E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আগৈলঝাড়ায় ২৩৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী মারবেল মেলা 

২০১৯ জানুয়ারি ১৫ ১৫:৪৬:৫৯
আগৈলঝাড়ায় ২৩৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী মারবেল মেলা 

তপন বসু, আঞ্চলিক প্রতিনিধি (বরিশাল) : বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ২শ ৩৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক সংকীর্ত্তন ও গোসাই নবান্ন উদযাপন উপলক্ষে গ্রামীণ ঐতিহ্যর ধারক মারবেল খেলার মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার ভোরে শুরু হওয়া মেলা চলবে মধ্য রাত পর্যন্ত। মেলায় আগৈলঝাড়াসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন বয়সী হাজার হাজার শিশু ও নারী-পুরুষ মেলার প্রধান আকর্ষণ ‘মারবেল খেলা’য় অংশগ্রহণ করে।

উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রামানন্দেরআঁক গ্রামের মা সোনাই চাঁদ আউলিয়া মন্দির আঙ্গিনায় অনুষ্ঠিত হয় ২শ ৩৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক সংকীর্ত্তন ও গোসাই নবান্ন উৎসব। অনুষ্ঠান উপলক্ষে অন্যান্য বছরের মত এবছরও সেখানে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী মারবেল খেলার প্রতিযোগিতা।

মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (নিওনেটোলজি) শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান চন্দ্র (বিসি) বিশ্বাস ও উপদেষ্টা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মলিনা রানী রায় গোসাই নবান্ন ও মেলার উদ্ভব সম্পর্কে বলেন, এই গ্রামে ছয় বছর বয়সী সোনাই চাঁদ নামে এক মেয়ের বিয়ের বছর না ঘুরতেই তার স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুর বাড়িতে একটি নীম গাছের নীচে দেবাদীদেব মহাদেবের আরাধনা ও পূজার্চনা শুরু করে বিধবা কিশোরী সোনাই। সাধনার মার্গে সিদ্ধ হয়ে তাঁর অলৌকিক কর্মকান্ড এলাকা ছাপিয়ে বাইরেও প্রচার পায়। সোনাই’র জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৭৮০ খ্রিঃ ‘মা সোনাই চাঁদ আউলিয়া মন্দির’ স্থাপন করা হয়। সোনাইর মৃত্যুর পরেও তার স্থাপিত মন্দির আঙ্গিনায় চলে নাম সংকীর্ত্তন ও নবান্ন উৎসব। স্থানীয়দের উদ্যোগে ২০১২ সালে ওই মন্দিরটি পুনঃমির্মাণ করা হয়।

পঞ্জিকা মতে, প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিন নাম সংকীর্ত্তন ও গোসাই নবান্ন মহাউৎসবের মাধ্যমে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আর এই উৎসবকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে গ্রামীণ ঐতিহ্যর ধারক মারবলে খেলার মেলা।

সোনাই চাদের দেহত্যাগের পর ওই বাড়িটি ‘সোনাই আউলিয়ার’ বাড়ি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করে। প্রতি বছরের মতো এবছরও মেলা উলক্ষে বৈষ্ণব সেবা, হরিনাম সংকীর্ত্তন শেষে সোয়া মণ (৫০ কেজি) চালের গুড়ার সাথে সোয়া মণ গুড়, ৫০ জোড়া (১শ পিচ) নারকেল ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য খাদ্য উপকরণ মিলিয়ে তৈরী করা হয় গোসাই নবান্ন। ওই নবান্ন (মলিদা) মেলায় আগত দর্শণার্থীদের প্রসাদ হিসাবে পরিবেশন করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম পার্বণ পৌষ সংক্রান্তিতে দুই’শ উনচল্লিশ বছর ধরে এই গ্রামে উৎসব ও মারবেল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

মারবেল খেলার মূল রহস্য সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, শীতকালে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যাওয়ায় তাদের পূর্ব পুরুষেরা মেলার এই দিনে মারবেল খেলার প্রচলন শুরু করেন, যা আজও অব্যাহত আছে। তাদের উত্তরসূরী হিসেবে এখন তারও গ্রামীণ ঐতিহ্যর মারবেল খেলা ধরে রেখেছেন। এ দিনটিকে ঘিরে রামানন্দেরআঁক গ্রামে কয়েকদিন পর্যন্ত মহোৎসবের আমেজ বিরাজ করে।

স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের মেয়ে-জামাইসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের এই মার্বেল খেলায় আমন্ত্রণ জানান তারা। মেলার কয়েকদিন আগে থেকেই মেলার আয়োজন শুরু হয়। প্রতিটি বাড়ির আত্মীয়, স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে ওই গ্রাম থাকে লোকে-লোকারণ্য। বাড়িতে বাড়িতে চিড়া, মুড়ি, খেঁজুর গুড়ের পিঠা খাওয়ার ধুম পরে যায়। ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় এবছরও প্রধান আকর্ষণ ছিল সকল বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে মারবেল খেলার প্রতিযোগিতা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মন্দির এলাকার প্রায় ৬ বর্গ কি.মি এলাকা জুড়ে মারবেল খেলার আসর বসেছে। মেলা জুড়ে ছিল ওসি (তদন্ত) নকিব আকরামের নেতৃত্ব পুুলিশের কঠোর নজরদারি। বাড়ির আঙ্গিনা, অনাবাদী জমি, বাগান ছাপিয়ে রাস্তার উপরও বসেছে মারবেল খেলার আসর। এর সাথেই অনাবাদী জমিতে বসেছে বাঁশ-বেত শিল্প সামগ্রী, মনিহারী, খেলনা, মিষ্টি, ফল, চটপটি, ফুচকাসহ হরেক রকমের খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের দাকানের পশরা। বাগের হাট এলকার সুমন দাস, শিক্ষার্থী অবনী বাড়ৈ জানান, তারা মারবেল খেলার কথা শুনে মেলা দেখতে এসেছেন। ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলা তাদের ভীষণ ভাল লেগেছে বলেও জানান তারা। মেলায় মারবেল খেলার জন্য স্থানীয় নারী, পুরূষসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে লোকজন এসেছেন। কাক ডাকা ভোর থেকে মেলা চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

(টিবি/এসপি/জানুয়ারি ১৫, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test