E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরায় কলেজ শিক্ষক বিপ্লব শেখের হত্যা রহস্য

২০১৪ জুলাই ২১ ১০:০৯:৪৫
সাতক্ষীরায় কলেজ শিক্ষক বিপ্লব শেখের হত্যা রহস্য

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দোহার গ্রামের শেখ শের আলী। একই প্রতিষ্ঠান তালা’র জালালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুবাদে দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক মুক্তিযোদ্বা স.ম আলাউদ্দিন শের আলীর বাড়িতে থাকতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী  স.ম আলাউদ্দিন বন্ধু প্রতীম শের আলীর ছোট ছেলের নাম রাখেন এসএম বিপ্লব কবীর। দেড় মাস বয়সে পিতৃহারা হন বিপ্লব। একই বছরে মারা যান বিপ্লবের চাচা নওশের আলী শেখ। বড় বোন নার্গিস ও ভাই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন বিপ্লব। এ সূযোগে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে শের আলী ও নওশের আলীর অধিকাংশ জমি জবরদখল করে নেন ভাই মোকছেদ আলী। দোহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ট্যালেন্টপুলে প্রাথমিক বৃত্তি লাভ করে বিপ্লব। ১৯৮৬ সালে নার্গিসের স্বামী উপজেলার শিবপুর গ্রামের আবু জাফর তালা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে বিপ্লবকে ও নবম শ্রেণীতে জাহাঙ্গীরকে ভর্তি করান।

দোলা ভাই এর চেষ্টায় তালা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে ২০০১ সালে অনার্স মাস্টার্স করে ২০০২ সালে শালিখা ডিগ্রী কলেজে গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় বিপ্লব। ছাত্রজীবনে ছাত্রদল ও ২০১০ সালে জালালপুর ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারন সম্পাদক হিসেবে বিপ্লব দায়িত্ব পান। ১০১১ সালে তাকে তালা উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

১৯৮৮ সালে বাবার জমি জালিয়াতির কথা বলায় চাচা মোকছেদ আলীর ছেলেরা বিপ্লবকে পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। ১৯৯০/১৯৯১ সালে মাঠ জরিপে জবরদখলীয় জমি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ায় বিপ্লব তার চাচাত ভাই মোজাম, তোজাম, শাহীন, মাহমুদও মিলনের প্রতিপক্ষ ও দুশমন হয়ে ওঠে। বেদখলীয় ১৪ বিঘার মধ্যে ১১ বিঘা ফিরে পায় বিপ্লব। এরই জের ধরে ২০০৬ সালে বিপ্লবকে আজু হত্যা মামলায় জড়ানো হয়। পরের বছর দোহার গ্রামের তারক দাস হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পুলিশের গোয়েন্দা, অপরাধ ও তদন্ত কর্মকর্তার পূণঃতদন্তে তাকে অব্যহতি দেওয়া হয়। এরপর প্রভাবশালী প্রতিপক্ষরা তাকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়। ২০০৭ সালে তারক দাস হত্যা মামলায় জেলে থাকার সময় মোজাম শেখ ও তোজাম শেখের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাতক্ষীরা শহরের নারকেলতলা এলাকার সন্ত্রাসী বসির আহম্মেদের। এরপর থেকে বিপ্লবকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়। সম্প্রতি পুলিশ ও সন্ত্রাসী ভাড়া করে বিপ্লবকে হত্যার জন্য ২০ লাখ টাকা বাজেট করে বিডিআরের হেডকোয়ার্টার পিলখানা থেকে ঔষধ চুরি করে বিক্রির সময় বরখাস্ত হওয়া প্যারা মেডিকেল ডাক্তার সাইদুল ইসলাম মিলন ও মোকছেদ শেখের ছেলেরা।

এ ব্যাপারে বাড়িতে গেলে কেউ কথা বলতে রাজি না হওয়ায় শাহীন শেখকে ০১৭২১-৭৬১১৪৮ নম্বর ও সাইদুল ইসলাম মিলনকে ০১৭৭৯-৬৫৬৭৯৩ নম্বর মোবাইলে পাওয়া যায়নি। তবে তাদের পক্ষে তালা বাজারের ব্যবসায়ি দোহার গ্রামের ডাঃ মাহমুদুল শেখ বিপ্লব শেখের পরিবারের সদস্যদের সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন।

যেভাবে কার্যকর করা হয় বিপ্লবের মৃত্যু

সরেজমিনে শনিবার দুপুরে তালার দোহার গ্রামে জাহাঙ্গীর ও তার মা হালিমা বেগম জানান,‘২০১০ সালের নভেম্বর মাসে শাকদাহ ব্রীজের কাছে বিপ্লবকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০১১ সালে আজু হত্যা মামলায় হাজিরা দিতে এসে প্রতিপক্ষরা আদালত চত্বরে র‌্যাব দিয়ে বিপ্লবকে আটকের চেষ্টা করে। আইনজীবীদের সহযোগিতায় সে রক্ষা পায়। পরের বছর প্রতিপক্ষরা সন্ত্রাসী ভাড়া করে বিপ্লবকে বাড়ির সামনে আক্রমন করে। ২০১৩ সালে তালা থানার উপপরিদর্শক শিমুল দাসের নেতৃত্বে পুলিশ শালিখা কলেজ ঘেরাও করে বিপ্লবকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। গত ২৬ মে রাতে সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে পুলিশ, সন্ত্রাসী বসির আহম্মেদ, প্রতিপক্ষ শাহীন ও তার ভাইয়েরা বাড়ি ঘেরাও করে বিপ্লবকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালায়। মা হালিমা বেগম জানতে চাওয়ায় বিপ্লবকে পেলে হাড় গোড় ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয় গোয়েন্দা পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে হালিমা বেগম ও জাহাঙ্গীর পরদিন গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গেলে আব্দুল হান্নান পুলিশ সুপারের শরনাপন্ন হতে বলেন। ২৯ মে তারা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান লিটুকে নিয়ে পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীরের কাছে গেলে তাদেরকে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা আব্দুল হান্নানের সামনে কটুক্তি করে চেয়ারম্যানকে দালাল আখ্যায়িত করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। একপর্যায়ে পরের দিন আব্দুল হান্নানকে ম্যানেজ করে বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। গত ৬ জুলাই তারক দাস হত্যা মামলায় সাতক্ষীরা আদালতে এলে তাকে গোয়েন্দা পুলিশ ও সন্ত্রাসী বসির আহম্মেদ আটকের পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়। গত ৮ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আজমল হুদা সাতক্ষীরায় যোগদান করেন।

১৭ জুলাই বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত প্রায় ১২টা। গোয়েন্দা পুলিশের ৭/৮ জনের একটি দল একটি কালো মাইক্রোবাসে করে আটুলিয়া বাজারের জামে মসজিদের পাশে অবস্থান নেয়। প্রস্রাব করতে ওঠা হাফিজুর রহমানের ছেলে ব্যবসায়ি সবুজ জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তাকে ধমক দেওয়া হয়। কাচা রাস্তা হওয়ায় কারণে পুলিশ গাড়িটি ব্যবসায়ি সবুজের দোকানের সামনে রেখে তোজাম, শাহীন, মিন্টুসহ কয়েকজনের মোটর সাইকেলে বিপ্লবের বাড়িতে চলে যায়। এ সময় মাজাম, তোজাম, শাহীনসহ তাদের সহযোগিরা একে একে খাদেম মোড়ল, অবেদ মোড়ল, নূর ইসলাম, আমিরুল, সোহরাব, কাশেম, ওসমান মোড়লের ঘর ও আশরাফুলের দোকানের দরজায় ছিকল তুলে দেয়। পুলিশ আসর পরপরই প্রতিপক্ষরা বিপ্লবকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

ভাইপো বিপ্লবকে ঘরে রেখে স্ত্রী রিজিয়াকে নিয়ে বারান্দায় শুয়ে ছিলেন ছফেদ আলী মোড়ল। বাড়ির উঠানের সামনে বাঁশের চটার রেলিং এর গেটে টর্চ লাইটের আলো দেখতে পেয়ে ভাইপো নূর ইসলামকে চিৎকার করে ডাক দেন সফেদ আলী(৫৫)। এরপরপরই প্রতিবেশী সন্ত্রাসী আমিরুল শেখ, ফোজদার, তোজাম, শাহীন শেখ, আমজাদ, রিয়াছাত, সাতক্ষীরা শহরের নারকেলতলা বরফ মিলের পাশের সন্ত্রাসী বসির আহম্মেদ ও কয়েকজন গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে দা দিয়ে গেটের বেড়া কেটে ঘরের বারান্দার রেলিং ভেঙে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে। এ সময় তিনি দা দিয়ে শাহীনকে কোপ মারার চেষ্টা করলে তার ডান হাতে লোহার রড দিয়ে বাড়ি মারা হয়। এরপর পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা তার দু’ হাঁটুতে পিটিয়ে জখম করে। তাকে রক্ষায় এগিয়ে গেলে স্ত্রী রিজিয়িাকে জখম করা হয়।ঘরের দরজা ভেঙে বিপ্লবকে ধরতে যায় শাহীন, মিণ্টু , আমিরুলসহ তাদের কয়েকজন সহযোগি। শাহীন লোহার রড দিয়ে বিপ্লবের মাথা ফাটিয়ে দেয়। বিপ্লবকে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে আনার সময় বাধা দেওয়ায় পুলিশ তার (ছফেদ) ডান হাতের কবজির পাশে গুলি করে জখম করে। একপর্যায়ে চাচী রিজিয়া, চাচা অবেদ মোড়ল, চাচাত ভাই মুদি দোকানদার আশরাফুল ও নূর ইসলাম শেষ রক্ষায় এগিয়ে এলে তাদেরকে পিটিয়ে জখম করে দু’ হাতে হাতকড়া পরায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে পুলিশের কাছ থেকে দু’ হাদের হাতকড়া ছিনিয়ে নিয়ে শাহীন, আনারুল, তোজাম লোহার রড দিয়ে বিপ্লবকে মারতে মারতে পাকা রাস্তার উপর নিয়ে যায়। চিৎকার শুনে বিপ্লবকে রক্ষায় গ্রামের লোকজন ছুঁটে আসা শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রের বাইরে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় পুলিশ শুন্যে কয়েক রাউ- শর্ট গানের গুলি ছোঁড়ে। এর মধ্যে চার রাউ- গুলির খোঁসা উদ্ধার করে গ্রামবাসি। পুলিশ পরে আটুলিয়া বাজারে রাখা মাইক্রোবাসের দরজা খুলে বিপ্লবকে ভিতের ছুঁড়ে দেয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী কামরুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুন এ প্রতিবেদককে জানান।

রাত আড়াইটার দিকে বিপ্লবকে কুমিরা- তালা সড়কের ইসলামকাটি যাত্রী ছাউনীর রাস্তার ডান পাশে রেখে ডান পায়ের উরুতে তালা থানার উপপরিদর্শক আকরাম হোসেন ও সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আজমল হুদার উপস্থিতিতে পুলিশ পরপর দু’টি গুলি করে।। এরপর তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় টানতে টানতে রাস্তা পার করে একটি মাটির ঢিবির উপর ফেলে রাখা হয়। সেখানে তার অধিক রক্তক্ষরণ হয়ে গেলে তাকে রাত সাড়ে তিনটায় সাতক্ষীরা সদর হাসপতালে নিয়ে আসা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ ফরহাদ জামাল‘ তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তক্ষণিক খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দিলে পাহারারত পুলিশের বাধার মুখে মেঝেতে পড়ে থাকা বিপ্লব ১৮ জুলাই সকাল সাতটার দিকে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তালা থানার উপপরিদর্শক আকরাম হোসেন বিপ্লবের মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগেই ইসলামকাটি গ্রামে এসে রাতে গুলির শব্দ শুনেছেন মর্মে কয়েকজনের কাছ থেকে সাক্ষর করিয়ে নিয়ে যান। নিজেদের রক্ষায় বিপ্লব শেখের স্বজনরা প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা ও একটি মোটর সাইকেল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে মর্মে প্রচার দেয়।’

তালা থানার পুলিশের পক্ষ থেকে ‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বিপ্লব গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে দাবি করা হয়। বিপ্লবকে বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বক্কর ছিদ্দিীকি ও উপপরিদর্শক আকরাম হোসেন বন্দুকযুদ্ধ চলাকালিন গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতির কথা স্বীকার করলেও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকে এক প্রেস নোটের মাধ্যমে তা অস্বীকার করা হয়। পুলিশ বৃহষ্পতিবার গভীর রাতে দোহার গ্রামে যাওয়ার কথা ও অস্বীকার করে। এমনকি পুলিশের উপর হামলার অভিযোগে উপপরিদর্শক আকরাম হোসেন বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। বিপ্লবের বিরুদ্ধে বর্তমানে আজু হত্যা মামলাও নতুন বাজারের মারপিটের একটি মামলা বিচারাধীন থাকলেও পুলিশ তার বিরুদ্ধে একডজনের বেশি মামলা আছে বলে সাধারন মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করে।

প্রতিপক্ষরা ২০ লাখ টাকায় সন্ত্রাসী, সাতক্ষীরা পুলিশের এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ও তালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পুলিশকে ম্যানেজ করে বিপ্লবকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে দাবি করে তার স্বজনরা বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।

(আরকে/এইচআর/জুলাই ২১, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test