E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রাণ ফিরে পেয়েছে সুন্দরবন, আত্মসমর্পণের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে বনদস্যুরা

২০১৮ অক্টোবর ২৪ ১৮:১১:৩৯
প্রাণ ফিরে পেয়েছে সুন্দরবন, আত্মসমর্পণের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে বনদস্যুরা

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : সুন্দরবন দাঁপিয়ে বেড়ানো দন্ডমুন্ডের কর্তা ২৯টি বনদস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণের পর ম্যানগ্রোভ এই বনে বইছে শান্তির সুবাতাস। পড়ছে না কোন লাশ। গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বনদস্যুদের সব ঘাঁটি। বনদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড এই বনের জীববৈচিত্র্য। জেলে-বনজীবীদের মুক্তিপনের দাবীতে অপহরণ বাণিজ্য এবং দেশী-বিদেশি চোরাকারবারীদের চাহিদা মতো হরিণ, বাঘ-কুমির শিকার ও পাচার প্রায় বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম লবণাক্ত জলাভূমির হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার- কুমির ও কিংকোবরাও হাফছেড়ে বেচেঁছে। সুন্দরবনে এখন থেকে-থেকে শোনা যায়না গুলির শব্দ। বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ। সুন্দরবনে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দেশী-বিদেশী ইকোট্যুরিষ্টের সংখ্যা বাড়ছে। সুন্দরবন ফিরে পেয়েছে তার প্রাণ। 

এদিকে বনদস্যু বাহিনীর ২৭৪ সদস্য আত্মসমর্পণের পর সরকারী ভাবে তাদের পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে আত্মসমর্পণ করা সকল বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা। এখন পরিবারের সাথে বসবাস করছেন। যা এক সময় ছিলো তাদের কল্পনারও বাইরে। তাদের আর পিছনের দস্যু জীবন নিয়ে ভাবতে হচ্ছেনা। কর্মক্ষেত্রে জড়িয়ে তারা সমাজের মূলশ্রেতধারায় মিশে গেছেন। তবে, সুন্দরবন এখনো পুরোপুরি বনদস্যু মুক্ত হয়নি। বনদস্যু সাত্তার ও শরিফ বাহিনীর নামে ছোট দুটি বাহিনী মাঝে-মধ্যে তাদেও তৎপরতা চালায়। এদুটি বাহিনীও সহসা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে বলে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু বাহিনীর একধিক প্রধান জানিয়েছেন।

সুন্দরবনের সম্পদ

জীববৈচিত্র্যের আধার পৃথিবীর বৃহত্তম লবণাক্ত জলাভূমির ম্যাগ্রেভ বন হচ্ছে আমাদের সুন্দরবন। দেশের মোট বনাঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশী ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবন। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন হচ্ছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের কটকার বাদামতলা সমুদ্র সৈকত থেকে দেখা যায় সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়। সুন্দরবনের রাত-দিন ২৪ ঘন্টায় ৬ বার তার রূপ বদলায়। সুন্দরবনের লবনাক্তভোজী প্রধান উদ্ভিত সুন্দরীসহ রয়েছে ৩৩৪ প্রজতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। রয়েছে বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়া হরিণ, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, লোনা পানির কুমির, কচ্ছপ ও কিং-কোবরাসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রানী। রয়েছে ৩১৫ প্রজাতির পাখি। সুন্দরবনের ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার জলভাগের নদ-নদীতে রয়েছে ইলিশসহ ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার।

১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো সুন্দরবনের ৩টি পর্যটন এলাকার ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর বনকে ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকে সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়ীয়া, কটকা, জামতলা, টাইগার পয়েন্ট, বাদামতলা সমুদ্র সৈকত, কচিখালী, দুবলা শুটকী পলøী, দোবেকী, কলাগাছিয়া, মান্দারবাড়ীয়া, হিণরপয়েন্ট- নীলকমল পর্যটন কেন্দ্রগুলো দেখতে দেশী-বিদেশী ইকোট্যুরিষ্টদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠিও কম নয়। সুন্দরবনের বনজীবীসহ নদ-নদীসহ বন উপকূলের বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আহরণের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ।

বনের নদ-নদীতে কুমির ও ডাঙ্গায় বাঘসহ কিংকোবরার আক্রমন মোকাবেলা করেই প্রতিবছর কয়েক লাখ জেলে-বনজীবী সুন্দরবন থেকে বৈধ পথে সম্পদ আহরণ করে থাকে। সুন্দরবনের জেলে-বনজীবীদের মুক্তিপনের দাবীতে অপহরণ এবং দেশী-বিদেশি চোরাকারবারীদের চাহিদা মতো বাঘ ও কুমির শিকার। কুমিরের চামড়াসহ বাঘের চামড়া, নখ, দাঁত, লিঙ্গ , মাংস ও হাড় মোটা অংকের বিনিময়ে তুলে দেয়া হতো পাচারকারীদের হাতে। আর এসব কারনে দ্রæত টাকা আয় করতেই সন্ত্রাসী গ্রæপগুলো সুন্দরবনে বনদস্যুতায় নেমে পড়তো।

সুন্দরবনের বনদস্যুতা

সুন্দরবনের বাঘ-কুমিরের চেয়েও জেলে-বনজীবীদের কাছে মুর্তিমান আতংকের নাম বনদস্যু। সুন্দরবন সুরক্ষায় বাগেরহাটের পূর্ব বিভাগ চাঁদপাই ও শরণখোলা এবং খুলনা পশ্চিম বিভাগের নলিয়ান ও বুড়িগোয়ালিনী এই ৪টি রেঞ্জের অধিনে রয়েছে ১৮টি ফরেষ্ট ষ্টেশন ও ৫৬টি টহল ফাঁড়ি। গোটা সুন্দরবনের দেখভালের জন্য রয়েছে মাত্র ৮৮৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। দূর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ লোকবল সংকটসহ দ্রতগতির জলযান, আধুনিক অস্ত্রের অভাবে সব বনরক্ষীরা নিজেরাই থাকতেন সব সময় বনদস্যু আতংকে। এই অবস্থার মধ্যে বিগত ৮৭ সাল থেকেই সুন্দরবনে বাড়তে থাকে বনদস্যুদের তৎপরতা। ওই সময়ে কবিরাজ বাহিনীর সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। পওে জেলে ও মৎস্যজীবী নেতাদের প্রতিরোধের মুখে বাহিনীর সদস্যসহ কবিরাজকে প্রান হারাতে হয়। এর পরও থেমে থাকেনি বনদস্যু বাহিনীর উত্থান।

লোকালয়ের প্রভাবশালী গডফাদারদের আশ্যয়-প্রশ্রয়ে নতুন-নতুন নামে বনদস্যু বাহিনী গঠন করে সন্ত্রসীরা সুন্দরবনসহ উপকূলের জেলে-বনজীবীদের র্টাগেট করে নেমে পড়ে মুক্তিপনের দাবীতে ‘বিনাপুঁজির ব্যবসা’ অপহরণ বানিজ্যে। এছাড়াও আন্ডাওয়ার্ল্ডে বাঘ-কুমিরসহ বন্যপ্রানী শিকার ও পাচার বাণিজ্যও রয়েছে। বনদস্যুদের প্রধান খাবার ছিল হরিণ। সুন্দরবনে এমন পরিস্থিতিতে অপ্রতিরোধ্য বনদস্যু বাহিনীগুলোকে দমনে পুলিশ, র‌্যাব ও কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্যরা চালাতে থাকে অভযান।

আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হয় বাহিনী প্রধানসহ অনেক বনদস্যু। আটক বনদস্যুরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে ফিরে যায় আবার পুরানো পেশায়। এরপর আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে বন্দুকযুদ্ধে মারা পড়তে থাকে অনেক বাহিনী প্রধানসহ বনদস্যুরা। উদ্ধার হয় কিছু আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ। এক-একটি বনদস্যু বাহিনী প্রধান বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর ওই বাহিনীর সদস্যরা আন্তকোন্দলে নতুন নামে একাধিক বাহিনী গড়ে তুলে সুন্দরবনে নেমে পড়ে। সৃষ্টি হতে থাকে নতুন-নতুন বনদস্যু বাহিনী।

এক একটি বনদস্যু বাহিনী সুন্দরবনের এক একটি এলাকার নিয়ন্ত্রন নিয়ে লোকালয় থেকে তাদের গডফাদারদের পাঠানো খাদ্য-পানি, অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ চেইন স্বভাবিক রেখে র্দূভেদ্য ঘাটি গড়ে তুলে চালাতে থাকে ফিশিং ট্রলার ও নৌকাসহ জেলে-বনজীবীদের আপহরণ। জেলে-বনজীবীদের আটক করে তাদের নির্যানের শব্দ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অপহৃতদের স্বজনদের শুনিয়ে হাতিয়ে নিতে থাকে মোটা অংকের টাকা। গোটা সুন্দরবন কার্যত বনদস্যুদের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়।

বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ শুরু যেভাবে

র‌্যাব ও কোস্টগার্ড এমন পরিস্থিতির মধ্যে সুন্দরবনে একাধিক স্থায়ী ঘাটি তৈরী করে বনদস্যু দমনে শুরু করে অলআউট অভিযান। সুন্দরবনে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনা প্রায় নিয়মিত হয়ে দাড়ায়। ১৭ বনদস্যু বাহিনী প্রধান ও সেকেন্ড ইন কমান্ডাসহ অসংখ বনদস্যু মারা যায়। র‌্যাব শক্ত অবস্থান নেয়ায় বিগত ২০১৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বনদস্যু বাহিনী প্রধানদের মধ্যে ‘প্রানভয়’ পেয়ে বসে। প্রান বাঁচাতে সুন্দরবন সন্নিহিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে থাকে সব থেকে বড় বনদস্যু ‘রাজু বাহিনী’র প্রধান রজুসহ অন্য বাহিনীগুলোর প্রধানরা। এই অবস্থার মধ্যেও সুন্দরবনে থেমে-থেম চলতে থাকে বনদস্যুদের তৎপরতা। প্রাণ বাঁচাতে আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে বনদস্যু বাহিনীগুলো। বিভিন্ন মাধ্যমে র‌্যাবের সাথে যোগাযোগ শুরু করে বনদস্যু বাহিনী প্রধানরা। বনদস্যু বাহিনীগুলো কি সত্যই আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক ? এমন দ্বিধা-দ্বন্ধ কাটিয়ে নিশ্চিত হয়েই মাঠ পর্যায়ের র‌্যাব কর্মকর্তারা বিষয়টি তাদের হেডকোয়ারের র্শীষ কর্মকর্তাদের জানায়।

র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ মন্ত্রণালয়ের র্শীষ কর্মকর্তাদের জানান। এরপর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ সমুদ্র উপকূলকে ‘দস্যুমুক্ত’ করতে সরকারের র্শীষ পর্য্যায় থেকে সবুজ সংকেত আসে। শুরু হয় মাঠ পর্যায়ে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রাথমিক কাজ। আত্মসমর্পন করতে আসলে বনদস্যুদের মেরে ফেলা হবেনা, সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিতে হবে। আত্মসমর্পনকৃত বনদস্যুদের নামে কোন হত্যা ও ধর্ষন মামলা না থাকলে আদালতের মাধ্যমে তারা দ্রুত ছাড়া পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা দেয়া হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে। র‌্যাবের কথা আস্থায় নিয়ে সরকারের বিশেষ ক্ষমার আওতায় প্রথমে আত্মসমর্পণে এগিয়ে আসে দুর্র্ধষ বনদস্যু ‘মাস্টার বাহিনী’ প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টারসহ তার বাহিনীর সদস্যরা। ২০১৫ সালের ৩১ মে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের ফুয়েল জেটিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে ৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৫ হাজার রাউন্ড বিভিন্ন প্রকার গোলাবারুদ জমা দিয়ে তার ৯ সহযোগিসহ দুর্র্ধষ বনদস্যু ‘মাস্টার বাহিনী’ প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার আত্মসমর্পণ করেন।

মাস্টার বাহিনী প্রধানের আত্মসমর্পণের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবার ঘটনা অন্যসব বনদস্যু বাহিনীর মধ্যে প্রভাব পড়ে। এরপর র‌্যার-৮ এর হাত ধরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে এক-একে ২৬টি বনদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ সুন্দরবনের ২৪৩জন বনদস্যু ও র‌্যাব-৬ এর হাত ধরে আত্মসমর্পণ করেন ৩টি বনদস্যু বাহিনীর প্রধানসহ ৩১জন বনদস্যু। এপর্যন্ত আত্মসমর্পণকরা সর্বমোট ২৭৪জন বনদস্যুর ৯০ ভাগের বাড়ী বাগেরহাটের মোংলা ও রামপাল উপজেলায়। আত্মসমর্পণকৃত সকল বনদস্যুই এখন কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।

আত্মসমর্পণ করা উল্লেখখযোগ্য বনদস্যু বাহিনীগুলোর প্রধানরা হচ্ছেন, মাস্টার বাহিনী প্রধান মোস্তফা শেখ, মানজার বাহিনী প্রধান মানজার সরদার, মজিদ বাহিনী প্রধান তাকবির বাগচী মজিদ, বড় ভাই বাহিনী প্রধান আবদুল ওয়াহেদ মোল্লা, ভাই ভাই বাহিনী প্রধান মো. ফারুক মোড়ল, সুমন বাহিনী প্রধান জামাল শরিফ সুমন, দাদা ভাই বাহিনী প্রধান রাজন, হান্নান বাহিনী প্রধান হান্নান, আমির বাহিনী প্রধান আমি আলী, মুন্না বাহিনী প্রধান মুন্না, ছোট শামছু বাহিনী প্রধান শামসুর রহমান, মানজু বাহিনী প্রধান মো. মানজু সরদার ও সূর্য বাহিনী প্রধান সূর্য। এসব বনদস্যু বাহিনীগুলোর আত্মসমর্পণের পিছনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মোহসীন-উল হাকিম ও নিউজ টুয়েন্টিফোর টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আশিকুর রহমান শ্রবন। সুন্দরবনে সুবাতাস বইতে থাকলেও এখনো বনদস্যু সাত্তার ও শরিফ বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ না করে মাঝ-মধ্যে জেলে-বনজীদের অপহরণ করছে।

অস্ত্রের খনি সুন্দরবন

আত্মসমর্পণের আগে সুন্দরবন ছিলো অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের খনি। থেকে-থেকে শোনা যেতো গুলির শব্দ। বাতাসে ভেসে বেড়াতো বারুদের গন্ধ। ২৯টি বনদস্যু বাহিনীর ২৭৪ সদস্য আত্মসমর্পণের সময় এলিট ফোর্স র‌্যাবের হাতে তুলে দেয় থ্রি-নট থ্রি রাইফেল, পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেল ও বন্দুকসহ বিভিন্ন প্রকার ৪০৪টি আগ্নেয়াস্ত্র। আর বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্রের গোলাবারুদ জমা দেয় ১৯ হাজার ১৫৩ রাউন্ড। আত্মসমর্পণের পর সুন্দরবনের বাতাসে নেই বারুদের গন্ধ। শোনা যায়না গুলির শব্দ।

বনদস্যুরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেত যেভাবে

আত্মসমর্পণকৃত একাধিক বনদস্যু বাহিনী প্রধানের সাথে কথা বলে তাদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের উৎস সম্পর্কে জানাগেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সমাজের ভদ্রবেশী গডফাদারাই বনদস্যুদের কাছ থেকে মোটা অংকের কমিশন নিয়ে চোরাবাজার থেকে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র-গোলাবারুদ সুন্দরবনে পৌঁছে দিতো। একজন বৈধ লাইসেন্সধারী যেখানে অস্ত্রের দোকান হতে ১ থেকে ২ শত টাকার মধ্যে টাকার মধ্যে পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেল ও বন্দুকের গুলি কেনা যায়, সেখানে বনদস্যুদের গোলাবারুদ কিনতে হতো চোরাবাজার থেকে অধিক মূল্য দিয়ে। তাদের এক-একটি বন্দুকের গুলি কিনতে হতো ১৫ শত থেকে ২ হাজার টাকায়। আর থ্রি-নট থ্রি রাইফেল ও পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেলসহ ক্ষুদ্র অস্ত্রের প্রতিটি গুলি কিনতে হতো ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। বন্দুক ও পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেলের অধিকাংশ গুলিই কেনা হতো আগ্নেযাস্ত্রের বৈধ লাউসেন্সধারী অসাধু ব্যক্তিদের কাছ থেকে। সুন্দরবনে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সাথে এক-একটি বন্দুকযুদ্ধে বনদস্যুদের ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার গোলাবারুদ খরচ হতো। এসব বন্দুকযুদ্ধের পর জরুরী প্রয়োজন মিটাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের কথিত শান্তিবাহিনী ও ভারত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনতো বনদস্যুরা। অর্ডার দিলেই চোরাবাজার থেকে চলে আসতো চাহিদা মতো আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ।

বনদস্যুদের আয়ের ভাগবাটোয়ারা

সুন্দরবনসহ উপকূলের জেলে-বনজীবীদের র্টাগেট করে নেমে পড়া বনদস্যুদের মুক্তিপনের দাবীতে অপহরণ বানিজ্যে এছাড়াও আন্ডাওয়ার্ল্ডেও চাহিদা মতো দেশী-বিদেশী চোরাকারবারীদের হয়ে বাঘ-কুমিরসহ বন্যপ্রানী শিকার ও পাচারও ছিল তাদের আয়ের প্রধান উৎস্য। তবে, বাহিনী প্রধানসহ অনেক সাবেক বনদস্যু সদস্যের সাথে কথা বললেও তারা কেউ হরিণ ছাড়া বাঘ-কুমির শিকার ও পাচারের সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও তা মানতে নারাজ সুন্দরবন বিভাগ। তারা বলছে, সুন্দরবন জুড়ে দাঁপিয়ে বেড়ানো বনদস্যু বাহিনীগুলোর কোন সহযোগিতা ছাড়া কারো পক্ষেই বাঘ-কুমিরসহ বন্যপ্রানী শিকার ও পাচার অসম্ভব। সুন্দরবনসহ উপকূলে তান্ডব চালিয়ে কোটি-কোটি টাকা আয় করতো বলে স্বীকার করেছেন বনদস্যু বাহিনীগুলোর প্রধানরা। এই আয়ের ৬০ ভাগ ব্যয় হতো শহর ও লোকালয়ে থাকা তাদের গডফাদারদ, অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ, খাদ্যসহ বাহিনী পরিচালনা, মাদ্রাসা-এতিমখানা, মসজিদ-মন্দির ও পূজায় দান-খয়রাতের পিছনে। বাকী ৪০ ভাগের ১০ ভাগ নিতো বাহিনী প্রধান। ৩০ ভাগ সমান ভাবে ভাগ করে দেয়া হতো সদস্যদের মধ্যে। ভারতে পালিয়ে যাওয়া সুন্দরবনের সব থেকে বড় বনদস্যু রাজু বাহিনী প্রধান রাজু সেখানে বিশাল সম্পদ গড়ে তুললেও অন্য বনদস্যু বাহিনীগুলোর প্রধানরা সম্পদশালী হতে পারেনি। তবে, এসব বনদস্যুদের গডফাদারা কোটি-কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে জানিয়েছেন আত্মসমর্পণকৃত অনেক বাহিনী প্রধানরা।

পূর্নবাসিত আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যুরা

আত্মসমর্পণের পর সকল বনদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকার তাদের পূর্নবাসনে এগিয়ে আসে। এক-একজন বনদস্যুকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১ লাখ, ট্রাস্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে ২০ হাজারসহ সর্ব মোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে ১টি করে মোবাইল সেট। প্রতিটি ঈদ উৎসবে দেয়া হয়েছে উপহার সমগ্রী। পূর্নবাসনের এই অর্থ সামান্য হলেও বনদস্যুদের এতে করে কোন ক্ষোভ নেই। আছে গুলি খেয়ে মারা না পড়ে বেচেঁ থাকার স্বস্থি। পরিবার নিয়ে বৈধ উপায়ে বেঁচে থাকার জন্য সবাই কোমরকষে পরিশ্রম করছেন। কেঊ দিয়েছেন মোটর পার্সের দোকান, কাঠের গোলা, মোটর গ্রারেজ, টি-ষ্টল। অনেকে করছেন ক্ষুদ্র ব্যাবসা ও মৎস্য খামার। আবার অনেকে অটো ও রিক্সা-ভ্যান কিনে নিজেই চালাচ্ছেন। কেউ বেকার বসে নেই। র‌্যাবের তদারকিতে থাকায় আত্মসমর্পণকৃত এসব বনদস্যুরা গ্রামীন সমাজের উটকো ঝামেলা থেকে অনেকটা মুক্ত রয়েছেন।

এখনো মামলা প্রত্যাহা হয়নি

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানগুলোতে একাধিক বার বলেছিলেন, বনদস্যুদের নামে কোন হত্যা ও ধর্ষন মামলা না থাকলে না থাকলে অন্যসব মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। এখনো এসব বনদস্যুদের নামে দায়েরকৃত ছোটখাটো মামলা প্রত্যাহার হয়নি। যাদের কারনে বনদস্যুতা বেঝে নিতে হয়েছিলো সুন্দরবনে থাকা অবস্থায় তাদের দেয়া সাজানো মামলায় আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যুদের এখনো আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলার বিষয়ে আত্মসমর্পণকৃত বনদস্যুরা দ্রুত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে চায়, সোমবার বাগেরহাট আদালতে মামলায় হাজিরা দিতে এসে এমনই দাবী জানালেন ‘মাস্টার বাহিনী’ প্রধান মোস্তফা শেখ ও ‘মানজার বাহিনী’ প্রধান মানজার সরদার।


মাস্টার ও মানজার বাহিনী প্রধান যা বললেন

বাহিনী প্রধানসহ এক-একজন বনদস্যু হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এক-একটি করে গল্প। সুন্দরবনের দুর্র্ধষ বনদস্যু মাস্টার বাহিনী প্রধান মোস্তফা শেখ ওরফে কাদের মাস্টার (৪৮) জানালেন, তারবাড়ী বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামে। ৯১ সালের পর রামপাল উপজেলা জুড়ে অন্যের ধানিজমি দখল করে চিংড়ি খামার করতেন এলাকার মাফিয়া ডন রাজ্জাক হালদার। ওই রাজ্জাক হালদার তাদের জমি দখলে নিতে অত্যাচার নির্যাতন শুরু করলে পরিবারসহ এলাকা ছাড়া হন তিনি। সরকার পরিবর্তনের পর এলাকায় ফিরে এলে আওয়ামী লীগ নেতা ও পেড়িখালী ইউপি চেয়াম্যান তাদের চিংড়ি খামারটি দখলে নিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে অন্য বনদস্যুদের সাথে সুন্দরবনে পাঠিয়ে দেয়। শুরু হয় বনদস্যু জীবন। এরপর গডফাদারের সাহায্যে অনেক আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রগ করে নিজে মাস্টার বাহিনী গঠন করে সুন্দরবনে তান্ডপ শুরু করেন।

কিংকোবরার ছোবল, বাঘ-কুমিরের হিংস্র থাবা ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর বুলেট সব সময় পিছনে তাড়া করলেও তা উপেক্ষা করে জেলে-বনজীবীদের অপহরণের মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকা মুক্তিপন আদায় করলেও নিজে কোটিপতি হতে পারেননি। প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয় তাড়া করায় পরিবার নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তিনিই প্রথম বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পর এখন তিনি স্ত্রী, স্কুল পড়ুয়া মেয়ে ও ১০ মাসের পুত্র সন্তান নিয়ে বাগেরহাট শহরে ভাড়া বাড়ীতে বসবাস করছেন। মোটর পার্সের দোকানসহ একটি গ্যারেজ দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

দোকানের আয় দিয়ে ভালই চলছে বলে জানিয়ে মাস্টার বাহিনী প্রধান মোস্তফা শেখ বলেন, এখন আমার পিছনে আর বুলেট তাড়া করে ফেরেনা। এখন পরিবার নিয়ে অনেক-অনেক ভালো আছেন দাবী করে আরও বলেন, এলাকায় প্রতিপক্ষের দেয়া মিথ্যা মামলার বিড়ম্বনা এখনো রয়েছে।

মানজার বাহিনী প্রধান মানজার সরদার (৪৬) বলেন, রামপালের পেড়ীখালী ইউনিয়নের রনজাইপুর গ্রামে তার বাড়ী। এলাকায় প্রতিপক্ষের দেয়া ষড়যন্ত্র মুলক মামলায় তিনি প্রথমে আসামী হন। পরে বনদস্যুদের এক গডফাদারের প্ররোচনা ও প্রতিশোধ স্পিহায় ১০ বছর আগে বনদসুতায় নাম লেখান। রাজু বাহিনী প্রধান ভারতে পালিয়ে গেলে তিনি নিজ নামে বনদস্যু বাহিনী গড়ে তোলেন। এবছরের জুনে তিনি বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পনের পূর্ব মুহুর্তে আস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনতে এলাকার ইউপি সদস্য রফিককে দেয়া তার ২ লাখ টাকা এখনো ফেরত পাননি। ওই টাকাটা পেলে আত্মসমর্পনের পর তার দেয়া কাঠের গোলাটি আরো ভালো করে চালাতে পারতেন। স্ত্রী লাকি বেগম, স্কুল পড়ুয়া ২ ছেলে-মেয়ে বাগেরহাটে বাড়া বাড়ীতে বসবাস করছেন। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বনদস্যুতা করে সামাজিক সুনাম নষ্ট হয়েছে- অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল হতে পারেননি। এনিয়ে এখন তার কোন ক্ষোভ নেই। পরিবারের সাথে স্বাভাবিক পরিবেশে বসবাস করতে পেরেই মহাখুশি মানজার বাহিনী প্রধান মানজার সরদার। এখন তাদের র‌্যাব সদস্যরা খোঁজখবর নেন বলেও জানান তিনি।

বনদস্যুর স্ত্রীর হবার বিড়ম্বনা

বনদস্যু মাস্টার বাহিনী প্রধান মোস্তফা শেখের বাগেরহাটের ভাড়া বাসায় বসে কথা হয় তার স্ত্রী হাসি বেগমের (৩৫) সাথে। তিনি বলেন, স্বামীর বনদস্যু হবার কারনে পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছ থেকে বহুদিন তাকে নানা ধরনের কটু কথা শুনতে হয়েছে। জিজ্ঞেস করতো স্বামী বাড়ী আসে না কেন ? প্রতিবেশীরা এমন নানা প্রশ্ন করে বিব্রত করতো। অপরিচিত জনদের আমি বলতাম স্বামী ব্যবসা করে, তাই তাকে বাইরে-বাইরে থাকতে হয়। আইন-শৃংখলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদতো ছিলোই। নিকট আত্মীয় স্বজনেরা পর্যন্ত তাকে এড়িয়ে চরতো। দূরে দূরে থাকতো। আমার মেয়ে মিম প্রশ্ন করতো সবার আব্বু বাড়ীতে আসেনা কেন, আব্বু আমাদের সাথে থাকে না কেন ? আমি মেয়েকে কোন জবাব দিতে পারতাম না। বনদস্যুর বউ হওয়া ছিলো আমার নিত্যদিনের বিড়ম্বনা। এখন আমি ভালো আছি- সুখেই আছি। সইতে হচ্ছেনা কোন বিড়ম্বনা।

(এসএকে/এসপি/অক্টোবর ২৪, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test