E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টাঙ্গাইলে যমুনার ঘাটে ঘাটে ইলিশের হাট

২০১৮ অক্টোবর ২৫ ১৭:৩৭:১৮
টাঙ্গাইলে যমুনার ঘাটে ঘাটে ইলিশের হাট

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ হলেও যমুনার সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে টাঙ্গাইল অংশের জেলেরা মানছেনা। দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় যমুনা পাড় ও নদীতে প্রশাসনের তৎপরতা কম থাকায় মা ইলিশ নিধন চলছে দেদারছে। মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন নদীতে মা ইলিশ ধরা বন্ধে ছোট খাটো কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করলেও তা ইলিশ নিধন বন্ধে কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।

রাতে ও দিনে জেলেরা যমুনা নদীতে অবাদে কারেণ্ট জাল দিয়ে মাছ ধরছে। প্রতিদিন গড়ে টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুরের ছলিমাবাদ, ভূঞাপুর ও কালিহাতী উপজেলার বঙ্গবন্ধুসেতু এলাকার যমুনা থেকে প্রায় ২০ থেকে ২৫ টন মা ইলিশ ধরা হচ্ছে। জেলেরা অভিযোগ করেন নদীতে ইলিশ মাছ ধরতে নৌ পুলিশ ও মৎস্য কর্মকর্তাদের টাকা ও মাছ দিতে হয়।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল থেকে যমুনার ভাটিতে নাগরপুরের ছলিমাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার নদী জুড়ে মা ইলিশ ধরা হচ্ছে। এরমধ্যে ভূঞাপুর উপজেলার নিকরাইল, গোবিন্দাসী, চর ভূঞাপুর, মাটিকাটা; কালিহাতী উপজেলার বঙ্গবন্ধুসেতু সংলগ্ন গড়িলাবাড়ি, বেলটিয়ার মুকতলা, আলীপুর; সদর উপজেলার চরপৌলী, কাকুয়ার চর, গয়নাহোসেন, হুগড়া, বেগুনটাল, সাতানী হুগড়া, দক্ষিন হুগড়া, দুলবাড়ি, আলোকদিয়া, চকগোপাল, খোসাইল, মামুদ নগর, বোয়ালকান্দি; নাগরপুর উপজেলার ছলিমাবাদ ইউনিয়নের যমুনা পাড়ের চৌহালী প্রভৃতি এলাকার ২২-২৩টি পয়েণ্টে অস্থায়ী ইলিশের হাট বসানো হয়েছে। কয়েকটি হাটে প্রতিদিন ভোরে ১৮-২০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়। এ ছাড়া নদী পাড়ের বাড়ি বাড়ি ফেরি করেও মা ইলিশ বিক্রি করা হয়।
জেলেরা প্রতিদিন যমুনা নদী থেকে গড়ে ১৬ থেকে ১৭ টন মা ইলিশ মাছ ধরছে। পরে ইলিশগুলো কয়েকটি পয়েণ্টে সাধারণ মানুষ ও মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি করছে মাত্র দুইশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকায়।

এছাড়াও সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার বেলুর চর এলাকায় শত শত নৌকাযোগে জেলেরা ইলিশ নিয়ে সেখানে বিক্রি করছে। যমুনা নদীতে মা ইলিশ ধরা ও বিক্রি বন্ধে মৎস্য বিভাগ ও নৌ পুলিশ নানা প্রতিকূলতার কারণে সীমিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের আফজালপুর গ্রামটি যমুনা কর্তৃক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ওই এলাকার মানুষের মূল পেশা মাছ ধরা। তারা মা ইলিশ ধরে যমুনার পূর্বপাড়ের বিভিন্ন পয়েণ্টে বিক্রি করছে। এছাড়া নাগরপুরের পশ্চিমাঞ্চল ছলিমাবাদ এলাকায় জেগে ওঠা যমুনার চর সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার সীমান্ত হওয়ায় টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ ও জেলা- উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয় এবং স্থানীয় মৎস্য বিভাগ কোন ব্যবস্থা নিতে পারছেনা। অপরদিকে, সিরাজগঞ্জের এলাকা হলেও যমুনা ওই এলাকাকে আলাদা করে রেখেছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সমস্যাসঙ্কুল হওয়ায় সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন বা চৌহালী উপজেলা প্রশাসন ওই এলাকায় কোন অভিযান পরিচালনা করতে পারেনা।

যমুনা চরের বেশ কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভূঞাপুরের নিকরাইল থেকে নাগরপুরের ছলিমাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীপথ জুড়ে নতুন পুরনো মিলিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি মাছ ধরা নৌকা রয়েছে। নাগরপুর অংশে রাতে নৌকা নামাতে প্রতি নৌকা বাবদ ১০ থেকে ১৮ হাজার টাকা ও খাওয়ার জন্য মাছ প্রশাসনের লোকদের দিতে হয়। এ কারণে অভিযানের খবর আগে থেকে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এছাড়া মৎস্য সমিতির মাধ্যমে নৌকা প্রতি এক থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা তুলে স্থানীয় কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের দিতে হয়। ওপর মহল ম্যানেজ করেই জেলেরা যমুনা নদীতে মাছ ধরছে। জেলেদের অতিলোভ ও অসতর্কতার কারণে প্রশাসনের অভিযানে মাঝে মধ্যে জাল ও মাছ ধরা পড়ে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এ বছর প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরা বন্ধে ৫১টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনা, এলাকার ৬৫১টি বাজারে অধিদপ্তরের উদ্যোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া ৯টি মাছঘাট, ৯৩১টি আড়ত, এক হাজার ৪৫০টি বাজার পরিদর্শন করা হয়েছে। অভিযানে ৪.১৬৩মে.টন ইলিশ জব্দ করে এতিমখানা ও মাদ্রাসায় বিতরণ, ৪ লাখ ১৯ হাজার ১২ মিটার জাল জব্দ করে আগুনে পুড়ানো হয়েছে। এ সময়ে মা ইলিশ ধরার অভিযোগে ৫৭টি মামলা দায়ের ও ৮৯ হাজার ৭০০টাকা জরিমানা আদায় এবং ৪০জনের বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড দেয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বেলুর চরে মাছ বিক্রি করতে আসা জেলেরা জানায়, মাছ ধরা নিষিদ্ধ জেনেও পেটের দায়ে মা ইলিশ ধরে বিক্রি করছেন। সরকারিভাবে অর্থ সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও তারা পায়নি। এছাড়া মাছ ধরতে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের টাকা ও মাছ দিতে হয়। অনেক সময় প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে নদী থেকেই মাছ জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়।

কালিহাতীর গোহালিয়াবাড়ীর আফজালপুর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক জানান, আফজালপুর পুরো গ্রামটাই নদীর মধ্যে। এখানকার সবমানুষই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। সরকারিভাবে কোন অর্থসহায়তা তারা পায়নি। মেম্বার হিসেবে সবাইকে তার সহযোগিতা করতে হয়। ইলিশ মাছ ধরা বন্ধের জন্য যদি সরকার আগে থেকে জেলেদের আর্থিক সহায়তা করত তাহলে যমুনা নদী থেকে মা ইলিশ ধরা বন্ধ হত।

টাঙ্গাইল অঞ্চলের নৌ-পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সহকারী পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির আকন্দ জানান, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ ধরা বন্ধে যমুনায় নৌ পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। গত ৭ অক্টোবর(রোববার) থেকে বৃহস্পতিবার(২৫ অক্টোবর) পর্যন্ত ২১জনকে গ্রেপ্তার, ৫০১.০০০ মিটার জাল আটক পূর্বক পুড়ানো, ২১৩ কেজি মাছ জব্দ করে এতিম খানায় বিতরণ এবং ২১জনকে বিভিন্ন অংকে মোট ৯৮ হাজার ৩০০টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, এ বছরই প্রথম যমুনা নদীকে ‘ইলিশ জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম বছর হওয়ায় নদীতে অবৈধভাবে জাল ফেলানো বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাওয়া যায়নি। যমুনার ঘাটে ঘাটে ইলিশের হাট সম্পর্কে তিনি জানান, ভ্রাম্যমান আদালত ও নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে কোন কোন এলাকা অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় সেখানে যাওয়া যাচ্ছেনা। তারপরও যমুনায় মা ইলিশ ধরা বন্ধে জেলা মৎস্য অফিসের উদ্যোগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, মৎস্য কর্মকতা এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ে নানা অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আগামি ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

(আরকেপি/এসপি/অক্টোবর ২৫, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test