E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গণধর্ষণের ইন্ধনদাতা রুহুল আমিনের উত্থান যেভাবে

২০১৯ জানুয়ারি ০৪ ১৪:১৩:৫৫
গণধর্ষণের ইন্ধনদাতা রুহুল আমিনের উত্থান যেভাবে

স্টাফ রির্পোটার, নোয়াখালী : নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের গ্রামীন জন পদে রুহুল আমিন এক আতংকের নাম। রামগতি চর অঞ্চলের এক সময়ের ভয়ানক লাঠিয়াল খোরশিদ আলম এর ছেলে এই রুহুল আমিন। তার বাবা ছিলেন একজন ধুরন্ধর লাঠিয়াল । ও ব্যাগা চরের বেচু হত্যা মামলার মূল আসামি। ১৯৮০ দশকে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার সীমানা বিরোধে বেচু খুন হয়েছিল। 

জানা যায়, রুহুল আমিনের বাবা হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর পরিবারের অর্থনৈতিক ভাবে অসহায় হয়ে পড়েন। সে হারিছ চৌধুরী বাজারে রাহিম হোটেলের বয় এর কাজ নেয়। সেখানে কিছু দিন কাজ করার পর রুহুল আমিন জেলা শহর মাইজদীর মোবারক মিয়ার বাসায় কাজ করতো। কাজ করার সুবাদে ঐ বাসার পাশে নোয়াখালী ইউনিয়নের হাই স্কুলে পড়া লেখা করে এসএসসি পাস করে। সেখান থেকে সুবর্ণচর উপজেলার পাংখার বাজারে সততা নামে একটি স্থানীয় এনজিওতে চাকুরী নেয়। ওই এনজিও থেকে ৭০ হাজার টাকা চুরি করে ঢাকা চলে যায়। ঢাকার কাওরান বাজারে পাইকারী সবজি দোকানে কাজ নেয়। সেখান থেকেও বেশ মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করে আত্মগোপনে বরিশাল চলে যান।

পরে মোবারক মিয়ার ছোট ভাই এডভোকেট আতাউর রহমান নাছের এর সহায়তায় সে জেলা জজকোর্টে আইনজীবি সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। এই সুবাদে রুহুল আমিন এলাকার লোকজনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে ও তার আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। সেখান থেকে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগে যোগ দিয়ে ওয়ার্ড সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ নং চরজুবলী ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তিতে তাকে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক করা হয়। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পূর্রে সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন সাধারণ ভুমীহীন ।

এলাকাবাসী জানান, ২০০১ সালে রুহুল আমিন বিএনপি জামাতের রাজনিতির সাথে জড়িত ছিলেন, বিএনপি সরকার ক্ষমতা হারানোর পর পল্টি নিয়ে নিজের সুবিধাভোগ করার জন্য আওয়ামী লীগে যোগদেন । ২০১১ সালে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর রুহুল আমিন তার বাবার মত এলাকায় বিভিন্নভাবে অপরাধের রাজত্ব সৃষ্টি করে। সে বনদস্যু ও জলদস্যুদের সংগঠিত করে রুহুল আমিন বাহিনী নামে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে। তার বাহিনী দেখবাল করত হাসান আলী রুলু। ২০১১-২০১৬ সাল পর্যন্ত তার সময়ে এই জন পদে ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করায় ফের ২০১৬ সালের ইউপি নির্ববাচনে এলাকার জনরোষে পড়ে। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী খলিল উল্যার সাথে নির্বাচনে হেরে যান। সদস্য না হলেও সদস্যর দাপট দেখিয়ে তার অপকর্ম অব্যহত রাখে সে।

সরেজমিনে দেখা য়ায়, হারিছ চৌধুরী বাজার – রামগতি সড়কের পাংখার বাজার থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে তার নাম গড়ে তোলা হয়েছে রুহুল আমিন নগর। একটু এগিয়ে গেলে দেখা যায় খালের উপর একটি সেতু হয়ে প্রশস্ত একটি সড়ক । সড়কের পথ ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যায় এটি কোন জনপথ নয়। এটি এক সময় এর ভূমিহীন রুহুল আমিনের বিলাসবহুল বাড়ীর প্রবেশ পথ। আর একটু এগিয়ে দেখা গেল বাড়ির দরজা থেকে পুরো উঠোন পাকা। উঠোনের দুই পাশে ইটের তৈরী বিল্ডিং । এখানে থাকেন তিনি। ডানে রয়েছে পুকুরের আলিশান ঘাট। পূর্ব দিকে দেখা গেল ফুলের নার্সারী। বাড়ীর চতুর্দিকে রয়েছে ৬ টি হ্যালোজেন লাইট। বড় বড় দুটি সরকারী সোলার প্যানেল।

কথা হয়, বাড়ির কেয়ারটেকার রাকিব হোসেনের সাথে সে জানায় ৬/৭ বছর যাবত এই বাড়িতে আছেন। তখন তার মালিক রুহুল আমি পূর্ব দিকের নার্সারী জাগায় একটি ছোট টিনের ঘরে থাকত। ২০১১ সালের দিকে সে এই ঘরটি নির্মান করেন।

তার সাথে কথা বলার সময় তার প্রথম স্ত্রী শিরীন আক্তার জানায়, ঘরটি ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হওয়ার পূর্বে লোন নিয়ে তৈরী করছে পরে লোন পরিশোধ করা হয়েছে । সে আরো জানায়, তার স্বামী ৩ বছর আগে এক মক্কেল মামলা নিয়ে এলে স্বামীকে ডির্ভোস দিয়ে তাকে বিয়ে করে। কিছু দিন জেলা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। এখন সাহেবের হাট বাজারের উত্তর পাশে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। তবে, তার নাম জানাতে পারেননি তিনি।

এলাকাবাসী তার ভয়ে মুখ খুলতে নারাজ। কিছুটা আশ্বস্ত করা হলে প্রতিবেশী সামছুন্নাহার ও শিল্পি জানান, রুহুল আমিন বাহিনীর ভয়ে তারা সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। রাতবিরাতে তারা ঘর থেকে বের হতে পারেনা।

তারা আরো জানায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত না হওয়ায়, এলাকার শতশত নারী তাহজ্জহতের নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা সিদ্দিক মিয়া জানান, সরকারী জায়গার উপর তার নামে রয়েছে রুহুল আমিন নগর। সেখানে সে সরকারী জায়গা দখল করে তৈরী করছে দোকান এবং দোকান বানিয়ে বিক্রয় করে। রাস্তার উপর সবুজ বনায়নের বড় বড় গাছগুলো বিক্রয় করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। রুহুল আমিন নগরের পশ্চিমে একরাম নগরে বিভিন্ন মৎস প্রকল্পে এবং রাস্তার পাশে খাস জমির দখল নিয়ে মোটা অংকের টাকা নেয়। আমিন উল্যা ভুলু , আবদুল হকের জমি দখল করে এ বছর একটি ব্রিকফিল্ড চালু করছে। এই ছাড়াও তার নামে বেনামে ১০/১৫ একর জমি রয়েছে।

তিনি বলেন, এলাকার জায়গা-জমি কেনা বেচা করতে হলে তার বাহিনীর সদস্য হাসান আলী রুলু, জসীম, সাহাবুদ্দিন, দুলাল, তাজল, জনু মাঝি, ফারুক মাঝি ও নূর মোহাম্মদ ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে। ভূমিহীনদের খাস জমি ক্রয়-বিক্রয় করতে হলে তাকে পয়সা দিতে হয়। তা না হলে কেনা বেচা বন্ধ।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, মাদকেও রয়েছে তার একটি চক্র। স্বপন, সোহাগ এবং সোহেল তার ইয়াবা এবং গাঁজা বিক্রয় করেন ও সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছেন আবদুর রবের ছেলে হোসেন ড্রাইভার। প্রায় ১ বছর আগে চরজব্বর থানা পুলিশ হোসেন ড্রাইভারের ভাই আমিন ব্যাপারীকে উয়াবা সহকারী গ্রেফতার করে। আদালতে সোপর্দ করে। সে জামিনে রয়েছে। যার মামলা এখন চলমান। এদের মাধ্যমে তিনি তার মাদক ব্যবসা করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান জানান, ২০০১ সালে জসীমের বাবা জয়নাল আবেদিন থেকে ৬৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। ২০১৪ সালে তার জমি উপর জয়নালেরর ছেলে জসিমকে ঘর তৈরী করে দেয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে সালিসের নামে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা জমা নিয়ে ঘর ভেঙ্গে দেয়। কিন্তু তাকে সে টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ২০১৭ সালে একরাম নগর এলাকায় মোঃ কুট্টির গরু, মোঃ জালাল বর্গা পালন করতো । গরু চুরি করে মোমিন ও রাসেদ কিন্তু গরু চুরি ধরা পড়ে, তখন রুহুল আমিন মোমিনকে মারধর করে। মোমিনের স্বীকারোক্তি দেয়। আরো ২/৩ জনের নাম বলেন, পরে বিভিন্ন সময় চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জহির, নূরনবী, মোমিন ও রাসেদ এর জায়গা জমি ঘরবাড়ি বিক্রয় করে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা আদায় করেন । তিনি আরো জানান বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নামে এলাকাবাসীর প্রায় ১০ লক্ষ টাকা আদায় করে। কিন্তু সংযোগ এখন পর্যন্ত পায়নি।

কামাল মাঝি জানান, তিনি মোঃ অলি থেকে জমি ক্রয় করেন। ওই জমি থেকে তাকে বেদখল করে ২ লক্ষ টাকা নিয়ে তার দখল বুঝিয়ে দেয়। ভুলু নেতার জামাই জানান, প্রভাব দেখিয়ে তার শ্বশুরের জমি চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়ে তার বায়রা আবদুর রহমান আজাদ এবং তার থেকে ৩ লক্ষ টাকা তার স্থানীয় সমিতির বাজার তার শ্বশুরের দোকান ভিটি থেকে ৩ লক্ষ টাকা প্রদান করেন। কিন্তু এখনো সেই জমি কোন নিস্পত্তি করেনি এবং জমি চাষ বন্ধ করে রেখেছেন।

চর জব্বর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ উদ্দিন জানান এই সমস্ত অভিযোগ আগে কখনো শুনেননি।

উল্লেখ্য, এই রুহুল আমিন নোয়াখালী সুবর্ণচরে গত ৩০ ডিসেম্বর রাতে গণধর্ষনের ঘটনার মূল ইন্ধনদাতা।

(আইইউএস/এসপি/জানুয়ারি ০৪, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test