E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আ.লীগের দুই নেতার হত্যাকারী কে এই শহিদুল ফকির?

২০১৮ অক্টোবর ০৪ ১৮:৩৭:৫৯
আ.লীগের দুই নেতার হত্যাকারী কে এই শহিদুল ফকির?

বাগেরহাট ও মোরেলগঞ্জ প্রতিনিধি : বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার দৈবজ্ঞহাটী ইউনিয়নে সোমবার বিকেলে আওয়ামী লীগ নেতা আনসার আলী দিহিদার ও যুবলীগ নেতা শেখ শুকুর আলীকে কুপিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যার পর আলোচনায় উঠে এসেছে ঐ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ফকিরের নাম। 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় পর পর দু’বার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া শহিদুল ফকির গত দশ বছরে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে তিনি নিজের ইউপি কার্যালয়কে টর্চার সেলে পরিণত করেছিলেন। শহিদুল ফকির ও তার সন্ত্রাসী সহযোগীরা ঐ দিন নিহতদের অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে শত শত মানুষের সামনে এই ইউপি কার্যালয়ের ভেতরে ফেলেই কুপিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেন।

ওই ঘটনার পরপরই পুলিশ অভিযান চালিয়ে ঐ টর্চার সেল থেকে শহিদুল ফকিরকে তার তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার করে। এ সময় সেখান থেকে শহিদুলের একটি বৈধ শটগানসহ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ৩টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৮ রাউন্ড গুলি ও একটি হাত কুড়াল উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে বাগেরহাট কারাগারে পাঠিয়েছে। ঐ ঘটনায় গুরুতর আহত দৈবজ্ঞহাটী ইউনিয়ন তাঁতীলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক বাবুল শেখ (৪২) ও নিহত আওয়ামী লীগ নেতা আনসার আলীর স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৪৫) এখন খুলনা ও ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বৃহস্পতিবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি।

শহিদুল ফকির এলাকায় স্থানীয় এমপি গ্রুপের নেতা হিসেবে পরিচিত। তবে শহিদুল ফকির তার সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিত্যাগ না করায় প্রায় ৬ মাস ধরে এমপি ডা. মোজ্জাম্মেল হেসেনের কাছে সে ভিড়তে পারতো না।

অন্যদিকে যে দুই নেতা খুন হয়েছেন, তার বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের এমপি’র প্রধান প্রতিদন্দ্বি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এইচ.এম বদিউজ্জামান সোহাগের খুব কাছে মানুষ।

আলোচিত এই খুনের ঘটনায় ভেঙ্গে পড়েছেন, বদিউজ্জামান সোহাগ ও এমপি মোজ্জাম্মেল। এলাকায় আলোচিত হচ্ছে এক ঢিলে দুই পাখি মারা’র মতো এদুই নেতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয় প্রত্যাশি তৃতীয় কোন নেতা কি এই খুনের নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন ?

তবে পুলিশ বলছে, মামলা হবার পর গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে খুনের প্রকৃত কারণ উদঘাটনসহ নেপথ্যের লোকজনের পরিচয় জানা সম্ভব হবে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পর শহিদুল ফকিরের ক্ষমতার উৎস্য ও তার প্রশ্রয়দাতাদের নিয়ে বাগেরহাটে তোলপাড় শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী, প্রাজ্ঞজন, সংবাদকর্মী ও সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে হালনাগাদ খোঁজ-খবর রাখা বিভিন্ন সূত্র থেকে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ফকির সর্ম্পকে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

শহিদুল ফকিরের উত্থানের নেপথ্য

স্থানীয়রা বলছেন, আশির দশকে শহিদুলের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিলো বাকশাল ছাত্রলীগের হাত ধরে। এ সময়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাকশাল ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ্যাড. আমিরুল আলম মিলনের সাথে। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় যুব সংহতিতে যোগ দেন এবং এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এর পর জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি হয়ে আওয়ামী লীগের ছাতার নীচে আশ্রয় নেন।

১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শহিদুল ফকির বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনে কাস্তে প্রতিকের সংসদ সদস্য প্রার্থী আমিরুল আলম মিলনের পক্ষে দলবল নিয়ে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালান। ঐ নির্বাচনে আমিরুল আলম মিলন জয়ী না হলেও আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহযোগী সাবেক মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজককে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীর কাছে পরাজিত করতে সক্ষম হন।

১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠণ করলে শহিদুল ফকির স্থানীয় বাগেরহাট-৪ আসনের তৎকালিন জামায়াত দলীয় এমপি মুফতি মাওলানা আব্দুস সাত্তারের প্রধান সেনাপতি হয়ে যান। এমপি সাত্তার তাকে একটি মাইক্রোবাস কিনে দেন। ঐ মাইক্রোবাসে দলবল নিয়ে তিনি মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতন চালান। এমনকি তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি’র নেতাকর্মীরাও শহিদুল ফকিরের হাত থেকে রক্ষা পাননি। শহিদুল ফকির মোরেলগঞ্জ উপজেলা বিএনপি নেতা আব্দুর মান্নান খানের পায়ের রগ কেটে দেয়া ও বাগেরহাট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি, ইউপি চেয়াম্যান আব্দুর রশিদ খান হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই শহিদুল ফকির আবার দল বদল করে জামায়াত ক্যাডার থেকে যুবদল নেতা হয়ে যান। দৈবজ্ঞহাটী ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতির পদটি বাগিয়ে নিয়ে এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সাধারন মানুষের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করেন।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে শহিদুল ফকির ভোল পাল্টে এবার আওয়ামী লীগের ছাতার নীচে আশ্রয় নেন। বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বাগেরহাট -৪ আসনের এমপি ডা. মোজ্জাম্মেল হোসেনের কাছের লোক হয়ে যান তিনি।

২০১০ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ডা. মোজাম্মেল হোসেন শহিদুল ফকিরকে দৈবজ্ঞহাটি ইউপি চেয়ারম্যান হতে সহযোগিতা করেন। তখনও তিনি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিগত সংসদ নির্বাচনে ডা. মোজাম্মেল হোসেনকে তিব্র প্রতিদ্বন্দিতায় ফেলে দেন দলের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী তৎকালিন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রহিম খান ও মোরেলগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পৌর মেয়র মনিরুল হক তালুকদার।

এ সময় শহিদুল ফকির দলবল নিয়ে এলাকায় ডা. মোজাম্মেলের পক্ষে কাজ করেন এবং ডা. মোজাম্মেল বিজয়ী হন। ডা. মোজাম্মেল বিগত ইউপি নির্বাচনে শহীদুল ফকিরকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দেন এবং তিনি বিজয়ী হন। তবে, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিত্যাগ না করায় প্রায় ৬ মাস ধরে এমপি ডা. মোজ্জাম্মেল হেসেনের কাছে সে ভিড়তে পারতো না শহিদুল ফকির। এমপি’র কাছ থেকে দূরে চলে যাওযায় অন্য কোন নেতার আশ্রয় খুঁজছিলেন তিনি।

বর্তমান সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগে কোন পদে না থেকেও দৈবজ্ঞহাটীসহ মোরেলগঞ্জ -শরণখোলা এলাকায় তিনি প্রভাবশালী ব্যাক্তি হয়ে ওঠেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর শহিদুর ফকির ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের মাছের ঘের, জায়গা জমি দখল, চাঁদাবাজি শুরু করেন। এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী মাদক সি-িকেট। তার নের্তৃত্ব মেনে না নেয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন তার নিত্যদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য তিনি ইউপি কার্যালয়, নিজের চিংড়ি ঘেরসহ এলাকায় চারটি টর্চার সেল তৈরী করেন।

চেয়ারম্যান শহিদুল ফকির ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা হারেজ আলী শেখকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে পায়ের রগ কেটে দেয়। বলাইবুনিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারন সম্পাদক জাহাংগীর, আলতি-বুরুজবাড়িয়া গ্রামের রোমান হাওলাদার, তেলিগাতি ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর, একই ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সভাপতি রনি খান ও শ্রমিকলীগের সভাপতি মো. আছাদকে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন।

(এসএকে/এসপি/অক্টোবর ০৪, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test