E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৯ দিনের শিশু বিক্রি : মায়ের কোল কী ফিরে পাবে ফাতেমা?

২০১৮ নভেম্বর ২০ ১৮:৩৩:১৮
৯ দিনের শিশু বিক্রি : মায়ের কোল কী ফিরে পাবে ফাতেমা?

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : “মাত্র ৯দিন বয়সেই মায়ের কোল থেকে বিক্রি হওয়া শিশু ফাতেমা কি মায়ের কোল ফিরে পাবে? নিজের মাকে মা বলে ডাকতে পারবে? ভাই বোনের সাথে বড় হতে পারবে? কি অপরাধ করেছিলো শিশু ফাতেমা” এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে। 

বলছিলাম কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি পাইকপাড়া এলাকায় জন্মের ৯দিনের মাথায় কন্যা শিশু বিক্রি করে দেওয়ার মতো লোমহর্ষক সেই ঘটনার কথা। পর পর তিন কন্যা সন্তানকে জন্ম দেওয়ায় স্ত্রীকে তালাক দিয়ে মাত্র ৯দিনের কন্যা শিশুকে বিক্রি করেন রবিউল ইসলাম।

জানা যায়, দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের হযরত আলীর ছেলে রবিউল ইসলাম একই এলাকার রেজাউল হকের মেয়ে জেসমিনের সাথে গত ১০ বছর আগে বিয়ে হয়। এর আগে জেসমিনের আরেক স্থানে বিয়ে হয়। বিয়ের দুই মাসের মাথায় রবিউল ইসলামের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে জেসমিন। তারপর দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। বাধে সুখের সংসার। তাদের ঘর আলোকীত করে আসে সালেকী নামের এক মেয়ে। তারপর কয়েক বছর পরে আবারো মায়া নামের এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় জেসমিন।

পর পর দুই কন্যা সন্তান হওয়ায় তার উপরে নেমে আসে নির্যাতন। চলতি বছরেই জেসমিনের গর্ভের আসে আরো একটি সন্তান। এই নিয়ে স্বামীর সাথে শুরু হয় মনমানিল্য। রবিউল দাবী করেন, জেসমিনের গর্ভের তৃতীয় সন্তান তার নয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একাধীকবার বাবার বাড়ীতে চলে আসে জেসমিন। এর মধ্যে পার্শ্ব এলাকার এক গৃহবধূর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে রবিউল। বিয়ে করে ঘরে তুলে আনে। আবারো বাধে পারিবারিক অশান্তি। এরই মাঝে গত ৭ নভেম্বর আরেকটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় জেসমিন। এই নিয়ে তিনটি কন্যা সন্তানের জন্য দেয় সে। এই অপরাধে ৯ দিনের শিশুকেসহ তাকে তালাক দেয় তার স্বামী রবিউল।

গত শুক্রবার (১৬ নভেম্বর) স্থানীয় ইউপি সদস্য শরিফুল, মাতব্বর শহিদুল ইসলাম এবং খলিসাকুন্ডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরীয়ান আসলামের সহযোগিতায় শালিশি বৈঠক করে রবিউল। সেখানে তার সদ্য সন্তান প্রসব করা স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার কথা বলে। পরে তাকে তালাক দিয়ে দেয়।

তবে স্ত্রীকে তালাক দিতে তার দেনমোহরের টাকা দিতে হবে। রবিউল পেশায় একজন কৃষক। টাকা কোথায় পাবে সে। তাই মা জেসমিনের কোল থেকে শিশু কন্যাকে মাতব্বর শহিদুল ইসলামের সহায়তায় কেড়ে নেয় রবিউল। শিশুটিকে বিক্রি করে দেয় ঈদগাহ পাড়ার আয়ূব আলীর কাছে। এ ঘটনার পর শিশুটিকে হারিয়ে ভেঙ্গে পড়ে জেসমিন।

জেসমিন জানান, আমার স্বামী জোর করে আমার কোল থেকে আমার বাচ্চাকে কেড়ে নিয়েছে। শুনেছি তারা শিশুকে ১ লক্ষ্য ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। আমি আমার মেয়েকে ফেরত চাই।

তিনি আরো বলেন, যারা আমার কোল থেকে আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে তাদের বিচার চাই।

জেসমিনের বাবা রেজাউল হক বলেন, বিয়ের পর আমার মেয়ের ২টা মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়। কিছুদিন আগে আবার একটি মেয়ে জন্ম দেয়। এর জন্য আমার মেয়েকে তালাক দেয় রবিউল। আমার মেয়েকে বিনা অপরাধে সে তালাক দিয়েছে। সে বলে ফাতেমা তার সন্তান না। কিন্তু পরে আবার তার সন্তান বলে আমার ৯ দিনের নাতনি ফাতেমাকে কেড়ে নিয়ে গেছে। সে ফাতেমাকে বিক্রি করে দিয়েছে পাশের গ্রামে।

তিনি আরো বলেন, আমি গরীব মানুষ তাতে কোন কষ্ট নেই আমি আমার নাতনি ফেরত চাই প্রয়োজনে আমি ভিক্ষা করে আমার নাতনিকে মানুষ করবো।

ফাতেমার বড় বোন সালেকী জানায়, আমার ছোট বোনকে আমার বাবা আরেকজনের কাছে বেঁচে দিয়েছে। সেদিন আমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গেছে। ফাতেমা কোথায় আমি জানি না।

রেজাউলের প্রতিবেশি নাসরিন ও রোজিনা বলেন, যেদিন বাচ্চাটা মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেয় সেদিন খুব কান্নাকাটি করেছিলো জেসমিন। তবে বিচারে কেউ তার কথা শোনেনি। তার বাচ্চাটাকে তার বাবা বিক্রি করে দিয়েছে। বাচ্চাটার বয়স মাত্র কয়েকদিন। সে মায়ের দুধ পাচ্ছে না। সে কি আদৌ মাকে ফিরে পাবে?
এদিকে মঙ্গলবার (২০ নভেম্বর) রবিউলের বাড়ীতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রবিউলের মা জানান, আমি আমার ছেলেকে অনেকবার নিষেধ করেছি তবে সে শোনেনি। শুনেছি বাচ্চাটা আয়ূব নামের একজনকে দিয়ে দিয়েছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। বিচারে আমি ছিলাম না।

স্থানীয় মাতব্বর শহিদুল ইসলাম জানান, দুই পরিবারের মধ্যে একটা মনোমানিল্য ছিলো। আমরা সেটা ২ লাখ টাকার বিনিময়ে দফা রফা করে দিয়েছি।

শিশুটির ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাচ্চা আছে। আমরা বিক্রি করে দেয়নি।

খলিসাকুন্ডি ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি শুনেছি শালিশের মাধ্যমে মাত্র ৯দিনের বাচ্চাকে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। তবে কত টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে আমি সেটা জানি না। এবং কিভাবে তার তালাক হলো সেটাও জানি না। তবে এটা ঠিক হয়নি। এটা একটা অপরাধ।

এ ঘটনার জেসমিনের বাড়ীতে উপস্থিত থাকা দৌলতপুর থানার ওসি তদন্ত আজগার আলী বলেন, আমাদের কাছে কেউ কোন অভিযোগ করেনি। অভাব অনটন ও পারিবারিক অশান্তি এবং পর পর তিনটি মেয়ে হওয়ায় তাকে তালাক দিয়ে দেয়। এবং বাচ্চাটি নিয়ে যায়। আমি রবিউলের বাড়ীতে গিয়ে দেখি সবাই পালিয়েছে।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, বাচ্চাটিকে তারা ফুপুর কাছে রেখেছিলো। তবে এখন কোথায় জানিনা। তবে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবে শুনেছি।

দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জানান, কোন শিশুকে বিক্রি করে দেওয়ার কোন নিয়ম নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(কেকে/এসপি/নভেম্বর ২০, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test