E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কর্ণফুলীতে ইয়াবা কারবারির দুটি সুরম্য অট্টালিকা রক্ষায় অভিনব কৌশল

২০১৯ মার্চ ২৪ ১২:৪৫:০৫
কর্ণফুলীতে ইয়াবা কারবারির দুটি সুরম্য অট্টালিকা রক্ষায় অভিনব কৌশল

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন কঠোর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন চরপাথরঘাটার ইছানগর এলাকায় চিহ্নিত করেছে দুই অবৈধ মাদক কারবারীর সুরম্য অট্টালিকা।

তথ্য রয়েছে, গত মাসে যেখানে উপজেলা প্রশাসন পর পর দুবার অভিযান চালিয়েও কাউকে আটক করতে পারেননি। কেন না সে সময় বাড়ির মালিক পক্ষের কেহ উপস্থিত থাকেন না। ভবনে ভাড়াটে রেখে এরা নগরীর খুলশী ও হাটহাজারীতে বসবাস ও গ্রেফতার এড়াতে কৌশলে চলাফেরা করেন বলে সুত্র জানায়।

অপরদিকে উপজেলা প্রশাসনের অভিযানের মুখে একাধিক ভাড়াটে ইতিমধ্যে দুটি সুরম্য অট্টালিকা ছাড়লেও দুই মাদক ব্যবসায়ী ও তার আত্বীয় স্বজনেরা এসব ভবনকে বৈধ ব্যবসার সম্পদ দাবি করার লক্ষ্যে অভিনব পদ্ধতি ও কৌশল এঁটেছে বলে জানা যায়। এমনকি নানা ছলচাতুরী ও পাঁয়তারায় সহ ফন্দি পাকাতে ব্যস্ত রয়েছেন বলেও এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়।

উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও এসব সুরম্য ভবন দুটি মাদকের টাকায় তৈরী করা হয়েছে বলে দাবি তুলেছে। এবং জনগণ এসব সম্পত্তি সরকারের কাছে বাজেয়াপ্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের এমন আগাম তথ্য পেয়ে আগে থেকেই ভবন মালিকেরা বিভিন্ন ভূয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মের্সাস সায়েম এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স সিয়াম ট্রের্ডাস সহ লবণ ব্যবসার কাগজপত্র তৈরী করে চট্টগ্রাম উপ কর কার্যালয়ে জমা দিয়েছে বলে একটি বিশস্তসুত্রে খবর পাওয়া যায়।

এমনকি অপরদিকে, কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসনের তৎপরতা দেখে এরইমধ্যে ভবন মালিক মোহাম্মদ হোসাইন গত ১৬ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজারের টেকনাফ পাইলট স্কুলের মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এবং তালিকাভুক্ত দ্বিতীয় ভবনের মালিক অপর মাদক ব্যবসায়ী হেলাল পলাতক থেকে আত্মসমর্পণের লবিং করছে বলেও একটি অসমর্থিত সুত্রে প্রতিবেদককে জানায়। যে কোন মুহুর্তে তিনিও আত্মসমর্পণ করতে পারেন বলেও তথ্য দেন সুত্রটি।

পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন ও এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, টেকনাফ থেকে এসে এরা উপজেলার ইছানগর গ্রামে মাদক ব্যবসার টাকায় ‘রাজপ্রাসাদ’র মতো বাড়ি বানিয়েছে তালিকা ভুক্ত এই দুই ইয়াবা ব্যবসায়ী। যদিও ইয়াবা দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সরকারের নির্দেশে সারাদেশে মাদক বিরোধী অভিযান চলছে।

এরই ধারাবাহিকতায় কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শামসুল তাবরীজের নেতৃত্বে চলতি মাসে কর্ণফুলী থানা পুলিশের একটি টিম দু’বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেন। এবং নিয়মিত কর্ণফুলী থানার ওসি আলমগীরের নিদের্শে মাদকের বিরুদ্ধে অপারেশন চলমান রয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন সুত্রে আরো জানা যায়, মাদক বিরোধী অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীর গড়া ইছানগরের দুই ভবনে থাকা ভাড়াটেদের গত ২৫শে ফেব্রয়ারীর মধ্যে মৌখিক ভাবে বাসা ছাড়ার নির্দেশনা দেন কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ রির্পোট লেখা পর্যন্ত বেশির ভাগ ভাড়াটে বাসা ছেড়েছে বলে বাড়ির সদস্য স্মৃতি আক্তার জানায়।

তবে দুই ভবনের কেয়ার টেকার ও তত্বাবধায়নে থাকা টেকনাফে সদ্য আত্মসমর্পণকারী মাদককারবারী মোহাম্মদ হোসাইন এর ছোট ভাই আমিন খাঁন এবং তালিকাভুক্ত অপর ইয়াবা ব্যবসায়ী পলাতক থাকা হেলালের শ্যালক মো. ওবায়েদুল্লাহ বাদল এর সাথে কথা হলে দুজনেই জানায়, বাসা ছাড়ার ব্যাপারে তাঁরা কোন লিখিত কাগজপত্র পায়নি। তারপরেও অনেকে ভয়ে চলে গেছে এতে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু আমরা বাসা ছাড়ার প্রশ্নেই আসেনা বলে আত্ম গৌরবে ঢেঁকুর তুলে এসব কথা বলেন তারা।

এমনকি তাদের আত্বীয় স্বজনদের দাবি এসব ভবন নির্মাণে ব্যাংক লোন, লবণ ও মাছের ব্যবসায় টাকায় গড়া সম্পদ। দীর্ঘদিন তাঁরা এসব সম্পদের আয় কর রির্টান ও সরকারি কর পরিশোধ করেন বলেও তথ্য দেন।

বিশস্ত সুত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন কতৃক চিহ্নিত দুই মাদক ব্যবসায়ী তাদের অবৈধ আয়ের অর্থ-দিয়ে প্রায় দুই বছর আগে ইছানগর এলাকা হতে জমি কিনেন। এবং দেড় বছর আগে তা রাতারাতি ভবন তৈরী করলে স্থানীয় সাধারণ জনগণ ও প্রশাসনের নজরে আসে। এদের নামে বেনামে কক্সবাজার সদরেও বহু অর্থ সম্পদ রয়েছে বলে খবর রয়েছে।

বেশ কিছুদিন আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাদক বিরোধী অভিযানে নেমে কারবারীদের বাড়িঘর ভাঙ্গতে শুরু করলে কৌঁশলে ইছানগরের দুই মাদককারবারী ভবন বাঁচাতে ব্যাংক লোনের দারস্ত হন। এবং টেকনাফ হ্নীলা শাখার ইউনিয়ন ব্যাংক হতে জমি ও ভবন দেখিয়ে এক কোটি ২০ লক্ষ টাকার মর্গেজ নেয় বলে সুত্র জানা যায়। সব মিলিয়ে জমি কেনা ও এ দুটি ভবন তৈরীতে সর্বমোট প্রায় ১২ কোটি টাকার উপরে খরচ হতে পারে বলে ধারণা রয়েছে। তবে রহস্য ও প্রশ্ন রয়ে যায় তাদের কোন দৃশ্যমান ব্যবসা না থাকলেও এ টাকার উৎস কোথায় তাদের?

আর রাতারাতি গড়া এসব অবৈধ অর্থ সম্পদ রক্ষার জন্য বর্তমানে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? অপরদিকে উপজেলা প্রশাসন তাগিদ দিলেও তাঁরা বিষয়টি আমলে নিচ্ছেনা এবং গোপন সুত্রে জানা যায়, তারা কর কর্মকর্তা ও আইনজীবিদের দারস্ত হচ্ছেন। কিভাবে এসব অবৈধ সম্পদ ও মাদকের টাকায় গড়া দু’ভবন রক্ষা করা যায়। এ চিন্তায় এরা নানা কৌঁশল আঁকতে শুরু করেছে।

সাধারণ জনগণ জানতে চায় প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ী কারা। শুধু কি মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন টেকনাফ-উখিয়ার সম্পদশালী মানুষেরা, নাকি গোটা দেশে যারা আঙ্গল ফুলে হঠাৎ কলাগাছ বনে গেছে তাঁরাও ইয়াবা কারবারী। এ রকম কর্ণফুলীতে মাছের ব্যবসা ও কাঠের ফার্নিচারের ব্যবসার আড়ালে অনেকে মাদক ব্যবসা করছেন বলে কানাঘুষা রয়েছে।

প্রশাসন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা এখনো তাদের ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেন নি। তবে হাতে নাতে প্রমাণ না থাকায় প্রশাসনও কৌশল নিচ্ছে বলে একটি সুত্র জানায়।

ওইসব মাদক ব্যবসায়ীদের বৈধ কোন ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, অথচ বাড়ি-গাড়ি সহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক তাঁরা। অল্প সময়ে মাদক ব্যবসা করে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার পরও তাঁরা অভিনব কৌশলে প্রভাবশালীদের ব্যাংক হতে অনিচ্ছ্বাস্বত্তেও ব্যাংক লোন নিচ্ছেন।

কেউ কেউ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে নামকেওয়াস্তে ব্যবসা, এবং মাদক ব্যবসার কোটি কোটি টাকা দিয়ে সম্পদ তৈরী করে এনবিআরে তার ভ্যাট ও কর আদায় করে সরকার হতে এসব অবৈধ সম্পত্তি হালাল করার ঠুঁনকো পথ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে আইনজীবিদের ধারস্ত হচ্ছেন বলে জানা যায়।

সচেতন মহলের প্রশ্ন, ইয়াবা কারবারিদের নেই কোন পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা, নেই বড় আকারের কোন ব্যবসা। দৃশ্যমান কোন কিছুই নেই তাদের। তারপরও তাদের বাড়ি, গাড়ি, জমিজমা, স্বর্ণালঙ্কার, বড় বড় বীমা ইন্সুরেন্স, বাড়িতে বিদেশী আসবাবপত্র ও জমানো টাকার অভাব নেই কেন? সেটাই প্রশ্ন তুলেছেন!

অনেকে মনে করেন দুদক’কে কাজে লাগাতে হবে। চালাতে হবে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান। আয়ের উৎস কি খোঁজ নিয়ে ওই সম্পদ অবৈধ বলে প্রতীয়মান হলে তা সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার এখনই সঠিক সময় বলে জানান।

প্রসঙ্গত, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করেছেন ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন এর মধ্যে ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারি (গডফাদার)। তাঁদের ৬৬ জনই টেকনাফের বাসিন্দা। এদের মধ্যে একজন কর্ণফুলীর ইছানগরে গড়া সুরম্য অট্টালিকা হাজেরা মঞ্জিলের মালিক মোহাম্মদ হোসাইন।

কর্ণফুলীর তরুণ ব্যবসায়ী মো. ওসমান বলেন, কেউ মাদক ব্যবসার টাকায় হিরা খচিত রাজপ্রাসাদ করলেও সেটা অবৈধ হবে। এসব অবৈধ ব্যবসায়ী ও মাদকের টাকায় গড়া ভবনের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন সেটায় দেখছে জনগণ!

চট্টগ্রাম দুদক অফিসের উপ পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম জানান, ‘যত কিছুই করুক না কেন সম্পদ বাঁচাতে, বৈধ ব্যবসা ও টাকার সঠিক উৎস কোথায় দেখাতে না পারলে দুদক কাউকে ছাড় দেবেনা। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।’

কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, ‘কর্ণফুলীতে তালিকাভুক্ত দুই মাদক ব্যবসায়ীর ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অভিযান চালিয়ে পরে মৌখিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এমনকি তিনি আরো জানান, লিখিত ভাবে আইনী পদক্ষেপের প্রস্তুতি ও দ্রুত ভবন দুটির বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

(জেজে/এসপি/মার্চ ২৪, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test