E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুন্দরবন এখন স্ক্র্যাপ জাহাজের ভাগাড়, ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারে উদ্যোগ নেই

২০১৮ অক্টোবর ৩০ ১৫:৪৯:০১
সুন্দরবন এখন স্ক্র্যাপ জাহাজের ভাগাড়, ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারে উদ্যোগ নেই

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবন এখন স্ক্র্যাপ জাহাজের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। একের পর এক ডুবছে পণ্যবোঝাই লাইটার জাহাজ। সুন্দরবনে নদীতে পণ্যবোঝাই লাইটারেজ জাহাজ ডুবির ঘটনা আগে থেকে ঘটলেও ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এসে জাহাজ ডুবির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। সাড়ে ৩ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম সংরক্ষিত এই বনের নদীতে তলা ফেটে ডুবেছে পণ্যবোঝাই ১০টি লাইটার জাহাজ। ডুবে যাওয়া এসব জাহাজে থাকা ফার্নেস অয়েল, সার, কয়লা, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল কিঙ্কার, স্লাগ, জিপসান পানিতে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে বনে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে ম্যানগ্রোভ এই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। ডুবে যাওয়া অনেক লাইটার জাহাজ উত্তোলন না করায় দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে সুন্দরবনের নদ-নদী।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ জানায়, ১৯৯৪ সালের আগস্টে সুন্দরবনের কাছে পশুর চ্যানেলের বানিশান্তা এলাকায় একটি তেলবাহী জাহাজ ডুবে গেলে প্রথম বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে সুন্দরবন। ২০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তেল। এরপর ১৯৮৮ সালের ১ জুলাই মোংলা বন্দরের কাছে একটি তেলবাহী লাইটার কার্গো জাহাজ দুর্ঘটনায় পশুর চ্যানেলে তেল ছড়িয়ে পড়লে সুন্দরবন আবারও বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। একই বছরের ১০ আগস্ট সুন্দরবনের মাজহার পয়েন্টে অপর একটি তেলবাহী লাইটার কার্গো দুর্ঘটনায় পড়ে উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনে।

২০১৪ সালের সেপ্টম্বরে এসে জাহাজ ডুবির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পূর্ব সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ৬৩০ মেট্রিক টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল নিয়ে তলা ফেটে ডুবে যায় লাইটার জাহাজ ‘এমভি হাজেরা-২’। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পূর্ব সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ৬০০ মেট্রিক টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল নিয়ে তলা ফেটে ডুবে যায় লাইটার জাহাজ ‘এমভি নয়ন শ্রী- ৩’।

একই বছরের ২৪ নভেম্বর পূর্ব সুন্দরবনের হরিনটানা এলাকায় তলা ফেটে ডুবে যায় তিন তলাবিশিষ্ট যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি শাহীদূত’। একই বছরের ৯ ডিসেম্বর পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শ্যালা নদীতে তলা ফেটে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ডুবে যায় ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের একটি অয়েল ট্যাংকার। সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নদ-নদী ও বনের প্রায় ৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে সুন্দরবন। এ ঘটনা দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই সময়ে ম্যানগ্রোভ এই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ছুটে আসতে হয় খোদ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেলদের।

এরপর ২০১৫ সালের ৫ মে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের মরাভোলা নদীতে তলা ফেটে ডুবে যায় ‘এমভি জাবালে নূর’ নামের সার বোঝাই একটি লাইটার জাহাজ। সুন্দরবনের নদীর পানিতে গলে ছড়িয়ে যায় ৫০০ মেট্রিক টন পটাশ সার। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীতে তলা ফেটে ডুবতে-ডুবতে অন্য একটি লাইটার জাহাজের সহয়তায় মোংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয় আরও একটি কয়লা বোঝাই লাইটার জাহাজ। ওই একই বছরের ২৭ অক্টোবর সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে তলা ফেটে ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় ‘এমবি জিয়ারাজ’ নামের একটি লাইটার জাহাজ।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শ্যালা নদীতে ১ হাজার ২৩৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে তলা ফেটে ডুবে যায় ‘এমভি সি হর্স-১’ নামের একটি লাইটার জাহাজ। ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের মোহনায় ১ হাজার টন কয়লা বোঝাই লাইটার জাহাজ ‘এমভি আইচগাতি’ ডুবোচরে ধাক্কা খেয়ে তলা ফেটে ডুবে যায়। একই বছরের ৫ জুন সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ৮২৫ মেট্রিক টন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল স্লাগ নিয়ে তলা ফেটে ডুবে যায় ‘এমভি সেবা’ নামের অপর একটি লাইটার জাহাজ। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল ভোরে মোংলা বন্দর চ্যানেলের পশুর নদীর হারবাড়িয়ায় সুন্দরবনের মধ্যে ৭৫০ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই একটি লাইটার জাহাজ ‘এমভি বিলাস’ ডুবে যায়।

সুন্দরবনে প্রতিটি জাহাজ ডুবির পর বন বিভাগের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উঠে আসে সুন্দরবনের নদ-নদীর মূল চ্যানেল না চিনে জাহাজ চালানো, ফিটনেসবিহীন স্ক্র্যাপ (মেয়াদোত্তীর্ণ) জাহাজের চলাচল, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালকদের কারণে সুন্দরবনে ডুবোচরে জাহাজ উঠিয়ে দেওয়ায় স্ত্র্যাপ জাহাজগুলোর তলা ফেটে দুর্ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে ডুবে যাওয়া অনেক লাইটার জাহাজ উত্তোলন না করায় দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে সুন্দরবনের নদ-নদী।

সুন্দরবন গবেষক ও সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যনেল ও নদ-নদীতে স্ক্র্যাপ (মেয়াদোত্তীর্ণ) জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করায় ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড এই বনের নদ-নদী এখন ডুবন্ত জাহাজের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিনি গত বছর ইউনেস্কোর বার্ষিক সভায় গৃহীত ‘সুন্দরবন সুরক্ষায় কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা’ দ্রুত করতে সরকারের কাছে দাবি জানান।

খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে জলভাগে এভাবে পণ্যবোঝাই লাইটার জাহাজ ডুবির কারণে জাহাজের পণ্য দ্রবীভূত হয়ে ম্যানগ্রোভ এ বনের পানি দূষিত হচ্ছে। এর ফলে সুন্দরবনের কয়েকশ প্রজাতির মাছসহ জলজ-বণ্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর এ কে এম ফারুক হাসান বলেন, সুন্দরবন রক্ষাসহ মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ছড়িয়ে পড়া তেল জাতীয় পদার্থ দ্রুত অপসারণের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ‘পশুর ক্লিনার-১’ নামে নিজস্ব বর্জ্য অপসারণকারী জাহাজ কিনেছে। মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে ডুবে যাওয়া জাহাজ উত্তোলনের সক্ষমতা সম্পন্ন ভাসমান ক্রেন কেনার প্রক্রিয়া চলছে।

(এসএকে/এসপি/অক্টোবর ৩০, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test