E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জনবল ও চিকিৎসক সংকট

মাগুরা হাসপাতালে দালালদের খপ্পরে হয়রানির শিকার হচ্ছে রোগীরা

২০১৯ সেপ্টেম্বর ১১ ১৫:৫০:২৮
মাগুরা হাসপাতালে দালালদের খপ্পরে হয়রানির শিকার হচ্ছে রোগীরা

দীপক চক্রবর্তী, মাগুরা : জনবল, চিকিৎসক সংকট ও দালালদের দৌরাত্ম সহ  নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলছে মাগুরা সদর হাসপাতাল । বর্তমানে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে । ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ভবনটির সকল প্রকার কাজ শেষ হলেও তা এখনো চালু হয়নি  চিকিৎসা কার্যক্রম । সাময়িকভাবে ওই ভবনে কাজ চলছে জরুরী ও প্যাথলজি বিভাগের কার্যক্রম ।  

জানা গেছে, ২ বছর আগে মাগুরা একশ’ শয্যার সদর এ হাসপাতালটি ২৫০ শষ্যায় উন্নিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালের ২১ মার্চ অনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ হাসপাতালটি। তবে কিছু কাজ বাকি থাকায় এখনো আড়াইশ’ বেডের পরিপূর্ণ কার্যক্রম শুরু হয়নি। শুধুমাত্র ইমার্জেন্সি ও প্যাথলজি বিভাগ নতুন ভবনে চালু হয়েছে। ৬ তলা বিল্ডিংয়ের ৩ তলাটি ব্যবহার হচ্ছে মাগুরা মেডিকেল কলেজ এর ক্লাসরুম ও অন্যান্য কাজে। নতুন বছরে ছাত্রছাত্রী ইতিমধ্যে ভর্তিও হয়ে গেছে। বর্তমানে এ হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন তিনশ’ রোগি ভর্তি থাকছে। জরুরী বিভাগ ও আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছে প্রতিদিন দুই থেকে তিনশত রোগী।

হাসপাতালে গিয়ে দেখাগেছে-বর্তমান পুরাতন ভবনে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ও সার্বিক কার্যক্রম চলছে । তিনতলা বিশিষ্ট ১০০ শয্যায় সার্জারি ওয়ার্ড ২টি,মেডিসিন ওয়াড ২র্টি,শিশু ওয়াড ১র্টি,গাইনি ওয়াড ১র্টি ও অর্থোপেডিক্সস ওয়ার্ড ১টি সহ মোট ৭টি ওয়ার্ড রয়েছে । বর্তমানে প্রতিটি ওয়ার্ডে ৮-৯ শয্যা থাকলেও রোগীর সংখ্যা বেশি থাকায় জায়গা সংকুলান হয় না । ফলে অনেক রোগীকে বারান্দায় অথবা মেঝেতে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে । এছাড়া আছে বাথরুমের বিকট র্দূগন্ধ। আর ময়লা আর্বজনায় ভরপুর হাসপাতাল চত্বর। সব মিলেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।

বিভিন্ন ওয়ার্ডের স্টাফ নার্সরা জানান, বর্তমানে গরমের কারণে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হওয়ায় শিশু ওর্য়াডের রোগীর সংখ্যা খুব বেশি । তাছাড়া সার্জারি ,মেডিসিন ও গাইন বিভাগে রোগীদের প্রচন্ড চাপ থাকায় অনেক রোগীকে মেঝেতে অথবা বারান্দায় চিকিৎসা সেবা নিতে হচ্ছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ২৮জন চিকিৎসকের পদ রয়েছে । তার মধ্যে কর্মরত রয়েছে ২৩ জন । চিকিৎসক সংকট রয়েছে ৫ জন । বর্তমানে সদর হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট চক্ষু, সার্জাারি, মেডিসিন, ইএনটি, জুনিয়র কনসালন্টে অর্থো, গাইনি, প্যাথলজি, এ্যানেস:, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, প্যাথলজিষ্ট, রেডিওলজিষ্ট, ডেন্টাল সার্জনগন নিয়মিত চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন ।

মাগুরা সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স বিউটি বিশ্বাস বলেন, আমাদের সদর হাসপাতালে সুপার ভাইজারসহ সিনিয়র স্টাফ নার্সের পদ রয়েছে ৮৮ জন। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ৮২ জন। নার্স পদে শূন্য রয়েছে ৬টি।

মাগুরা সদর হাসপাতালের ডাটা এন্ট্রি কম্পিউটার অপারেটর শাহানাজ পারভীন বলেন, ৩য় শ্রেণির কর্মচারী সংখা রয়েছে ২২ জন কর্মরত আছে ১৯ জন পদশূন্য রয়েছে ৩ জন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদ রয়েছে ৬২টি। বর্তমানে কর্মরত রয়েছে ৪৩ জন। শূন্য পদ রয়েছে ১৯টি।

তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে পরিছন্নতা কর্মীর পদ রয়েছে ২১টি। বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ১৫ জন। শূন্য পদ রয়েছে ৬টি। নিরাপত্তা কর্মীর পদ রয়েছে ৪টি। বর্তমানে কর্মরত রয়েছ ২ জন। কুক মশালচি পদ রয়েছে ৬টি। বর্তমানে কর্মরত রয়েছে ৪ জন। হাসপাতালে ৬টি ট্রয়েলেট থাকলেও ব্যাবহারের অনুপযোগী রয়েছে ৩টি।

মাগুরা সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারী এবি.এম মসলেম উদ্দিন বলেন, আমাদের সদর হাসপতালে রয়েছে লোক বল সংকট তারপর বড় সমস্যা হল ডাক্তার না থাকা। তিনি আরো বলেন এই হাসপাতালে রয়েছে অধিক শূণ্য পদ। সরকারি ভাবে ৩টি রোগি বহন করার গাড়ি থাকলেও বর্তমানে ২টি পড়ে রয়েছে ব্যবহারের অনুপযোগী হিসাবে।

হাসপাতালের বর্হিবিভাগের ঔষুধ সরবরাহ বিভাগের স্টাফ নার্স বাসন্তি রাণী বিশ্বাস জানান, প্রতিদিন আউটডোর থেকে ২৮ প্রকার ঔষুধ রোগীকে প্রদান করা হয় । জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, মাথা ব্যথা, আমাশয়, ডায়রিয়ার খাবার স্যালাইন, শিশুদের চোখের ড্রপ, এ্যান্টিবায়েটিকসহ বিভিন্ন প্রকার ঔষুধ দেয়া হয় । বর্তমানে আমাদের এখানে কোন ঔষুধ সংকট নেই ।

হাসপাতালের খাদ্য সরবরাহ বিভাগের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম জানান, রান্নাঘর সংলগ্ন টয়লেট ও টয়লেটের হাউজ থেকে পচা-ময়লা পানি চারিদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে থাকার কারণে এখানে রান্নার কাজে নিয়জিত কুকদের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এখানে কোন খাবার সংকট নেই । সকালে রোগীদের পাউরুটি, কলা, ডিম, দুপুর ও রাতে ভাত, সবজি, মাছ, ডাল দেয়া হয় । মাঝে মাঝে মাংস সরবরাহ করা হয় ।

হাসপাতালে মর্গের কর্মচারী মানু ডোম জানান, মগের্র পার্শ্বে ময়লা-আবজনার ভাগাড় থাকার কারণে আমাদেরও কাজ ব্যহত হয় । তাছাড়া এলাকাবাসীর নানা সমস্যা হচ্ছে ।

অপারেশনের কর্মচারী আইয়ুব হোসন জানান, সপ্তাহে ২দিন সার্জারি, ২দিন অর্থো ও ২দিন গাইনি অপারেশন করা হয় । বর্তমানে আধুনিক অনেক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে এখানে ।

শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসাসেবা নিতে আসা এক অভিভাবক বলেন, চিকিৎসকরা সকালে ও রাতে নিয়মিত রাউন্ড দিয়ে রোগীদের সেবা প্রদান করছেন । তবে তারা হাসপাতাল থেকে ঠিকমত ঔষুধ পাচ্ছেন না ।

সার্জারি ওয়ার্ডের চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী মাগুরা সদর উপজেলার আবালপুর গ্রামের দোলেনা জানান, তারা নিয়মিত চিকিৎসকদের সাক্ষাত পাচ্ছেন । এখানে বৈদ্যুতিক ফ্যানের অনেক সংকট রয়েছে । প্রচন্ড গরমের কারণে অনেক রোগী বেশি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ।

চিকিৎসা নিতে আসা আলী হোসেন বলেন, শয্যার সংখ্যা ও নতুন নতুন অত্যাধুনিক ভবন নির্মান হলে নেই হাসপাতালের প্রাণ চিকিৎসক। হাসপাতালে রয়েছে ডাক্তার সংকট।

হাসপাতালের চিকিৎসা নিতে আসা অপর রোগি ফাতেমা বেগম বলেন, টয়লেট থাকলেও নেই লাইট,পানি ব্যবহারের পাত্র। যা আছে তা ব্যবহার করা যায় না। তিনি আরো বলেন পরিস্কার-পরিছন্নতো দুরের কথা, কিছু করে না পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। যত্রতত্র ময়লা ও বিকট র্দূগন্ধে রোগীর সাথে আসা লোক জনেরও রোগী হয়ে যেতে হচ্ছে।

এছাড়া অনেক রোগী ও সচেতনমহল অভিযোগ করে বলেন, সদর হাসপাতালে এক শ্রেণির দালাল চক্র বিদ্যমান রয়েছে । তারা প্রতিনিয়ত গরীব,অসহায় রোগীদের হয়রানি করে চলেছে । রোগী ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে দালাল চক্র তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে স্বল্প টাকার বিনিময়ে ঔষুধ সরবরাহ করে পরে রোগীদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে নেয় ।

দালালের পাশাপাশি ঔষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা নিয়মিত হাসপাতালে যাতায়াত থাকার কারণে অনেক চিকিৎসক ঠিকমত চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে পারে না । এসব কোম্পানির প্রতিনিধিরা বর্হিবিভাগে দাড়িঁয়ে রোগীদের নিকট থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে ছবি তোলেন ও রোগীদের প্রশ্ন করেন যা অপ্রয়োজনীয় । এতে করে অনেক রোগী তাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে যান ।

সদ্য চালু হওয়া প্যাথলজি বিভাগের মেডিকেল টেকনিশিয়ান (ল্যাব) মোঃ ইসমাইল শেখ জানান, ইতিপূর্বে মাগুরা হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা ছিল না। ফলে রোগীদের বাইরে থেকে বেশী টাকা খরচ করে অধিকাংশ পরিক্ষা নিরীক্ষা করতে হতো। বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় এখানে একটি অত্যাধুনিক এনালাইজার মেশিনসহ সরকারি অনেক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে অধিকাংশ বায়োকেমিক্যাল টেস্ট সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। এখানে বর্তমানে লিপিট প্রোফাইল, পিজি, এলডিএর, এইচডিএল, এ্যালকালাইন ফসফেট, এলজিপিডি, এসজিওডির মত ব্যায়বহুল পরিক্ষাও দ্রুত ও সাশ্রয়ী খরচে সম্পন্ন করা যাচ্ছে।

তিনি জানান, বাইরে যে সকল পরিক্ষা নিরীক্ষা ৪ শ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এখানে সেই পরিক্ষাগুলি ৫০ টাকা থেকে ৪শ টাকার মধ্যে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। এছাড়া এখানে রয়েছ্ েবিশ্বের সর্বাধুনিক রেফ্রিজারেটর ব্যবস্থা। যার ফলে পরিক্ষার জন্য আনা কেমিক্যাল গুলি সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় সর্বোচ্চ সতর্কতায়। যা বাইরে অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব।

জনবল সংকট থাকলেও ওষুধের সংকট নেই উল্লেখ করে মাগুরা সদর হাসপাতালের নবাগত সিভিল সার্জন ডা. প্রদীপ কুমার সাহা বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি । সবকিছু বুঝতে সময় লাগবে । ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। নতুন চিকিৎসক নিয়োগ সম্পন্ন হলে শূণ্যতা পূরণ হবে। যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের নিষ্টার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে কঠোর নির্দেশনা দেয়েছি। হাসপাতাল গেটে দালালদের উপদ্রব্য থেকে সাধারণ রোগীকে রক্ষার জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছি। এ জেলার সকল মানুষের সহযোগিতায় একটি আর্দশ হাসপাতাল গড়ে তুলতে চাই। পাশাপাশি আমাদের সাথে সর্বসাধারণ মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন । সকলের সহযোগিতা থাকলে সদর হাসপাতালের পরিবেশ সুন্দর হবে।

(ডিসি/এসপি/সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test