরক্ষা বাধ নির্মানের কাজ শুরু করা সম্ভব হলোনা এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা জানান, আইনগত বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারনেই গত শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু করা যায়নি।

নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা ইয়াছমিন বলেন, ইতমধ্যে আমরা ৩ হাজার ৫ শত পরিবারকে ৩০ কেজি করে ত্রানের চাল বিতরণ করেছি। ২ বান্ডেল করে ঢেউ টিন বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৭ শত পরিবারকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদী ভাঙ্গনে ভিটে বাড়ি হারানো লোকদের কোন আশ্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, উপজেলায় ২৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় নিতে জনপ্রতিনিধিদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

(কেএনআই/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test