E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাগুরার ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীকে ঢাকার ধর্ষণ মামলার আসামি!

২০১৯ জুলাই ১৪ ১৬:৪১:৫১
মাগুরার ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীকে ঢাকার ধর্ষণ মামলার আসামি!

মাগুরা প্রতিনিধি : পাঁচ বছর আগে এসএসসি পরিক্ষার সময় ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে জাবের শেখ (২২) এর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ভারী কাজ করতে না পারায় নিজ বাড়ির অদুরে একটি ছোট মুদির দোকান দিয়ে কোনমতে সংসারে সাহায্য করে সে। দারিদ্র থাকলেও  বাবা-মা আর বড় ভাইয়ের সংসারে সুখের অভাব ছিল না জাবেরের। কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎ শ্রীপুর থানা পুলিশের মাধ্যমে ঢাকার রূপনগর থানায় একটি ধর্ষণ মামলার ২নং আসামি হিসেবে একটি গ্রেফতারী পরোয়ানা আসে জাবের শেখের নামে। 

এতে যেন হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়লো জাবের ও তার বৃদ্ধ বাবা হাফিজার শেখের মাথায়। তারাউজিয়াল গ্রামের প্রতিটি মানুষ যে ছেলেটিকে অসুস্থ, ধার্মিক ও ভাল ছেলে হিসেবে জানে তার নামে এমন পরোয়ানা গ্রামের কেউই মেনে নিতে পারছেন না। খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এ গ্রামেরই আর এক ধূর্ত ও মামলাবাজ আকমল মোল্যার নাম। যিনি টাকা আদায়ের জন্য ঢাকায় বসে এই পরিবারটিসহ ওই গ্রামের ৩জনকে আসামী করে ঢাকার একটি মেয়েকে দিয়ে এ ধরনের মামলা করিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ওই গ্রাম থেকে ওহাব শেখ নামে এক ব্যক্তিকে স্বাক্ষী করা হলেও তিনি ওই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেননা বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

সরেজমিনে বর্গা কৃষক হাফিজার শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছেলে জাবেরের নামে ধর্ষণের মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর পেয়ে পরিবারটি মুষড়ে পড়েছে। গ্রেফতার এড়াতে জাবের দোকানটি বন্ধ করে অসুস্থ অবস্থায় পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হেেচ্ছ । তার তার বৃদ্ধ মা বাবা এখন নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনরাত প্রলাপ বকছেন।

জাবেরের বাবা হাফিজার শেখ অভিযোগ করেন- একই গ্রামের আকমল মোল্যা নামে এক ব্যক্তি পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ঢাকায় ছোট ছেলে জাবেরসহ ওই গ্রামের রাজু মোল্যা ও আকমল মোল্যার আপন ছোটভাই আলম মোল্যার নামে মোসাম্মৎ বিপুল নামে এক নারীকে দিয়ে ঢাকায় এ মিথ্যা মামলাটি করিয়েছে। ঘটনার স্থান হিসেবে ওই নারী ঢাকার রূপ নগর হিসেবে উল্লেখ করলেও মামলার ২ ও ৩ নং আসামী জাবের শেখ ও আলম মোল্যা কোনদিন ঢাকায়ই যায়নি বলে দাবী করেন তিনি।

মামলার অপর আসামি আলম মোল্যার স্ত্রী রূপিয়া বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, আমার স্বামী অত্যন্ত সহজ সরল। দিনমজুরি করে তাদের সংসার চলে। কিন্তু বড় ভাই আকমল মোল্যার সাথে একটি টারকি মুরগি মেরে খাওয়ার দোষ দেয়া নিয়ে সামন্য মনমালিন্য হয়। এরপর ভাই আকমল হোসেন ঢাকায় গিয়ে মোছা. বিপুল নামে এক মহিলাকে দিয়ে আদালতে একটি মামলা করিয়েছে। যে মেয়েটিকে আমার স্বামী কখনও চিনিও না। ওই মামলা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।

শ্রীপুর থানা থেকে পুলিশ এসে আমার স্বামীর নামে ওয়ারেন্ট আছে জানালে আমরা রীতিমত আতংকে পড়ে গেছি। সামন্য ঘটনায় ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেউ এমন গুরুতর মামলা দিতে পরে এটা আমরা ভাবতেই পারছি না। আমার স্বামী বাধ্য হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সংসার চালাতে আমার ১০ম শ্রেণীতে পড়া ছেলে অন্যের ক্ষেতে মজুর দিতে বাধ্য হচ্ছে।

স্থানীয় সব্দালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বর তারাউজিয়াল গ্রামের বাসিন্দা বাদশা মোল্যা জানান, আকমল এলাকায় একজন ধূর্ত ও মামলাবাজ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে নিজ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে থাকছে। সুযোগ বুঝে গ্রামের সাধারণ ও সহজ সরল লোকজনকে নানারকম হয়রানি করে টাকা আদায় করাই এখন তার কাজ। জাবের বাবার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবী করায় তা না পেয়ে জাবেরকে একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার আসামী করেছে। এখন টাকা দিলে ওই ধর্ষণ মামলা তুলে নেয়া হবে বলে সে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাঠাচ্ছে।

এমনকি সামান্য সাংসারিক মনমালিন্য থেকে আকমল তার আপন ছোটভাই আলম মোল্যাকেও ওই ধর্ষন মামলার আসামী করেছে। একই গ্রামের প্রতিবেশী রাজু মোল্যার সাথেও পারিবারিক বিরোধের কারণেই সে এ মামলা করিয়েছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করে আকমলকে গ্রেফতারসহ পরিবারগুলির হয়রানি বন্ধের আহবান জানান।

মামলার স্বাক্ষি ওই গ্রামের ওহাব শেখ জানান- মামলার ২ নং আসামী জাবেরর বড় ভাই আবজাল শেখের সাথে কিছুদিন আগে তার স্থানীয় একটি ঘটনা নিয়ে হাতাহাতি হয়। এতে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও অবনতি করতে আমি কিছু না জানা সত্বেও আমাকে ঢাকার ওই মামলায় স্বাক্ষী করে আকমল। আমি তাকে স্বাক্ষী থেকে আমার না কাটিয়ে দিতে বললে সে স্বাক্ষী থেকে আমার নাম কাটার জন্যও ৪০ হাজার টাকা দাবী করে।

আমতৈল মাধ্যমিকি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফয়জুর রহমান, তারাউজিয়াল গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা হবিবর রহমান, মুন্সী মোঃ ইউনুস আলী, ময়ুরুন নেসাসহ একাধিক গ্রামবাসী জানান- ৫ বছর আগে স্কুলেই ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পরে জাবের। পরে স্কুলের পক্ষ থেকে তাকে যশোরে নিয়ে সিটি স্ক্যান করানো ও চিকিৎসা করানো হয়। এরপর থেকে জাবের স্বাভাবিক লেখাপড়া করতে পারে না। সে ওই গ্রামের অত্যন্ত নিরীহ একটি ছেলে। ঢাকা তো দুরের কথা অসুস্থ্যতার কারণে সে কখনো আশপাশের দুএক গ্রামের বাইরে কোথাও যায়না। শারীরিক অসুস্থ্যতার কারণে সে তেমন ভারি কাজও করতে পারে না। তাকে এভাবে হয়রানিমুলক মামলা দিয়ে নাজেহাল করা খুবই খারাপ কাজ হয়েছে। আমরা মিথ্যা মামলাবাজ আকমলের গ্রেফতার, উপযুক্ত বিচার ও শাস্তি চাই।

বাদিনী মোসাঃ বিপুলকে মোবাইলে না পেয়ে তার ভগ্নিপতি মোঃ মনিরের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান। বিপুলকে দিয়ে আকমল এ মিথ্যা মামলা করাচ্ছে। তিনি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও বিপুল তা কথা না শোনায় তিনি এখন আর তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার এসআই লুৎফর রহমান জানান- আমাদের কাছে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা এসেছে। আমরা আদালতের নির্দেশ পালন করতে বাধ্য। এর বেশী আমাদের বলার কিছুই নেই।

মামলায় মোসা. বিপুল নামে ওই নারী উল্লেখ করেন- গত ২২/১০/২০১৮ তারিখ রাতে মাগুরার তারাউজিয়াল গ্রামের ১) রাজু মোল্যা ২) জাবের শেখ ও ৩) আলম মোল্যা তিনজন মিলে তার ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসায় গিয়ে জোর করে ধর্ষণ করে।

এ ব্যাপারে ২৪/১০/১৮ তারিখে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। পরে ২৫/১০/১৮ তারিখে রূপনগর থানায় মামলা দিতে গেলে তারা মামলা না নিয়ে আদালতে গিয়ে মামলা করার পরামর্শ দেয়। সে মোতাবেক ২৯/১০/১৮ তারিখে তিনি বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল নং-০৩ ঢাকা এ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নং ৩২৮/২০১৮ দায়ের করেন।

তবে মোবাইল ফোনে তার বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা মামলা করানের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত আকমল মোল্যা। তবে তিনি এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অস্বীকার করেন।

(ওএস/এসপি/জুলাই ১৪, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test