E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুন্দরবন সুরক্ষায় ব্যয় হবে ৪৬০ কোটি টাকা

২০১৯ জুন ২৮ ১৮:৪৯:৪৮
সুন্দরবন সুরক্ষায় ব্যয় হবে ৪৬০ কোটি টাকা

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : বিশ্বের বৃহতম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের প্রানপ্রকৃতি নিয়ে ইউনেস্কো, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেটিভ অব নেচার ‘আইইউসিএন’ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সাথে সুন্দরবনকে বিপদসংকুল বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণার জন্য আইইউসিএনের প্রস্তাবনা নিয়ে আগামী ৩০ জুন থেকে ১০ জুলাই আজারবাইজানের রাজধানী বাক’তে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে ? সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড) তালিকা থেকে বাদ পড়বে নাকি ‘বিপদসংকুল বিশ্ব ঐতিহ্য’ তালিকায় উঠবে, একর পর এক নেতিবাচক সব সংবাদের মধ্যে সুন্দরবন নিয়ে একটি সুখবর এসেছে। বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ) সুন্দরবনের সুরক্ষায় সরকার এবার ব্যয় করবে প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা। সরকারের এই পদক্ষেপ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে আরো বেশী সুরক্ষিত করবে। এমন দাবী বন বিভাগের।

সুন্দরবন সুরক্ষা নামে ৫ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পে সংরক্ষিত এই ম্যানগ্রোভ বনের বন্যপ্রানী- গাছপালাসহ প্রানপ্রকৃতি ও বনের পরিবেশ-প্রতিবেশের কৌশলগত পরিবর্তন নিয়ে নিরন্তর গবেষনার পাশাপশি সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নয়ন-আধুনিকায়নসহ প্রতিবেশ পর্যটন (ইকো ট্যুরিজম), সার্বক্ষনিক বন পাহারায় অত্যাধুনিক জলযান সংগ্রহ, ঝঁকির মধ্যে থাকা ২৮টি বন অফিস আধুনিকায়ন ও ব্যবস্থানা পরিকল্পনায় আধুনিকায়ন থাকছে। চলতি বছর থেকে ৪ শত ৫৯ কোটি ৯৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে জানিয়েছেন, বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান।

বন বিভাগ বলছে, বিগত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবন জুড়ে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ‘স্মার্ট প্রোট্রোলিং’ এর মাধ্যমে বন পাহারা দেয়ায় এবছর সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ১০৬টি থেকে বেড়ে দাড়িয়েছে ১১৪টিতে, খালে বিষ দেয়া রোধে গত ১১ মার্চ থেকে সুন্দরবন অভ্যন্তরে ২৫ ফুট বা তার চেয়ে ছোট খালগুলোতে সারা বছর মাছ আহরন নিষিদ্ধ ও ২৫ ফুটের উপরের সব খালগুলোতে মাছের প্রজনন মৌসুম জুলাই ও আগষ্ট মাসে মাছ আহরন নিষিদ্ধ করেছে বন বিভাগ। বন অফিস বাড়ানো পাশাপাশি মাছের প্রজনন ও সংরক্ষনের জন্য ১৮টি বড় খাল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিনের জন্য ৩টি নদীর ১০. ৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৩টি অভয়ারন্য গড়ে তোলা হয়েছে।

পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষনা করে সুন্দরবন সন্নিতি এলাকায় আর কোন শিল্প-কারখানা স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছেনা সরকার। সুন্দরবন সুরক্ষায় বাংলাদেশ- ভারত যৌথ ভাবে কাজ করছে। সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়াতে গড়াই নদী খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েচে। সুন্দরবন বিভাগ বলছে, একর-পর এক বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহন করায় ম্যানগ্রোভ এই বনের প্রানপ্রকৃতি এখন আগের থেকে অনেক-অনেক বেশী সুরক্ষিত রয়েছে। তবে, বাংলাদেশের এই দাবীর সাথে একমত হবে পারছেনা ইউনেস্কো ও আইইউসিএন।

জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ ও আইইউসিএন বলছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ এই বনের বাঘসহ বন্যপ্রানী ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ যথাযথো পদক্ষেপ নেয়নি। সুন্দরবনের সাম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরূপন না করে কোন পরিবেশগত সমিক্ষা ছাড়াই সুন্দরবনের কোলঘেষে বাগেরহাটের পশুর নদীর তীরে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান কাজ শুরু করে সরকার। এমনিতেই সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে জাহাজ চলাচল, ড্রেজিংসহ সুন্দরবনের পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’য় (ইসিএ) শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের এই ম্যানগ্রোভ বনটির প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির মুখে রয়েছে মনে করে স্ংস্থা দুটি। রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনকে আরো সংকটাপন্ন করে তুলবে বলে বাংলাদেশকে জানায় ইউনেস্কো ও আইইউসিএন।

তারা এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে অনত্র সরিয়ে নিতে ২০১৬ সালে সরকারকে অনুরোধ জানায় তারা। সুন্দরবন সুরক্ষায় সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না জানিয়ে গত ৪ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ও আইইউসিএনকে চিঠি দেয়। এই অবস্থায় গত ৭ জুন আইইউসিএন তাদের ওয়েবসাইডে সুন্দরবন নিয়ে আশংকার কথা জানিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সুন্দরবন, মেক্সিকোর দ্বীপপুঞ্জ, ক্যালিফোনিয়ার উপসাগরীয় এলাকা ও উত্তর মেসিডোনিয়ার ওহরিড অঞ্চলকে বিপদ সংকুল ওয়ার্ল্ড হ্যরিটেজ হিসেবে উল্লেখ করে। প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক পরিষদ আইইউসিএন সুন্দরবনকে বিপদসংকুল বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণার জন্য ইউনেস্কো হ্যরিটেজ কমিটির সদস্যদের কাছে প্রস্তাব করে। সুন্দরবন নিয়ে আইইউসিএনের প্রস্তাবনা আগামী ৩০ জুন থেকে ১০ জুলাই আজারবাইজানের রাজধানী বাক’তে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এই অবস্থায় নড়েচড়ে বসেছে সরকার।

ইতিমধ্যেই ফ্রন্সে গিয়ে বিদ্যুৎ সচিব ড. আহমেদ কায়কাইসের নের্তৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি সরকারী প্রতিনিধি দল সুন্দরবন সুরক্ষায় বাংলাদেশের নেয়া সর্বশেষ পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে আইইউসিএন সদস্যদের ব্রিফ করে গতকাল (২৬ জুন) দেশে ফিরেছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধি দলটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য সম্মেলনে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যরিটেজ কমিটির সদস্যদের’ বাংলাদেশের অবস্থান জানাতে ১ জুলাই আজারবাইজানের রাজধানী বাক’তে যাচ্ছেন। সুন্দরবন বিভাগ বলছে, বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ায় বর্তমানে ওয়ার্ল্ড হ্যরিটেজ সুন্দরবন নিয়ে আতংকিত হবার কোন কারন নেই। সুন্দরবন আগের থেকে এখন অনেক সুরক্ষিত রয়েছে।

জীব বৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এরমধ্যে স্থল বা বন ভাগের পরিমান ৪ হাজার ১৪২. ২ বর্গ কিলোমিটার ও জল ভাগের পরিমান ১ হাজার ৮৭৪.১ বর্গ কিলোমিটার। ম্যানগ্রোভ এই বনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও দুই প্রজাতির হরিণসহ মোট ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। এরমধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। সুন্দরবন জুড়ে ৪৫০টি নদ-নদী ও খালে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, বিশাবখ্যাত শিলা কাঁকড়াসহ ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন। সুন্দরবন বিশ্বের অন্যান্য ম্যনগ্রোভ বনের তুলনায় জীববৈচিত্র্যে অধিকতর সমৃদ্ধ। এসব কারণে সমগ্র সুন্দরবনের জলাভূমিকে বিশ্বের সব চেয়ে বৃহৎ হিসেবে ১৯৯২ সালে ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনের ৩টি এলাকাকে ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড হিসেবে ঘোষণা করে।

সুন্দরবনের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ অভয়ারণ্য নামে এই ৩টি ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড বা বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকার আয়তন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর। যা সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ২৩ ভাগ এলাকা।

সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণার পর থেকে ইউনেস্কো এই ম্যানগ্রোভ বন সুরক্ষায় আর্থিক, কারিগরী ও বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে আসছে।

(এসএকে/এসপি/জুন ২৮, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test