E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৩৫ বছরেও জোটেনি আশ্রয়স্থল, ছয় শতাধিক পরিবারের মানবেতর জীবনযাপন 

২০১৮ নভেম্বর ২৪ ১৫:৫৮:৫১
৩৫ বছরেও জোটেনি আশ্রয়স্থল, ছয় শতাধিক পরিবারের মানবেতর জীবনযাপন 

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : সাগরের বুক চিড়ে জেগে ওঠা পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কাউয়ার চর ও গঙ্গামতিতে বসবাস করা ছয় শতাধিক পরিবারের দীর্ঘ ৩৫ বছরেও জোটেনি নিজস্ব মাথা গোঁজার বসত ঘর। 

বালু চরে ঝুপড়ি তৈরি করে বছরের পর বছর ধরে তারা প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে এ চরে বসবাস করলেও তাদের মেলেনি কোন স্বীকৃতি। বরং ভূমি অফিসের যোগসাজসে ভূমি দস্যুরা এ চর বন্দোবস্ত নিয়ে বিক্রি করে দিলেও চরের বাসিন্দাদের মিলছে না আশ্রয়স্থল। সরেজমিনে চরাঞ্চল ঘুরে চরের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসে তাদের মানবেতর জীবনযাপনের করুণ চিত্র।

দুই ছেলে সোহরাব ও আফজাল হোসেনকে নিয়ে বিধবা মনোয়ারার সংসার। ছেলেরা ভাড়াটে হোন্ডা চালক। ১৩ বছর আগে স্বামী আব্দুল হানিফ মারা গেছে। চাষের কোন জমি নেই। শুধু বাড়ি-ঘর করার জায়গা রয়েছে। ৫০ শতক বেলাভূমে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা লাগিয়েছেন। করছেন সবজির আবাদ। ৩৫টি বছর গঙ্গামতির এই চরে বসবাস করছেন মনোয়ারা বেগম। সরকারের খাঁস জমিতে তিন যুগ ধরে বাস করলেও আজ পর্যন্ত জমির কোন মালিক হতে পারেন নি। পারেণ না এক শতক জমিতে চাষাবাদ করতে।
মনষাতলী গ্রামের স্বামীর বাড়িঘর ছেড়ে এই চরে আশ্রয় নিয়েছিলেন মনোয়ারা।

তিনি জানালেন, নিজের নামে, স্বামীর নামে কয়েকবার খাস জমির বন্দোবস্ত চেয়ে আবেদন করেছেন। এজন্য খরচ হয়েছে কয়েক হাজার টাকা। কিন্তু জমি জোটেনি। ভয়াল সিডরে বুক সমান পানি সাতরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছেন। বাড়িঘর সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। দুই বান্ডিল টিন ও ঘর তোলার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন সরকারের পক্ষ থেকে। তা দিয়ে আবার জোড়াতালি দিয়ে ঘরটি ঠিক করেছেন।

একই দৃশ্য সালাহউদ্দিন ও তহমিনা দম্পতির। চার সন্তান নিয়ে ছয় জনের সংসার। চরের বেলাভূমে ছয় বিঘা জমিতে আমনের চাষ করেছেন। ফলনও পেয়েছেন বাম্পার। ভূমি অফিসকে খাস কালেকশনের খাতে একর প্রতি তিন থেকে চার শ’ টাকা দিতে হয় । তারপরেই কাটতে হয় ধান। এ দম্পতি সাত বছর আগে চরটিতে আবাস গড়েছেন। অনেক কষ্টে মানুষটি সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন।

প্রায় ৩৫ বছর এই চরে বাস করছেন মোহাম্মদ তৈয়ব আলী। বৃদ্ধ বাবা ইউনুছ আলী হাওলাদার ও মা তাজিনুর বেগম, দুই ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ছেলেরা টমটম চালায়। মা তাজিনুর কয়েক বছর আগে অসুস্থ হয়ে এখন প্রতিবন্ধী। তিন বছর আগে বছর এক একর জমিতে আমনের চাষ করেছেন। জমির দখল নিয়ে যেন যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। জোদ্দার হারিচ মেম্বার তার ১৩টি গরুনিয়ে গেছে। মামলা দেয়া হয়েছে। হাজতবাস করতে হয়েছে। কিন্তু জমির মালিকানা জোটেনি আজও।

আশরাফ আলীর বয়স এখন ৪৫ বছর। জানালেন, তার জম্ম এই চরে। বাবা হাসেম সরদার ১০ বছর আগে মারা গেছেন। মা মারা গেছে আট বছর আগে। স্ত্রী সুফিয়া বেগম ও দুই ছেলে আর তিন মেয়েকে তার সংসার। জানালেন, তাদেরকে জমি চাষ করতে না দিলেও জোতদাররা অন্তত দুই শ’ একর জমি দখল করে রেখেছেন। তাদের কাছ থেকে আবার একসনা রেখে তরমুজের আবাদ করেন এই তারা।

এভাবে গঙ্গামতির এই চরটিতে অন্তত ছয় শ’ পরিবারের বসবাস। যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করছেন এসব মানুষ। ধানসহ রবিশস্যের আবাদ করছেন। কিন্তু চরের জমির দখল তারা পাচ্ছেন না। কারও এক চিলতে জমির মালিকানা জোটেনি। নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারার মাধ্যমে চৌহদ্দি দিয়ে রেখেছেন বাড়ির চারদিকে। সেখানে ধানসহ ফলায় রবিশস্য। এজন্য ভূমি অফিসের তহশিলদারকে খাস কালেকশনের নামে টাকা দিতে হয়। ধান পাকলেই তহশিল থেকে ক্ষেতের মধ্যে লাল পতাকা টানিয়ে দেয়া হয়। রবিশস্যের মৌসুমেও এর ব্যত্যয় ঘটেনা।

বিশেষ করে তরমুজ আবাদের সময় বিপুল পরিমাণ টাকা দিতে হয় এসব হতদরিদ্র পরিবারের। বেড়িবাঁধের বাইরে ঝড়-জলোচ্ছ¡াসে চরম ঝুঁকি নিয়ে মানুষগুলো বসবাস করে আসছেন। কারণ তাদের জীবিকার পথ সাগরে মাছ শিকার করে। মূল পেশা জেলে। কর্মস্থল খুব কাছে হওয়ায় ঝুকি থাকা সত্ত্বেও বসতি গেড়ে আছেন মানুষগুলো। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসকালে এদের আশ্রয়ের জন্য কারিতাস নির্মিত একটি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। যেটিতে মাত্র পাঁচশ মানুষ আশ্রয় নিতে পারলেও আর কোন উপায় নেই। ওই সাইক্লোন শেল্টারটি আবার চরের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নেয়ার একমাত্র অবলম্বন। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ রয়েছে সেখানে। কারিতাসের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটিতে তাদের নিজস্ব শিক্ষক রয়েছে।

গোটা চরটিতে বসবাস করা মানুষের অভিযোগ তারা এক একর জমির বেশি চাষাবাদ করতে পারেন না। কিন্তু বাইরের প্রভাবশালী কয়েকটি চক্র অন্তত এক শ’ বিঘা জমি তাদের দখলে রেখেছে। এরা সবাই প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের কথিত নেতা, ভূমিদস্যু। বহুবার এসব খাস জমি বন্দোবস্ত চেয়ে এরা আবেদন করেছেন। দাললসহ, কথিত রাজনৈতিক দলের নেতা ও ভূমি অফিসের লোকজন প্রত্যেকের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

জানা যায়, ১৯৯৮ সালে গঙ্গামতি এলাকা পর্যটন পলøী হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। এরপরে ওই এলাকার দীর্ঘদিন পর্যন্ত এসব মানুষের বসবাসের জন্য আবাসন ব্যারাক করার পরিকল্পনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ফলে কাউয়ার চর ও গঙ্গামতির ছয়শ দরিদ্র পরিবারের আবাসনের স্থায়ী সমাধান হয়নি।

(এমকেআর/এসপি/নভেম্বর ২৪, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test