ফুটবলের দাম ৫ হাজার, ক্রিকেট ব্যাটের দাম ১৫ হাজার!

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি(আইএইচটি) ও মেডিক্যাল এসিসট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) সাড়ে ২২ কোটি টাকা মূল্যের স্বাস্থ্য ও খেলাধুলার সরঞ্জাম প্রকৃত মূল্য অপেক্ষা কয়েক গুণ বেশি দিয়ে কেনা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, এইচআইটি ও ম্যাটস এর মালামাল কেনার জন্য গঠিত কমিটির সদস্যরা বিপুল পরিমান টাকা লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ।

সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭-১৮ অর্থ বছরে কালিগঞ্জের নলতা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজী (আইএইচটি) ও মেডিক্যাল এ্যাসিসট্যান্ড ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, ক্রীড়া সামগ্রীসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনার জন্য বরাদ্দকৃত ২২ কোটি টাকার বিপরীতে গত বছরের ২০ ফেব্র“য়ারি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। সে অনুযায়ি চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র সংগ্রহ করে। পরে দরপত্রগুলো মুল্যায়নের জন্য গত বছরের ৪ এপ্রিল দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভায় ম্যাটস ও আইএইচটির দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তওহিদুর রহমান, কমিটির সদস্য ডা. আকছেদুর রহমান, ডা. মো. আব্দুল লতিফ, শেখ আব্দুল আলিম, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারি প্রকৌশলী আমিনুর রহমান, কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শেখ তৈয়েবুর রহমান ও দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মেহেদি হাসান আলোচনার মাধ্যমে ঢাকার উত্তরার মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজ এর স্বত্তাধিকারি শাহিনুর রহমান, শ্যামলী ঢাকার নলতা শরিফ সার্জিক্যাল এর স্বত্তাধিকারি তরিকুল ইসলাম ও ঢাকার পুরানা পল্টনের মেসার্স ইউনিভার্সাল ট্রেড কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারি আসাদুর রহমান কাজের বরাদ্দ দেন।

সে অনুযায়ি মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজ ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭২০ টাকার খেলার সামগ্রী ও আসবাবপত্র সরবরাহ করেছেন। এরমধ্যে নলতা ম্যাটস এ দু’কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮১০ টাকার এবং আইএইচটিতে দু’ কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৯১০ টাকার আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী সরবরাহ করেন। তবে মোট টাকার মধ্যে ৭৬ লাখ ৫১ হাজার ৬৬০ টাকার ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি নীট বিল পেয়েছেন তিন কোটি ৭৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬০ টাকা।

একইভাবে সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রি ডাঃ আ.ফ.ম রুহুল হকের আত্মীয় নলতা শরিফ সার্জিক্যাল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্তাধিকারি তরিকুল ইসলামের সরবরাহকৃত ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার ২৫ টাকার বইপত্রের মধ্যে ম্যাটস এ ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯৩ টাকার এবং আইএইচটিতে ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৩২ টাকার বইপত্র রয়েছে। ঠিকাদারি এই প্রতিষ্ঠানটি চার লাখ ৪৯ হাজার ৭৩৪ টাকা সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রদান করেন।

এছাড়া ঢাকার পুরানা পল্টনের মেসার্স ইউনিভার্সাল ট্রেড কর্পোরেশন কালিগঞ্জের নলতা ম্যাটস ও আইএইচটিতে মোট ১৭ কোটি ৪৯ লাখ ২৪ হাজার ১৬৪ টাকার বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করেন। এরমধ্যে ম্যাটস এ সাত কোটি ৭৪ লাখ ৫৮ হাজার ৬৫০ টাকার এবং আইএইচটিতে ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫১৪ টাকার স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য সামগ্রী রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়েছেন দু’ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার ৯০৫ টাকা।

এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি যে সমস্ত যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে প্রতিটি তিন লাখ ৩৩ হাজার টাকা করে ১২টি চাইনিজ ডুয়েল সেক্স টরস ২০ পার্ট, যার মোট মূল্য ৩৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। প্রতিটি তিন লাখ ৩৩ হাজার টাকা মূল্যের ১২টি চাইনিজ ডুয়েল সেক্স টলস্ উইথ ওপেন ব্যাক (২০ পার্ট)। যার মোট মূল্য ৩৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। প্রতিটি ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা করে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা মূল্যের ১২টি চাইনিজ স্পাইনাল কড এন্ড স্পাইনাল নার্ভস, প্রতিটি ৪৮ হাজার ১০০ টাকা মূল্যের ১০টি চাইনিজ ইউরিনারি অরগান, প্রতিটি ৪৮ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের চাইনিজ ফিমেল পেলভিস, প্রতিটি সেট ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা মূল্যের তিনটি হিপ জয়েন্ট সেকশান। ৭৪ লাখ টাকা মূল্যের জার্মানী তৈরি একটি ফুললি অটোমেটেড ক্লিনিক্যাল কেমিস্ট্রি এ্যানালাইজার। ৩৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা মূল্যে দুটি ইউএসএ’র তৈরি ট্রাইনোকুলার মাইক্রোস্কপ। বাইনোকুলার এলইডি মাইক্রোস্কপ প্রতিটি দু’ লাখ ২২ হাজার টাকা মূল্যের ৫৩টি এলআইডি বাইনোকুলার মাইক্রোসকোপ। এভাবেই ম্যাটসএ ১০৬ ও আইএইচটিতে ১০৪ প্রকার মোট ২১০ প্রকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্য যন্ত্রাংশ ও মেশিন কেনা হয়েছে ১৭ কোটি ৪৯ লাখ ২৪ হাজার ১৬৪ টাকায়। বাস্তবে ওইসব মালামালের বাজার মূল্য অপেক্ষা ক্রয় মূল্য কয়েকগুণ বেশি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারি শাহিনুর রহমান ম্যাটস ও আইএইচটিতে সরবরাহ করেছেন, খেলার জন্য ফুটবল ২০টি এক লাখ টাকা, ক্রিকেট ব্যাট ৫০টি সাড়ে সাত লাখ টাকা, এছাড়াও রয়েছে ক্রিকেট বল, প্যাড, হেলমেড, গ্লোবস, ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ অন্যান্য খেলার বিভিন্ন ধরণের ৫৮টি সামগ্রী। এসব সামগ্রী সরবরাহ করে ম্যাটস ও আইএইচটি কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বিল নিয়েছেন ভ্যাট ও ট্যাক্স বাদে ৮৯ লাখ টাকা। অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের খেলার জন্য প্রতিটি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ফুটবলের সরকারি কেনা মূল্য ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতিটি এক থেকে দেড় হাজার টাকার স্টেথোস্কোপ ও বিপি মেশিনের দাম ধরা হয়েছে নয় হাজার টাকা। প্রতিটি ক্রিকেট ব্যাটের বাজার মূল্য আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা হলেও কেনা ধরা হয়েছে মূল্য ১৫ হাজার টাকা।

এছাড়াও ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহকৃত আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে প্রতিটি ৮০ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ টেবিল, ৪৯ হাজার ৩০০ টাকা মূল্যের একটি হাফ সেক্রেটারি টেবিল, প্রতিটি ৪০ হাজার ৭০০ টাকা করে মূল্যের ১০টি স্টীল আলমিরা, প্রতিটি ৪০ হাজার ৭০০ টাকা মূল্যের ১০টি গ্লাস আলমিরা, প্রতিটি ২৮ হাজার ৫৫০ টাকা মূল্যের ১৫টি স্টীল ফাইল কেবিনেটসহ ম্যাটস এ মোট ৫২টি আসবাবপত্র ও ২৯টি খেলার সামগ্রী।ইঠকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এসব সরবরাহ করে বিল নিয়েছেন দু’ কোটি ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮১০ টাকা। পাশাপাশি এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি আইএইচটি তে ৪৬টি আসবাবপত্র ও ২৯টি খেলার সামগ্রী সরবরাহ করে বিল নিয়েছেন দু’কোটি ২৪লাখ ৯৯ হাজার ৯১০ টাকা।

এসব আসবাবপত্র ও খেলার সামগ্রী বুঝে নিতে গঠিত সার্ভে কমিটির দায়িত্বে ছিলেন ডা: মেহেদী হাসান, ডা. তৈয়েবুর রহমান, ডা. আকছেদুর রহমান এবং ম্যাটস ও আইএইচটির ভারপ্রাপ্ত স্টোরকিপার মামুন অর রশিদ। গত বছরের ৪ জুন থেকে বিভিন্ন সময় এসব মালামাল তারা বুঝে নিয়েছেন।

এছাড়াও ঢাকার শ্যামলী এলাকার নলতা শরিফ সার্জিক্যাল এর স্বত্তাধিকারি তরিকুল ইসলাম ম্যাটস এর আওতায় বই সরবরাহ করে বিল নিয়েছেন ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯৩ টাকা। আপরদিকে আইএইচটির আওতায় বিভিন্ন প্রকারের বই সরবরাহ করে বিল নিয়েছেন ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ৩২ টাকা মাত্র।

জানতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেনিভোলেন্ট এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারি শাহিনুর রহমান পণ্যের দাম সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যরাই নির্ধারণ করেছেন দাবি করে বলেন, প্রতিটি বলের দাম পাঁচ হাজার টাকা হলেও মান ভাল হওয়ায় ছোট আইটেম অনেক সময় দরদামের তারতম্য হয়ে যায়।

নলতা আইএইচটি ও ম্যাটস এর দায়িত্বপ্রাপ্ত বর্তমান অধ্যক্ষ (অতিরিক্ত দায়িত্বে) থাকা সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে দু’টি প্রতিষ্ঠানে যেসব মালামাল কেনা হয়েছে ওই সময় দায়িত্বে ছিলেন ডাঃ তওহিদুর রহমান। এর বাইরে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।

সাবেক সিভিল সার্জন ও প্রতিষ্ঠান দুটির তৎকালিন অধ্যক্ষ ডা: তওহিদুর রহমান জানান, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা উন্নত করতে তিনি যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে ক্লিনিক মালিকগুলোও সমস্যায় পড়ে। তাই ভাল মানের পণ্য কেনার পরও ক্লিনিক মালিকদের একটি অংশসহ একটি স্বার্থান্বেষী চক্র তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

(আরকে/এসপি/জুন ২৬, ২০১৯)