E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কলাপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শত বছরের ইতিহ্যবাহী নীল উৎসব শুরু

২০১৯ এপ্রিল ১৩ ১৬:৪৬:১৭
কলাপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শত বছরের ইতিহ্যবাহী নীল উৎসব শুরু

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : মাথায় লাল কাপড়,পাগড়ী মাথায়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ও হাতে ত্রিশূল। সঙ্গে ঢাক-ঢোল, করোতাল ও কাশার বাদ্য। বাহারী সাজে সেজেছে শিব-পার্বতী ও হনু ( পাগল সাধু)। নীলকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে ছুটছে দলপতি (বালা)। হিন্দু বাড়ির উঠানে আল্পনা দিয়ে কেউবা উঠান লেপন করে তাতে বসাচ্ছে নীলকে। এরপর শুরু নীল নাচ ও শিবের গাজন(গান)।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ঐতিহ্যবাহী এ নীল উৎসবে এখন উৎসব মুখর প্রতিটি পল্লী। ‘নীল পুজো’ বা নীলষষ্ঠী হল বাংলার হিন্দুসমাজের এক লৌকিক উৎসব, যা মূলত শিব-দুর্গার বিবাহ বা শিবের বিয়ে নামে পরিচিত।

চৈত্রসংক্রান্তি চড়ক উৎসবের আগের দিন এ নীলপূজা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ এপ্রিল (শনিবার) কলাপাড়ায় অনুষ্ঠিত হতে এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব। শনিবার রাতে “নীল পূজা” শেষে পৌর শহরের ফিশারি একুশে সড়ক এলাকায় রোববার অনুষ্ঠিত হবে চৈত্র সংক্রান্তি মেলা।

গত এক সপ্তাহ ধরে দিনভর কলাপাড়া পৌর শহরের প্রতিটি এলাকায় এ নীল নাচ ও শিবের গাজন অনুষ্ঠান ঘিরে এলাকা ছিলো উৎসব মুখর। হিন্দু সম্প্রদায়ের হারিয়ে যেতে বসা এ উৎসব দেখতে ভীড় করে স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করের নানা বয়ষের নারী-পুরুষ।

নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা পূজার সময়ে নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহকারে বাড়ি বাড়ি ঘুরেন এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। এ সময় তাদেরে মুখে শোনা যায় এক বিশেষ ধরনের গান ৷ যা লোকমুখে ‘নীলের গান’ বলেই পরিচিত ৷ তবে এই গানের আসল নামটি হল‘অষ্টক গান’ ৷

হিন্দুদের এ ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান কলাপাড়ায় দীর্ঘ বছর বছর বন্ধ ছিল। এবার স্থানীয় স্কুলের ছাত্র ও এলাকাবাসীর সহায়তায় এই দল করে নীল উৎসবের আয়োজন করে।

হিন্দু নর-নারীরা বলেন,“আগে এই দিনে মানুষের ঢল নামতো। কিন্তু এখ আর এই উৎসবই হয় না। তবে এবার নীল পূজা ও চৈত্র সংক্রান্তি মেলা হওয়ায় গোটা এলাকার মানুষ খুশি। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সারাদিন উপবাস করে রাতে শিবের মাথায় জল ঢালেন হিন্দু রমণীরা ৷ ‘নীলের ব্রত’ শুনে স্বামী, সন্তান ও পরিবারের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপুজো করে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন ৷ নীল মেলায় নিম বা বেল কাঠ দিয়ে নীল বা শিবের মূর্তি তৈরি হয় ৷ চৈত্র সংক্রান্তির বেশ আগেই নীলকে মঞ্চ থেকে নীচে নামানো হয়।। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস অধিক রাতে হয় হাজরা পূজা। নীলপূজার সময়ে নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পড়িয়ে বাড়িতে বাড়িতে নীলকে ঘোরানো হয়।

নীল পূজা মানে শিব দেবতার গাজন (শিব পূজা)। হিন্দু ধর্মের পৌরণিক ধর্ম মতে, দেবতা শিব সমুদ্র মন্থনে বিষপান করে নীল কণ্ঠ ধারণ করেছিলেন। আবার বৈদিক হিন্দু ধর্ম মতে, সূর্য অস্ত গেলে চারিধার গাঢ় অন্ধকার হয়ে আসে। গাঢ় অন্ধকার নীল বর্ণের হয়। বছরের আয়ূষ্কাল শেষ হওয়ার প্রতীকী হল এই নীল। কালের আবর্ত শেষ হয়ে আসে নতুন ভোর, নতুন কাল। পুরানো কালকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরে সংকট কেটে সুখ ও সমৃদ্ধির আশায় এ নীল পূজা করা হয়।

“প্রচলন আছে যে, এই নীল নাচের দলে থাকা পাগলের শরীরে থাকা পাট হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সংগ্রহ করে। তাঁদের মতে এই পাট হলো শিবের মাথার জট। এই জট শরীরে থাকলে বিভিন্ন রোগব্যাধী থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়াও নীল পাগলকে দিয়ে হিন্দু বাড়িতে থাকা বিভিন্ন ফলন্ত গাছের ফল ছিড়ে নিতে অনুরোধ করা হয়। তাদের মতে নীল পাগল যে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করবে সেই গাছে ফলন ভালো হবে”।

নীলা পূজার জণ্য উপবাস করা গৃহবধুরা অনিতা রানী, তাপসী পাল, সুজনা রানী বলেন, স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল কামনায় এই নীলপূজা উপলক্ষে নির্জলা (প্রায় ২৪ ঘন্টা জল পানও করেণ না) উপবাস করেছেন। রাতে পূজার পর তারা উপবাস ভাঙ্গবেন। এতো বছর উপবাস করেছেন কিন্তু নীলপূজা না হওয়ায় বাসায়ই প্রতিকী পূজা করেছেন। কিন্তু এবার নীল পূজার আয়োজন করায় তারা ওই খানেই পূজা দেবেন। নীলপূজা উপলক্ষে মেলা স্থানে অস্থায়ী মন্দির নির্মান করা হয়েছে।

এ নীল নাচের দলের সংগঠক ও হিন্দু পুরোহিত শংকর চক্রবর্ত্তী বলেন, আগে শষো ঠাকুর এই মেলা আয়োজন করতেন। তিঁনি মারা যাওয়ার পর আর কেউ উদ্যেগ নেয়নি। এবার স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় তারা এই নীল নাচ ও নীল পূজার আয়োজন করেছেন। শনিবার রাতে নীলপূজা শেষে রোববার বসবে চৈত্রসংক্রান্তি মেলায়। মেলায় হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হবে বলে আয়োজকরা জানান।

(এমকেআর/এসপি/এপ্রিল ১৩, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test