E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গাইবান্ধার চরাঞ্চল জুড়ে গরু ডাকাতি

২০১৪ জুলাই ১৭ ১৯:৪৬:২৪
গাইবান্ধার চরাঞ্চল জুড়ে গরু ডাকাতি

গাইবান্ধা প্রতিনিধি : হামার সহায় সম্পত্তি কিছুই নাই বাপো। এই জীবনে নদী ভাঙতে ভাঙতে সোগ শ্যাষ। কয়েকটা গরু পালিয়্যা জীবন চালাই। কথা গুলো ডাকাতের কাছে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের কাউয়াবাদা চরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্করের। ছেলে-মেয়েরা তার খোজ রাখেন না। গরু, ছাগল, আর কয়েকটা ভেড়া পালন করে কষ্টে শিষ্টে জীবন চালান তিনি। তার শেষ সম্বল গরুগুলোও রক্ষা করতে পারেন নি। সশস্ত্র ডাকাতদের পা ধরেও নিস্তার মেলেনি তার।

বাধা দিতে গেলে তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গোয়াল থেকে গরু, ছাগল ভেড়া সব নিয়ে যায় ডাকাত দল। একই দিনে প্রতিবেশী ময়নালেরও সব গরু ছাগল নিয়ে যায় ডাকাতরা। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে হুক হুক করে কেদে মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর সিদ্দিক (৬২) বললেন, বা গো আমার সোগ শ্যাষ বা গো। হামাক শেকের বেটি হাসিনার কাচে নিয়্যা যাও দুক্কের কতা তাকে কমো। যুদ্দ করি দ্যাশ সাদীন (স্বাধীন) করি হামার কপালোত এগলে জুটলো।

পহেলা রমজানের রাতে দুই নৌকায় করে সশস্ত্র ডাকাত দল তার বাড়ীর পাশে নৌকা থামিয়ে গোয়ালঘর থেকে জোর করে ৬টি গরু, ৩টি ছাগল ও ৫টি ভেড়া নিয়ে যায়। বাধা দিতে গেলে তাকে বেদম মারপিট করে ঘরে থাকা টাকা পয়সা যা ছিলো সব নিয়ে যায়। বার বার অনুরোধ করেও ডাকাতদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়পত্র ও ভোটার আইডি কার্ডটি দু’টি ফেরৎ পান নি বক্কর। এঘটনায় ফুলছড়ি থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ অভিযোগ না নিয়ে পরিচয় পত্র দু’টি হারিয়ে গেছে বলে থানায় জিডি নেয়।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা বক্কর নয়, ফুলছড়ি উপজেলার উজান ডাঙ্গা, কোচখালী, মানিক কর, কাউয়াবাদা, চর খাটিয়ামারীসহ গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি এ চার উপজেলার চরাঞ্চলের শান্ত জনপদগুলোতে এখন আতংকের অপর নাম গরু ডাকাতি। তিস্তা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রে পানি বাড়ার সাথে সাথে গাইবান্ধার নদী তীরবর্তী জনপদগুলোতে শুরু হয়েছে ডাকাতদের অত্যাচার। ডাকাতদের হাত থেকে গবাদী পশু ও সহায়-সম্বল বাচাতে রাত জেগে চর গুলোতে পাহারা বসিয়েছেন এলাকার মানুষ।

উজানডাঙ্গা চরের বৃদ্ধ এছাহাক আলী বলেন, কয়েকরাত হলো দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না ভাই। সবাই মিলে লাঠিসোঠা নিয়ে গল্পে গল্পে রাত কাটাই। কখন ডাকাত পরে সেই ভয়ে ঘুম আসে না। একই চরের মহির উদ্দিন (২২) বললো, চাচা আর কন না, এই তো পয়লা রোজার রাতে পাশের চর থাইক্যা দুই জনের ১৪ডা গরু নিয়্যা গেছে। বাই (ভাই) এই অভাগাগোর কতা কেউ শোনে না। চেয়ারম্যান কন মেম্বর কন কেউ হামার খোজ নেয় না। হামরা তো ইলিপ চাইনা বাই, ডাকাতিডা বন্ধ করুক তাতেই হামরা শান্তি।

এই যে সেদিন কাউয়া বাদা চরে বকর মিয়া আর ময়নালের ১৪ডা গরু নিয়্যা গেলো। ডাকাতগো কাছে হাতের (অস্ত্র) আছে গো বাই তাই আমগো আরো বেশী ডর লাগে। ততক্ষণে নৌকা থেকে নামার সময় হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার। উজান ডাঙ্গা ঘাটে নামার পর কয়েক গজ দুরে যেতেই একের পর এক টর্চের আলো। সবার হাতে হাতে লাঠি, কারো হাতে দা, ছোড়া, বটি। ডাকাত ঠেকাতে সবাই মিলে পাহারা বসিয়েছেন। কাউকে অপরিচিত ঠেকলে জিঙ্গাসাবাদ করছেন। সেখান থেকে আবার নৌকা করে মানিককর ও কাউয়াবাদা চরে গিয়েও দেখা গেল একই চিত্র। একই রাতে পাশের বাড়ীর ময়নাল মিয়াকে বেধে রেখে ৮টি গরু, ছাগল ও টাকা পয়সা নিয়ে যায়। ময়নাল মিয়ার স্ত্রীকেও জোর করে নৌকায় তোলার চেষ্টা করে ডাকাতরা।

উজান ডাঙ্গা চরের সমাজকর্মী শফিকুল ইসলাম বলেন, ডাকাতির সাথে পুলিশ এবং সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ সম্পৃক্ত থাকায় ডাকাতদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না।

চরের বাসিন্দা শফি মিয়া জানালেন, শুধু কাউবাদা চর বা মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর নয় গাইবান্ধার বিস্তির্ণ চরাঞ্চল জুড়ে দিন নেই রাত নেই ডাকাতদের অবাধ বিচরণ সাধারণ মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। কোন মহল থেকে সহযোগিতা না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিজেরাই ডাকাত প্রতিরোধে নেমেছেন তারা। রাত জুড়ে চরে চরে লাঠিসোঠা নিয়ে নারী, শিশু ও পুরুষরা পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন।

কোচখালী চরের জাহাঙ্গীর মিয়া জানালেন, কয়েকবার নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে নি:স্ব হওয়ার পর তারা গরু-ছাগল লালন পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গরুই চরের মানুষের একমাত্র সম্বল। তিনি বলেন, কষ্টকরে লালন পালন করার পর ডাকাতরা যদি এভাবে সব ছিনিয়ে নেয় তবে চরের মানুষদের বাচার আর কোন উপায় থাকবে না।

ডাকাতির অভিযোগ না নেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন ফুলছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ডাকাতি রোধে পুলিশি টহল জোরদারের পাশাপাশি মানুষকে সংগঠিত ও সচেতন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নৌ-যান, তেল ও জনবল সহ বিভিন্ন সঙ্কটের কারণে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হলেও পুলিশ থেমে নেই।

চরের দোকান্দার আজিজ মিয়া বলেন, দফায় দফায় ভাঙনে সবহারা এসব মানুষের খেয়েপড়ে বাচার একমাত্র অবলম্বন গরু। তাদের সেই গরুর উপর চোখ পড়েছে দুর্বৃত্তদের। নৌকা ঠেকিয়ে দিনে মাঠ থেকে আর রাতে গোয়াল শুন্য করে চলে যাচ্ছে ডাকাতরা। ডাকাতের ভয়ে মানুষ আর পশু এককাতারে বাস করলেও তাদের নিস্তার মিলছে না।

জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সাথে ডাকাতদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে জেলা পুলিশ সুপার মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, এক চরের সাথে আরেক চরের মানুষের বিরোধের কারণেই এসব ঘটনা ঘটে। তারপরও ডাকাতি রোধে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানালেন তিনি। গাইবান্ধা সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার বুকে ১শ’ ৬৫টি চর রয়েছে। এসব চরে প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস।


(এইচইবি/এটিআর/জুলাই ১৭, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test