E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

কর্ণফুলীতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে নিম্নমানের দই

২০১৯ জানুয়ারি ২১ ১৫:৪৮:১৯
কর্ণফুলীতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে নিম্নমানের দই

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দইওয়ালা’ গল্পের দই নেবেন গো দই, ভালো দই-এমন হাঁক ডাক ছেড়ে কর্ণফুলীর মেঠোপথ ধরে বা হাট-বাজারে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে মিষ্টি দই।

গুণে, মানে ও স্বাদের কারণে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার দইয়ের সুখ্যাতি দেশজুড়ে। এই সুখ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে উপজেলায় গড়ে তোলা হয়েছে এক ভেজাল দইয়ের কারখানা।

চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার উত্তর চরলক্ষ্যার শাহ সূফি আজিজ নগর এলাকায় এই ভেজাল দই তৈরীর কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে।

কোন রকমের অনুমোদন ছাড়াই চরম অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের মুখরোচক খাদ্য মিষ্টি দই। লেবেল নেই, ট্রেড লাইসেন্স এ নাম দেওয়া ‘বগুড়া মিষ্টি দই’। পাইকারি ১২টাকা দাম খুচরা ২০টাকা, ৪০০/৫০০গ্রাম ওজনের হাড়ি দই এর পাইকারি দর ৬০ ও খুচরা ৮০টাকা। এ যেন রমরমা ব্যবসা।

বাহির থেকে দেখে বুঝার কোন উপায় নেই। এটা যে একটা ভেজাল দই তৈরীর কারখানা। মহিলা ও পুরুষ মিলে যেখানে ১৫/২০জন কর্মচারী কাজ করছে ভেজাল পণ্য তৈরীতে। কোন সাইনবোর্ড কিংবা দই কোম্পানীর কোন চিহ্ন নেই। বাহিরের দেয়ালে কর্ণফুলী মডেল স্কুলের লেভেল। এক সময় এ ঘরে পড়ানো হতো প্লে গ্রুপ হতে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত। কিন্তু এখন বগুড়ার দই নামে ভেজাল খাবার তৈরীর নিরাপদ আশ্রয় ও কারখানা।

প্রায় দেড় বছর যাবত ‘মিষ্টি দইয়ের কারখানা’ নামে সেখানে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই গোপনে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন শিশুখাদ্যসহ নানান জাতের ভেজাল টক ও মিষ্টি দই। এসব ভেজাল খাদ্য সামগ্রী কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে ছাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে পটিয়া,আনোয়ারা ও শহরের বিভিন্ন জায়গায়। আর ক্রেতা হিসেবে সাধারণ মানুষ ও স্কুল পড়–য়া ছেলেমেয়েরা না জেনে এসব দই খেয়ে পেটের পীড়াসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই।

অনুমোদনহীন ওই কারখানায় কর্মরত ছোটবড় কারিগর ও শ্রমিকরা খালি গায়ে, অপরিস্কার ও স্যাঁতস্যাতে দুর্গন্ধময় স্থানে তৈরী করছে বিষাক্ত রং মেশানো শিশুখাদ্য এবং মিষ্টি দই তৈরী ও বিভিন্ন খাবার উপকরণ।

দেখা যায়, কারখানায় কর্মরত শ্রমিক ও কারিগরদের পরনে নেই এ্যাপ্রোন, হাতে নেই হ্যান্ড গ্লোবস, মাস্ক ও হেডক্যাপ। ধুলি বালিময় খোলা মেঝেতে সারি সারি মাটির হাড়িঁ ও প্লাস্টিকের বাজারজাত প্যাকেট বসানো। আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি নেই অথচ এখানেই ঢালা হচ্ছে দই তৈরীর নিম্নমানের চিনি ও দুধ মেশানো উপকরণ।

১৭ জানুয়ারী বৃহম্পতিবার সরেজমিনে, কারখানায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে প্রবেশ পথে দরজায় প্লাষ্টিকের দুধের ড্রাম পাশে জ্বলন্ত চুলা। উপরে টিনশেড চারপাশে ইটের দেয়াল ৬টি রুম আবৃত আলো-বাতাসহীন জায়গায় মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকরা উন্মুক্ত ড্রাম এবং পাতিল থেকে খালি হাতে প্লাস্টিক মগ ডুবিয়ে দুধ ও চিনির প্রলেপ দিয়ে তৈরী করছে ছোটবড় সকলের জন্য মূখরোচক বগুড়ার মিষ্টি দই।

এ সময় দেখা যায়, দই তৈরীর জন্য বহু আগে প্রস্তুতকৃত ময়দার খামি ও দুধের পসরা গুলো হাজার হাজার মাছির দখলে। এর পাশে খোলা ঘরের মেঝেতে থাকার ব্যবস্থা। একটি রুমের মেঝের এক কোণে উন্মুক্তভাবে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে ৩ শতাধিক ৪০০/৫০০গ্রাম ওজনের মাটির পাতিলে সাদা ও ঘোমট রংয়ের তরল পানীয়। অন্য পাশে প্লাস্টিকের কৌটায় শত শত দই তৈরীর উপাদান। যা কয়েক ঘন্টা পর পরিণত হবে ভেজাল দইয়ে।

এ সময় আরো দেখা গেলো ময়লা গন্ধযুক্ত ড্রাম আর হাউজে মজুদ করা দুধ ও দইয়ে মাছির ভনভনানি, সেই সাথে সেখানে অসংখ্য মশা-মাছি পড়ে রয়েছে।

প্রসিদ্ধ কোম্পানীগুলোর নাম নকল করা মোড়কে প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করা হচ্ছে এসব দই। এবং ভেজাল দই মাটি ও প্লাস্টিকের বিভিন্ন সাইজের পাত্রে বাজারজাত করা হচ্ছে।

ভেজাল কারখানা সম্পর্কে এলাকার একজন শিক্ষকের ভাষ্য হল, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে গড়ে তোলা হয়েছে অনুমোদনহীন এসব অবৈধ প্রতারণামূলক ব্যবসা। তবে যারা নিজে চোখে দেখেছেন ওই কারখানায় কিভাবে দই তৈরী করা হয়। তাদের সন্তানদের হাতে তুলে দেন না এসব খাবার। আর যারা এখনও জানতে পারেন নি, তারা না বুঝেই সস্তা মূলে এসব শিশুখাদ্য লুফে নিচ্ছেন।

এলাকাবাসীর পক্ষে সাবেক ছাত্রনেতা ও ব্যবসায়ি আব্দুল মালেক রানা জানান, ‘আড়ালে আবডালে খাদ্যের নামে এসব অখাদ্যের ব্যবসা উপজেলায় অনেক গজিয়েছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অনেকে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে বলে শুনি। সচেতন এলাকাবাসীর দাবি, অবিলম্বে থানা নির্বাহী অফিসারের দৃষ্টি আর্কষণ করে এসব ভেজাল খাদ্য ও দই তৈরীর কারখানা বন্ধের।

সুুত্রে জানা যায়, অনেক ব্যবসায়িরা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ হতে একটা ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই এসব ব্যবসা পাতে। তারা মনে করেন এটাই ব্যবসার লাইসেন্স পেলেন। আসলে ট্রেড লাইসেন্স মানে যে অবৈধ বা ভেজাল ব্যবসার পশরা খোলার অনুমোদন নয়। সেটা তারা মানতে নারাজ। মনে হয় অনেক চেয়ারম্যান মেম্বার ও জানেন না বিষয়টি। নাহলে যাচাই বাচাই ছাড়া কিভাবে একটা ভেজাল কারখানার ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয় তা সচেতন মহলের প্রশ্ন জনপ্রতিনিধিদের প্রতি।

এ ব্যাপারে বগুড়ার মিষ্টি দই কারখানার স্বত্বাধিকারী তাজুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মাত্র ৩/৪ মাস হচ্ছে ব্যবসা করছি। কাগজপত্র এখনো করি নাই, করবো। কয়েকজন বগুড়ার লোক নিয়ে বগুড়ার দই তৈরী করি।’

কোনো অনুমোদন ছাড়া অন্য কোম্পানীর মোড়ক নকল করে বগুড়ার দই নামে বাজারজাত করা ঠিক করছেন কি না, জবাবে তিনি অনেক্ষণ চুপ থেকে বলেন, আমি নতুন শুরু করেছি, কাগজপত্র পরে করবো। ইউনিয়ন পরিষদ হতে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছি।’

এ ধরণের ভেজাল খাদ্য-সামগ্রীর কারখানা বিষয়ে জেলা স্যানিটারী অফিসের এক মুখপাত্র বলেন, সরকারের অনুমোদনহীন এ ধরণের ভেজাল খাদ্য সামগ্রী তৈরীর কারখানার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ বিষয়ে কর্ণফুলী থানার অপারেশন অফিসার মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে আমরা কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারলাম অবশ্যই আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ভেজাল কারখানা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, ‘ শিশুদের জন্য এসব খাবার নিরাপদ নয় এবয় ক্ষতিকর। দ্রুত খবর নিয়ে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সামনে ভেজাল বিরোধী অভিযানও পরিচালনা করা হবে।’

(ওএস/এসপি/জানুয়ারি ২১, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test