E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

মুখে হাসি, চোখে জল

২০১৮ ডিসেম্বর ০১ ১৪:২৪:২০
মুখে হাসি, চোখে জল

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : বয়স ৮ হলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় স্কুলে ভর্তি হতে পারণি আট বছরের ফারজানা। গত এক বছর ধরে মায়ের কোলে করে পাশ্ববর্তী গ্রামের একটি স্কুলে প্রাক প্রাথমিকের ক্লাস করে বর্ণমাল শিখেছে সে। কাঁপা কাঁপা হাতে এখন লিখতেও পারে। নতুন বছর স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে স্কুল ব্যাগ। ব্যাগ পেয়ে খুশিতে আপ্লুত ফারজানার হাসিমুখ দেখে আনন্দ অশ্রুর ঢল নেমেছে তার অসহায় মা লাইজু বেগমের। এ ফরজানার মতো একশ অসহায় দরিদ্র শিশু শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে স্কুল ব্যাগ ও ছাতা এবং পঞ্চাশ জন দরিদ্র অসহায় মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নতুন কম্বল। 

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বালিয়াতলী ইউনিনের গ্রাম সামাজিক শক্তি কমিটির আর্থিক সহায়তায় এবং ব্রাকের টিইউপি কর্মসূচীর উদ্যোগে গত বুধবার (২৮ নভেম্বর) বিকালে এক অনুষ্ঠানে নতুন শিক্ষাবর্ষ ও শীতের শুরুতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ শিক্ষাসামগ্রী ও কম্বল পেয়ে যেন সবাই আপ্লুত।

“আমরা সবাই সবার” এ শ্লোগান নিয়ে গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সহায়তায় কাজ করছে সেচ্ছাসেবী এ সংগঠন গ্রাম সামাজিক শক্তি কমিটি। আটটি কমিটিতে বিভক্ত হয়ে ব্যাক্তি উধ্যোগে পিছিয়ে পড়া মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী করতে কাজ করছে কমিটির সদস্যরা। তাদের সহায়তা করছে উন্নয়ন সংস্থা ব্রাক।

প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেয়া ফারজানা দুই পা সোজা হয়ে দাড়াতে পারছে না। হাতের আঙ্গুলে কলম ভাঁজ লিখতেও পারে না। আদো আদো মিষ্টি স্বরে কথা বললেও অণ্য শিশুদের মতো উচ্চস্বরে পড়তে কিংবা দৌড়াতে পারে না। উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের দিনমজুর ফারুক খলিফার দুই সন্তানের বড় ফারজানা তাই গ্রামের অণ্য শিশুদের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে। আর্থিক দৈণ্যতায় চিকিৎসা খরচ জোগাতে গিয়ে বয়স আট পেড়িয়ে গেলেও তাই স্কুলে ভর্তি করা হয়নি ফারজানাকে।

ফারজানার মা লাইজু বেগম বলেন, পাশের বাড়ির পোলামাইয়ারা যহন স্কুলে যায়, তহন ফারজানা চাইয়া থাহে। শরীরে শক্তি নাই যে ও একা একা ঘর থেকে বের হবে। মেয়ের লেখাপড়ার ইচ্ছা দেখে পাশের গ্রামের এনজিও পরিচালিত একটি স্কুলে প্রাকে ভর্তি করছি। রোজ সকালে কোলে কইর‌্যা অরে স্কুলে দিয়া আই। ছুটি হইলে স্যারেরা ফোন দিলে আবার যাইয়া নিয়া আই। মাইয়াডা এ্যাহন অ আ ক খ ল্যাকতে পারে। কলম ধরতে কষ্ট হয় ওর। আস্তে আস্তে সবই পারে। তাই এইবার অরে স্কুলে ভর্তি করমু।
তিনি বলেন, গরীব মানুষ,চিকিৎসা করাইতে করাইতে সবশ্য্ষা। হারাদিন গায়ে খাইট্রা আর কয় টাহা পায় অর বাবা। নিজের জায়গা জমি নাই। শ্বশুড় বাড়ির ভিটায় একটা ঝুপড়ি কইর‌্যা থাহি। মাইয়াডা স্কুলে যাইবে তাই অরে এই ব্যাগটা দেওয়ায় খুব খুশি। কিন্তু আমি যহন অসুস্থ্য থাহি তহনতো ফারজানারে স্কুলে লইয়া যাইতে পারি না। মাইয়াডা বড় হইতেছে। কয়দিন আর কোলে কইর‌্যা টানতে পারমু জানি না। স্কুল ব্যাগ তো পাইছে এ্যাহন যদি একটা কেউ হুইল চেয়ার দেতো হ্যালে ঠেইল্যা লইয়া যাইতে পারতাম।

নয় বছরের জাকিয়া এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। রোগে আক্রান্ত না হলে আজ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো। স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়া মায়াবী মুখের জাকিয়ার বয়স যখন চার তখনই এখন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। শরীর থেকে চামড়া,মাংস খসে পড়তে শুরু করে। ষারা গায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। উপজেলার মাঝেরপাড়া গ্রামের জামান হাওলাদারের দুই সন্তানের ছোট জাকিয়াকে তিনটি বছর ধরে বিভিন্ন হাসপাতালেও ডাক্তারের কাছে ছুটতে ছুটতে বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া।

জাকিয়ার মা সালমা বেগম বলেন, মাইয়াডার শরীরের ঘা শুকাইয়া যাওয়ায় এই বছর অরে মাঝেরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টুতে ভর্তি করছি। আগে তো অর ধারে কাছে কেউ যাইতো না। গামলা ভইর‌্যা ওর গায়ের চামড়া গোসত হালাইতাম। বিছানায় থাকতো। চিকিৎসা করাইতে করাইতে অর বাবা এ্যাহন নিঃস্ব।

তিনি বলেন, মাইয়াডা ল্যাহাপড়া করতে চায়। বড় মাইয়া সুমা এ্যাহন এইটে পড়ে। বড় বুইনে পড়ে আর ও পড়বে না এইয়া কী হয। কষ্ট হইলেও যেদিন সুস্থ্য থাহে স্কুলে লইয়া যাই। আইজ গ্রাম সামাজিক শক্তি কমিটি থেকে একটা ছাতা পাইছি। এতেই খুশিতে আপ্লুত জাকিয়া।

জাকিয়ার ভাষায়, রোজ স্কুলে যামু আমি। একদিন ডাক্তার হইয়া সবাইরে বিনা টাকায় চিকিৎসা করামু। যাতে রোগে ভুইগ্যা আমার মতো আর কেউ যাতে কষ্ট না পায়। কিন্তু বাবা-মায়তো গরীব আমারে চিকিৎসা করাইবে না পড়াইবে এ কথা বলে তার মায়াবী মুখে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ছলছল করতে থাকে চোখ।

এ জাকিয়া ও ফারজানার মতো স্কুল শিক্ষার্থী মোরসালিন, আরিফা, শাহীন, রাহাত, আদুরীর মতো একশ শিক্ষার্থী পেয়েছে নতুন স্কুল ব্যাগ ও ছাতা এবং রেখা,শহরভানু,হোসনেয়ারার মতো অর্ধশত দরিদ্র মায়ের হাতে পেয়েছে শীতের কম্বল। এ শিক্ষা উপকরণ ও শীত বস্ত্র পেয়ে তাদের মুখে ছিল হাসি ও চোখে খুশির অশ্রু।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্রাক পটুয়াখালীর আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক তপন ভৌমিক ও সেক্টর স্পোলিষ্টক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সামজই পারে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে নিয়ে আসতে। শিক্ষায় অগ্রসর ও দারিদ্রতা জয় করতে পারলে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীই একদিন নেতৃত্ব দিবে।
তুলাতলী গ্রাম সামাজিক শক্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষক আকতারুজ্জামান বলেন, তাঁদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্ঠায় এই শিশু ও দরিদ্রদের মুখে যে হাসি ফুঁটে উঠেছে তা দেখে তারা আরও বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ভভিষতে তাঁদের এ কর্মকান্ড অব্যাহত থাকবে।

বালিয়াতলী ইউপি চেয়ারম্যান এবিএম হুমায়ুন কবির বলেন, দরিদ্র পরিবারের শিশুরা শিক্ষার আলোতে আলোকিত হলে ওই পরিবার একদিন আলোকিত হবে। সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সহায়তায় গ্রাম সামাজিক শক্তি কমিটির সদস্যরা যেভাবে এগিয়ে এসেছে তাতে গোটা বালিয়াতলী একদিন শিক্ষার আলোতে আলোকিত হবে। তিঁনিও এ কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

(এমকেআর/এসপি/ডিসেম্বর ০১, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test