E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তের বছরের দুর্নীতির টাকায় নড়াইলে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি

২০১৯ সেপ্টেম্বর ১২ ১৭:০৩:৪৩
তের বছরের দুর্নীতির টাকায় নড়াইলে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লক্ষীপাশা আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ফি বছর  বাড়লেও পরীক্ষার ফলাফলে ধস নেমেছে। বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে নারী শিক্ষার এ প্রতিষ্ঠানটি। আর এ অবস্থার জন্য শিক্ষকসহ অভিভাবকরা প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ তরফদার কামরুল ইসলামকে দায়ী করছেন। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ উঠলেও সু-চতুর ও ধুরন্ধর অধ্যক্ষ রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মহা ধুরন্ধর ও নারী লোলুপ অধ্যক্ষ তরফদার কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অত্র প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদের শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগ বাণিজ্য,আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম, শিক্ষকদের সাময়িক বহিস্কার করে টাকার বিনিময়ে পুণ:বহাল, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। মাত্র তের বছর চাকুরী করে স্রেফ দুর্নীতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে অধ্যক্ষ নড়াইল সদর উপজেলার নড়াইল- যশোর সড়কের তুলারামপুর উত্তরপাড়ে তিন তলা বিশিষ্ট বিলাস বহুল বাড়ি গড়ে তুলেছেন।

২০০৮ সালে নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এস কে আবু বাকের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তার ছেলে এরিক মোর্শেদ অত্র প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে মনোনিত হন। এরপর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে এ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমান নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরেই ধান্ধাবাজ অধ্যক্ষ কৌশলে সাংসদ এ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমানকে অত্র প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে মনোনিত করতে সমর্থ হন।

এ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমান গর্ভনিং বডির সভাপতি হওয়ার পর থেকেই দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষ সভাপতির সাথে যোগসাজগে ১৮ জন শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগের নামে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট শেখ হাফিজুর রহমানের বাড়ি উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপাশা গ্রামে হওয়ায় স্থানীয় অভিভাবক মহল ও এলাকাবাসী মুখ খোলে নাই। কিন্তু ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নড়াইল-২ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের নন্দিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তুজা সাংসদ নির্বাচিত হওয়ায় যারপরনাই খুশি হয় নড়াইল লোহাগড়াবাসী।

আর এর পর থেকেই দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সোচ্চার তথা মুখ খুলতে থাকে অভিভাবক, ক্ষতিগ্রস্থ ও নির্যাতিত শিক্ষক সহ এলাকাবাসী। অধ্যক্ষের দুর্নীতির প্রতিবাদ ও অপসারণ দাবী করে সম্প্রতি এলাকাবাসি মানববন্ধন, পোষ্টার ও লিফলেট বিতরন কর্মসূচি পালন করে। ভুক্তভোগীরা নড়াইলের জেলা প্রশাসক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংসদ সদস্য নড়াইল-২, মহাপরিচালক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, রেজিস্টার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চেয়ারম্যান যশোর শিক্ষা বোর্ড, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

সর্বশেষ ওই প্রতিষ্ঠানের পিয়ন(অফিস সহকারি) স্বপন দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নড়াইলের জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ করায় অধ্যক্ষ সহ তার স্ত্রী সেলিনা ফেরদৌস, শ্যালক মো: মোস্তফা কামাল, চাচাতো শ্যালক ঝন্টু পিয়ন স্বপনকে হুমকি-ধামকি দেওয়ায় গত সোমবার লোহাগড়া থানায় একটি অভিযোগ পত্র দাখিল করেছে। লোহাগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোকাররম হোসেন অভিযোগ প্রাপ্তির কথা নিশ্চিত করেছেন।

বিভিন্ন অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ২০০৬ সালের একটি দৈনিক পত্রিকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির জন্য অধ্যক্ষ পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ওই সময় তরফদার কামরুল ইসলাম যশোর জেলার তালবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। সেখানে দুর্নীতি ও অনিয়মে তিনি চাকুরীচ্যুত হন। একই বছরের ৬ অক্টবর লক্ষীপাশা আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজে অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি অংশ গ্রহন করে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তিনি তুলারামপুর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন, আর এ কারণেই দলীয় পদে থেকে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

অভিযোগকারীরা জানান, অধ্যক্ষ তরফদার কামরুল ইসলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। নিয়োগ ও ভর্তি বাণীজ্য, ভূয়া ভাউচার, উন্নয়নের নামে অর্থ আত্মসাত, অর্থের বিনিময়ে ছুটি প্রদান। শিক্ষকদের বেতন-ভাতার নামে অর্থ গ্রহন, কলেজে গড়হাজির থেকে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর ও পরীক্ষার সম্মানী ভাতা গ্রহন, ভূয়া পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের নামে প্রায় দুই বছর বাড়িতে থেকে বেতন-ভাতা উত্তোলনসহ অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি ব্যয়ের সঠিক হিসাবও দেননা হিসাব রক্ষকের কাছে। অধ্যক্ষের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো শিক্ষক প্রতিবাদ করলেই তার ওপর শাস্তি ও নির্যাতনের খড়গো নেমে আসে। প্রতিবাদকারী শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করারও হুমকি দেন অধ্যক্ষ।

ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষককে তিনি অন্যায় ও অবৈধভাবে সাময়িক বরখাস্থ করে ফের মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পূনর্বহাল করেছেন। সাড়ে ৫ লক্ষ টাকার অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অধ্যক্ষ তরফদার কামরুল ইসলাম একজন অফিস সহায়ক (পিয়ন) পদে নিয়োগ দিয়ে প্রায় দু’বছর অধ্যক্ষের বাড়িতে রেখে গৃহস্থলির কাজ করিয়েছেন। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, অবৈধভাবে অধ্যক্ষ তরফদার কামরুল ইসলাম বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

নড়াইল শহরের অদুরে তুলারামপুর এলাকায় তিনি কয়েক কাঠা জমির ওপর আলিশান বহুতল ভবন নির্মাণ করাসহ নামে বেনামে কয়েক একর জমি ক্রয়সহ বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন বিপুল পরিমান অর্থ। এ কাজে অধ্যক্ষকে সহযোগীতা করেছেন ওই কলেজের শিক্ষক টিএম ফেরদৌস ওয়াহিদ। অধ্যক্ষের সকল অপকর্মের অন্যতম সহযোগী হিসেবে তার কর্মের তুলনা নেই। যদিও তিনি নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করে থাকেন।

এ বিষয়ে স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর গিয়াসউদ্দিন ভূইয়া ও সৈয়দ শাহজাহান সিরাজ বিদ্যুত জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি দিন দিন ধ্বংস হয়ে মান কমে যাচ্ছে। অধ্যক্ষ তরফদার কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বহু অভিযোগ রয়েছে। নড়াইলে ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় তিনি একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছেন সাবেক সাংসদ শেখ হাফিজুর রহমান। তিনিও অধ্যক্ষকে বাঁচানোর জন্য গোপনে ব্যাপক চেষ্টা ও তকবীর যথাযথ তদন্ত হলে তার সকল প্রকার দুর্নীতির প্রমাণ বেরিয়ে আসবে।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য গত বুধবার প্রথম দফায় গর্ভনিং বডির সভা হয়েছে। আজ দ্বিতীয় দফায় আবারও গর্ভনিং বডির সভা হবে। অধ্যক্ষ দোষী প্রমানিত হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যক্ষ তরফদার কামরুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে কতিপয় শিক্ষক ও কর্মচারি এসব কাল্পনিক অভিযোগ করছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই।

(আরএম/এসপি/সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test