E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

পারস্পরিক সহযোগিতায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামতে ব্যস্ত বন্যা দুর্গতরা

২০১৯ আগস্ট ০৩ ২৩:১৭:২২
পারস্পরিক সহযোগিতায় বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামতে ব্যস্ত বন্যা দুর্গতরা

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : নেমে গেছে বন্যার পানি। ভেসে উঠেছে রাস্তাঘাটের ক্ষতস্থানগুলো। বিধ্বস্ত বাড়িঘর। সামনে ঈদ। আনন্দ-আয়োজনের লেশমাত্রও নেই কারো চোখেমুখে। ঘরবাড়ি মেরামতে সবাই এখন মরিয়া। পকেটে কামলা খরচ নেই। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কিছুলোক একত্র হয়ে একজন আরেকজনের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ঠিকঠাক করার কাজে লেগে গেছেন। দু বেলা দু মুঠো ভাতের যোগাড় না হলেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতভিটেয় ফের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে দিনরাত কাজ করছেন যমুনাপাড়ের মানুষজন। তাদের মলিন মুখে যেন ভেসে উঠেছে সর্বনাশা বন্যার সকরুণ চিহ্ন আর অসহায়ত্বের নির্মম বাস্তবতা। এমনই চিত্র এখন জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার পাথর্শী ইউনিয়নের সর্বত্র।

পাথর্শী শেখবাড়ি হাফেজিয়া মাদরাসায় ১৫ দিন ধরে থাকত তিন পরিবার। এদের ঘরবাড়ি পুরোটাই বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে। পানি নেমে যাওয়ায় তাদের বসতভিটের উঠোন জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোটোবড় খাদ। মাদরাসায় ছাত্ররা এসে পড়ায় সরে পড়তে হয়েছে তাদের। উপায়ন্তর না দেখে সেই খাদের ভেতরেই পুরনো আর ভাঙাচুরা টিন-বাঁশ দিয়ে কোনোমতে ছাপড়াঘর তুলে দিচ্ছেন এলাকার লোকজন। সেই ছাপড়া ঘরের একপাশে বসে কাঁদছিলেন ৩০ বছর বয়সী চামেলি বেগম। স্বামী মনিরুল ইসলাম (৪০) দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ১ কন্যাশিশু ও মাদরাসা পড়ুয়া ২ ছেলেকে নিয়ে তার দিশেহারা অবস্থা। তিনি বলেন, আংগরে সয়-সম্পদ নাই। গরুছাগল-হাঁসমুরগি যা আছিল বেবাখই ভাইস্যে গেছে গো ভাই। বাড়ির মধ্যে দউ পড়ছিল, এই যে দেহেন গাতাগুতা। সিমিটের খাম, টিন এমুনভাবে দুমড়াইয়্যে গেছে, এডি আর কিবে কইরে ঠিক করমু! তারপর হতাশামাখা শ্বাস ছেড়ে আবার বললেন, এডা স্লিপও পাই নেই। গরিব গরে কেউ দেহে না। পেপারে আংগরে কতা নেইখ্যে আর কি অবো, যুদি পারেন চাইরডে ডাইল-চাইল দিয়ে যান, খাইয়্যে বাঁছি।

এই মাদরাসায় আশ্রয় নেওয়া অপর দুই পরিবারের একই দশা। আবুল হাশেম (৫৫) তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম (৪০) ও ৪ ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠেছিলেন সেই মাদরাসায়। কিছুই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন নি। আচমকা পানির ¯্রােতে ভেসে গেছে ঘরের ধান-চাল ও গবাদি পশু। তিনি বলেন, পানির মইধ্যে কই যাইতাম? চারদিকে পানি আর পানি। হারাদিনে ১ বেলাও খাইছি, না খাইয়্যেও থাকছি। কয়েক সের চাইল-চিড়ে পাইছিলেম, আর কিছুই নে। এহনকা এই যে দেহেন ঘরবাড়ি ঠিকঠাক করতাছি। তাও কামলা নিবের সামর্থ্য নাই। এই কয়ডা মানুষজুন মিলে এর ওর বাড়ি ঠিক করে দিতাছি। এমুন কইরে‌্যই এহন আংগরে দিন কাটতাছে।

আশ্রয়ে থাকা খালেদা বেগম (৩৫) জানালেন, কতজুনে কত কিছু পাইলো। আংগরে বাহুবল নাই, তাই কিছুই পাই নাই। এডা স্লিপ পাইলেও মুনডারে বুঝ দিবের পাইতেম। খালেদার স্বামী আব্দুল কাইউম (৫০) বলেন, এক ছাওয়াল আইএ (এইচএসসি) পড়তাছে। আরেক ছাওয়াল দিনমজুরি করে। দিনমজুর ছাওয়ালডার কামাইয়ে আমরা বেবাহেই চলি। আমিও গঞ্জে যাই, কাম পাইলে করি, না পাইলে ফিরে আহি।

বিধবা হিমানি বেগম (৬৫) তার ভাঙাচুরা ঘরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, মাদরাসা থাইক্যে আইয়ে পইরে আরেক বিফদে পরছি। ভাঙা ঘর, থাহি এলখাই। এহন ঘরডা ঠিক অইলে এট্টু ঘুমাবের পাইতেম। কফালে শান্তি নাই, সোয়ামী মরার পর ২ ছেলে বউ-পোলাপান নিয়ে ঢাহার বস্তিতে থাহে। মুন চাইলে কিছু পাঠায় আর এর বাড়ি ওর বাড়ি কাম কইরে‌্য খাই। মেম্বরে খালি এগরে ওগরে সাইয্য দিছে, আমি পাই নেই, এডা বিধবা কাড দিলেও চলবের পাইতেম। এহন বাইছে থাহাডাই ধইনশইন।

শনিবার (৪ আগস্ট) ইসলামপুর উপজেলার পাথর্শী ইউনিয়নের পাথর্শী, মরাডুবি, শেখপাড়া, মন্ডলপাড়া ও মুরাদাবাদ গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামতে ব্যস্ত বন্যাদুর্গত লোকজন। কিছুলোক একত্র হয়ে একটি টিমওয়ার্কের মতো স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে একে অপরের ঘরবাড়ি মেরামত করে দিচ্ছেন। হাতে নগদ টাকা ও পরিবারে সমর্থবান লোক নেই যাদের, এমন সব লোকজন একত্র হয়ে এই স্বেচ্ছাশ্রমের কাজে অংশ নিয়েছেন বলে জানালেন পাথর্শী গ্রামের মৃত রফিজ উদ্দিন শেখের ছেলে জহুরুল হক (৬৫)।

স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন তাঁর মতো আরো ৭ জন। একই গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে রব্বানি (১৭), ছাদেক আলীর ছেলে আবু সাইদ (৪০), আব্দুর রউফের ছেলে আনিসুর রহমান (৫৫), ছোবহানের ছেলে জামাত আলী (৬৫), জসিম উদ্দিনের ছেলে আকবর হোসেন (৩৭), আবুল হোসেনের ছেলে সুন্দর আলী (২০), আবুল হোসেন মন্ডলের ছেলে শওকত আলী (৫৫) স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে আবুল হোসেনের ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য কাজ করছেন।

(আরআর/এসপি/আগস্ট ০৩, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test