E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

২ বছর আগেই নির্মাণ কাজ শেষ

পাম্প হাউজ ও ড্রেনেজ জটিলতায় চালু হচ্ছে না পানি শোধনাগার

২০১৮ সেপ্টেম্বর ২৫ ১৯:০৮:৫৮
পাম্প হাউজ ও ড্রেনেজ জটিলতায় চালু হচ্ছে না পানি শোধনাগার

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : নড়াইল সদর পৌরবাসীর  বিশুদ্ধ খাবার পানির নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য ৯ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মান করা হয়েছে একটি পানি শোধনাগার (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) । শোধনাগারটির  নির্মানের মূল কাজ  ২ বছর পূর্বে শেষ হলেও পাম্প হাউজ ও ড্রেনেজ জটিলতায় এখনও চালু হয়নি। দুটি পাম্প হাউজ ও একটি ড্রেনের জন্য চালু হচ্ছে না ৯ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত পানি শোধনাগারটি। শোধনাগারটি চালু হলে পৌরসভার ১৩ কিঃ মিঃ এলাকার হাজার হাজার মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানির নিশ্চয়তা পাবে। নির্মানের দীর্ঘদিন পরেও শোধনাগারটি চালু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রাকাশ করছে এলাকাবাসী। 

শোধনাগারটি দ্রুত চালু করার ব্যাপারে তেমন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা নড়াইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, এমনটাই অভিযোগ পৌর এলাকার সাধারন মানুষের। প্রকল্প চলা কালে গত ৪ বছরে ১৪ বার নির্বাহী কর্মকর্তা পরিবর্তন পরিবর্তন হয়েছে। বেশির ভাগ কর্মকর্তার কর্মকাল ছিল ১৫ দিন থেকে ৪ মাস। ঘন ঘন কর্মকর্তার পরিবর্তনই প্রকল্প চালু না হওয়ার মূল কারন এমনটাই অভিযোগ এলাকাবাসীর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে নড়াইল শহরের কুরিগ্রাম এলাকায় ৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কাজ শুরু হয়। শি-এমটি এন্ড এস এস কনসোর্টিয়াম নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ প্লান্ট নির্মান করে। ইতোমধ্যে ২ বছর আগে পানি শোধনের সমস্ত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, পানি পাম্প নির্মানসহ বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অথচ ২টি পাম্প হাউজ ও একটি বর্জ পানি অপসারনের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা না করায় এ প্লান্ট চালু করা হয়নি আজও।

অফিস সুত্রে জানা গেছে, শোধনাগারটি চালু করতে হলে ৪টি পাম্প হাউজের পানি প্রয়োজন হবে। সেই লক্ষে ২০১৪ সালে স্থানীয় ২টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ব্যায়ে ৪টি পাম্প হাউজ নির্মান করার জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়। বিভিন্ন জটিলতার কারনে পাম্প হাউজ নির্মানকারী প্রতিষ্ঠান একটি করে পাম্প হাউজ নির্মান করতে ব্যার্থ হয়। পরে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাজের চুক্তি বাতিল করে নতুন করে ২টি পাম্প হাউজ নির্মান করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ার ম্যাধ্যমে দ্রুত পাম্প হাউজ ২টি নির্মান করার প্রক্রিয়া চলছে। এদিকে শোধনাগারটি চালু করতে হলে বর্জ পানি অপসারনের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থার দরকার। বর্জ পানি অপসারনের জন্য একটি ড্রেনেজ নির্মানের জন্য প্রায় এক কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটির অনুমোদন পেলে দ্রুত ড্রেনটি নির্মান করা হবে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে নড়াইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, শোধনাগারটি চালু করতে হলে কম পক্ষে ৪টি পাম্প হাউজ থেকে পানি লোড দিতে হবে। নড়াইলের একটি মহলের অসহযোগিতা করার জন্য জমি জটিলতার কারনে ২টি পাম্প হাউজ আজও নির্মান করা সম্ভাব হয়নি। বর্তমানে সেই (জমি জটিলতার) সমস্যা কেটে গেছে। তিনি আশা করেন পাম্প হাউজ ও ড্রেনেজ নির্মান করে দ্রুত শোধনাগারটি চালু করা হবে।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারন সম্পাদক কাজী হাফিজুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন আগে মুল কাজ সমাপ্ত হওয়ার পরেও সামান্যা কিছু কাজের জন্য শোধনাগারটি চালু করা হচ্ছেনা। এতে সাধারন মানুষকে বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। দ্রুত এই শোধনাগারটি চালু করার আহব্বান জানান তিনি।
শি-এমটি এন্ড এস এস কনসোর্টিয়াম ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত এ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আবুল হাসেম শেখ জানান, পৌরসভার চারটি পানি পাম্প থেকে এ পানি শোধানাগারে আসবে। তারপর দুই বার ক্যামিকাল দেওয়াসহ মোট ৬টি ধাপ শেষে এ পানি শোধন হবে। পানি শোধনের পর বর্জ পানি ড্রেনের মাধ্যমে অপসারন করা হবে। এই পাম্প থেকে ঘন্টায় সাড়ে তিন শত ঘন লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। নড়াইল পৌরসভার বর্তমানে যে চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে তিনগুন বেশী সাপ্লাই দিতে পারবে এই প্লান্ট।

নড়াইল পৌর এলাকার ভাদুলিডাঙ্গা গ্রামের শিমু বিশ্বাস জানান, কয়েক বছর যাবৎ শুনে আসছি নড়াইল পৌরবাসীকে বিশুদ্ধ খাবার পানি সাপ্লাই দেওয়া হবে। নির্মানের পর সামান্য কারনে দীর্ঘদিন যাবৎ শোধনাগাটি পড়ে রয়েছে। অথচ এটি চালু করার ব্যাপারে তেমন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা সরকার। বর্তমানে নড়াইল পৌরসভার পানিতে অতিরিক্ত আয়রণ এবং ময়লা। এ প্লান্ট চালু হলে পৌর এলাকার মানুষ বিশেষ নাগরিক সুবিধা পাবেন। তিনি আশা করেন কতৃপক্ষ দ্রুত এটি চালু করে পৌরবাসীকে বিশুদ্ধ খাবার পানির নিশ্চয়তা দিবেন।

নড়াইল পৌর এলাকার গৃহিনী সায়লা সারমিন জানান, বর্তমানে পৌরসভার সাপ্লাই-এর পানিতে অতিরিক্ত আয়রণ এবং ময়লা। এ পানি সাংসারিক ও নিত্য ব্যবহারের জন্যও উপযোগি নয়। তাছাড়া পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও ভালো নয়। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া আমাদের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার। শোধনাগারটি দ্রুত চালু করার দাবী জানান তিনি।

এলাকাবাসী জানান, নড়াইলের পানিতে অতিরিক্ত আয়রণ রয়েছে। এই পানি পান করে সাধরন মানুষের বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ হচ্ছে। নড়াইল সদর হাসপাতালের আরএমও মশিউর রহমান বাবু জানান, আয়রণ যুক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া, আমশাসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। এ পানিতে কাপড়ও নষ্ট হয়ে যায়। এ পানি পানেরও অযোগ্য। নড়াইলে পানি শোধনাগার হলে ধনী-গরীব সবাই এই বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পাবেন।

পাম্প হাউজ নির্মান করা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান শরীফ ট্রেডার্সের প্রোপাইটর শরীফ মহাম্মদ হোসেন জানান, নড়াইলে এত বড় প্রকল্পের কাজ হচ্ছে এটা আমাদের জন্য একটি সুখবর। প্রকল্পটি দ্রুত চালু না হওয়ার জন্য তিনি নড়াইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলি অফিসকে দায়ী করে বলেন, পাম্প হাউজের জায়গা নির্ধারন না করে এটির টেন্ডার করা ঠিক হয়নি। ২টি পাম্প হাউজ করার জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্ক অর্ডার দিলেও সময়মত জায়গা দিতে না পারায় তারা কাজ করতে পারেনি। যখন জায়গা দিয়েছেন তখন মালামালের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে তাই তাদের কাজ করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও জানান তিন বছর আগে একটি পাম্প হাউজ নির্মান করলেও এখনও তাদেরকে সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ করেননি।

প্রকল্পটি চালু না হওয়ার অন্যতম কারন বার বার নড়াইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলির নির্বাহী প্রকৌশলী পরিবর্তন হওয়া। প্রকল্পটি চলা অবস্থায় গত চার বছরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পরিবর্তন হয়েছে ১৪ বার। এর মধ্যে অনেক নির্বাহী প্রকৌশলি নিয়মিত অফিস করেননি। ফলে অফিসের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ দীর্ঘদিন আটকে থেকেছে।

নড়াইল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক এনামুল কবীর টুকু বলেন, নড়াইল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলি অফিসে বেশির ভাগ সময় নির্বাহীর পদ শুণ্য থাকে। নির্বাহী প্রোকৌশলী না থাকলে অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ থাকে। এই বিষয়ে তিনি জেলা সমন্বয় কমিটির মিটিং এ একাধিকবার আলোচনো করেছেন। তার অভিযোগ নির্বাহী প্রোকৌশলী ঘন ঘন পরিবর্তন হওয়াই এই প্রোকল্প চালু হতে বিলম্ব হচ্ছে।

প্রকল্প যখন শুরু হয় তখন নড়াইল পৌরসভার পৌর মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন বিএনপি নেতা জুলফিকার আলী মন্ডল। তিনি জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে সার্বিক ভাবে তিনি সহযোগিতা করেছেন। বাকি কাজ করার আগে একটি মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠিয়ে তার কাছ থেকে পৌর মেয়রের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়।

নড়াইল পৌরসভার বর্তমান মেয়র জাহাঙ্গীর বিশ্বাস বলেন, গত ২ বছর পূর্বে তিনি পৌরসভার দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। দায়িত্ব পাওয়ার কিছুদিন পর তার কাছে পাম্প হাউজ ও ড্রেন নির্মান করার জন্য জায়গা চায়। পৌরসভার কোন জায়গা না থাকায় তিনি জেলা প্রসাশকের সাথে কথা বলে জায়গার বিষয়টি সমাধান করেন। পানি শোধনাগার চালুর পর আমাদের কাছে হস্তান্তরের পর এর রক্ষনাবেক্ষন করব। প্রথম অবস্থান পৌরসভার ২৯ ৪৩ জন গ্রাহক এই বিশুদ্ধ পানির সুবিধা ভোগ করবে। তবে এর চাহিদা বাড়লে গ্রাহকও বৃদ্ধি পাবে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল গাফফার মোল্লা বলেন, প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে বর্জ পানি অপসারনের জন্য ড্রেন নির্মাণ করা হবে। এ জন্য সাইড নির্ধারন করা হয়েছে। অল্প দিনের মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হবে। এছাড়া ৪টি পাম্প হাউজের মধ্যে দুটি পাম্প হাউজ তৈরী করা হয়েছে বাকি দুটি পাম্প হাউজ দ্রুত নির্মান করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এটি চালু করার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, শোধনাগারটি চালু হলে ১৩ কিলোমিটার এলাকার মানুষ এ পানি ব্যবহারের সুবিধা পাবেন।

(আরএম/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test