E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে ঘাটে বালু লুটের মহোৎসব

২০১৯ সেপ্টেম্বর ১৬ ১৮:০৬:৪৪
সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে ঘাটে বালু লুটের মহোৎসব

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ জামালপুর জেলার বিভিন্ন নদী থেকে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু লুটের মহোৎসব। জেলাজুড়ে এই মহোৎসব চললেও বালু লুট বন্ধে তেমন কোনো প্রশাসনিক তৎপরতা নেই। কালেভদ্রে জেলা প্রশাসনের অভিযান চললেও তাও সুফল মিলছে না। সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যুগযুগ ধরে বালু লুটের কারণে ব্রহ্মপুত্রের তলদেশ থেকে মাটি সরে গিয়ে নদের দুই পাড়ে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসহ হুমকির  মুখে পড়েছে বসতবাড়ি, ফসলিজমি, রাস্তাঘাট ও ব্রহ্মপুত্র সেতু। অপরদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ তার নাব্যতা হারিয়ে এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। সেই সাথে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে পরিবেশবাদীদের অভিমত।

বালু লুটকে ঘিরে একেক সময় গড়ে উঠেছে একাধিক সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে শেল্টার দিয়ে এই লুটতরাজকে জায়েজ করছে রথী-মহারথীরা। সরাসরি বালু লুটের সাথে জড়িত রয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, পৌর কাউন্সিলর, ছোট বড় নেতা, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণিপেশার লুটেরা। লুটের টাকা মাছের ভাগার মতো স্তরভেদে চলে যায় তাদের পকেটে। সিন্ডিকেটটি সরকারের রাজস্ব খাতকে শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলে প্রশাসনের নাকের ডগায় সরকারি বালু মহালগুলো থেকে কয়েক কোটি টাকার বালু লোপাট করে আসলেও আইনি জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে নির্বিকার রয়েছে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

জেলার বিভিন্ন উপজেলার যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, সুবর্ণখালী, জিঞ্জিরাম ও বংশী নদীর প্রায় ৩ শতাধিক পয়েন্টে চলছে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন। এরমধ্যে শুধু ব্রহ্মপুত্র নদেই দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা থেকে সদর উপজেলার পিয়ারপুর পর্যন্ত শতাধিক পয়েন্টে ড্রেজার মেশিনসহ নানা কায়দায় চলছে অবৈধ উত্তোলন ও বালু লুটপাট।

জামালপুর শহর থেকে পিয়ারপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পাথালিয়ার ব্রহ্মপুত্র বাঁধ থেকে শুরু করে সদর উপজেলার নরুন্দি পর্যন্ত প্রায় ২০টি ঘাটে বালু উত্তোলন হচ্ছে র্দীঘদিন ধরে। পাথলিয়া, নাওভাঙা, কম্পপুর, ছনকান্দার মাদ্রাসা ঘাট, চান্দে গেদার ঘাট, শরিফপুরে ট্যানারি ঘাট, নান্দিনার গোদার ঘাট, খড়খড়িয়া ঘাট, গোলাবাড়ি ঘাট, পালবাড়ি ঘাট, আলগীর চর ঘাট এবং নরুন্দি ও পিয়ারপুরের বেশ কয়েকটি ঘাটে বালু উত্তোলন হচ্ছে। চালুর অপেক্ষায় রয়েছে ছনকান্দার মিল্টনের ঘাট, জামালের ঘাট, বাজুর ঘাট ও মুক্কার ঘাট।

এসব বালুর খনি খ্যাত শহরের ছনকান্দা থেকে ট্রাক, ভটভটি, মাহেন্দ্র ও ট্রাক্টর যোগে বালু যাচ্ছে জেলার সর্বত্রসহ আশপাশের জেলায়। জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দু’পাশে বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে সারি সারি অবৈধ বালুর ঢিবি। প্রকাশ্যে এসব ঢিবি থেকে বালু বিক্রি হলেও দেখার কেউ নেই।

মাস দুয়েক আগে প্রশাসনিক অভিযানে বালু উত্তোলন সাময়িক বন্ধ থাকলেও জেলা প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে ফের শুরু হয়েছে বালু উত্তোলনের মহোৎসব।

বৈধভাবে বালু উত্তেলনের জন্য ২০০২ সালে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা নেন ১৬ জন ইজারাদার। ২০০৫ সালে মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্তে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে বালুমহাল ইজারা নেয়ার জন্য ইজারাদারদের নির্দেশ দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে খনিজ মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা প্রাপ্তরা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট খনিজ মন্ত্রণালয়ের ইজারাদারদের আবেদন আমলে নিয়ে খনিজ মন্ত্রণালয় থেকে নেয়া ইজারার শর্তানুযায়ী সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

এভাবেই সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দিয়ে বালু মহালগুলো থেকে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন ইজারাদাররা। ২০০৮ সালে বালু মহালগুলো দখলে নিয়ে অবৈধভাবে ফের বালু উত্তোলন করতে থাকে আরেকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। বিপাকে পড়েন বালু মহালের বৈধ ইজারাদারা। তারা বালুমহাল থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। জেলা প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে ব্যর্থ হলে বালু মহালের বৈধ ইজারাদাররা ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমা দেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে সারা জেলায় বালু উত্তোলন থেকে সরকার প্রতি বছর প্রায় অর্ধ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ছনকান্দার আনিসুর রহমান, হাজী এন্টারপ্রাইজ, মো. আব্দুল হামিদ, মোস্তাক আলম, নাজিম উদ্দিন ও মাসুদ চৌধুরীকে বালুমহালের লাইসেন্স দেয় জেলা প্রশাসন। এরমধ্যে ঘাট ইজারা পেয়েছে ইসলামপুরের মাসুদ চৌধুরী। বাকি ৫ লাইসেন্সধারীসহ অন্যরা ঘাট ইজারা না পেলেও সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে র্দীঘদিন ধরে অবৈধ বালু উত্তোলন ও বিক্রি করে যাচ্ছে।

শহরের ফেরিঘাট এলাকায় প্রকাশ্যে টুলঘর বসিয়ে স্লিপ দিয়ে বালুবাহী গাড়ি থেকে আদায় করছে বালু বিটের টাকা। বালু উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে বালু কেনার পর গাড়িপ্রতি ৩শ টাকা খাজনা আদায় করছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। মাস শেষে এই টাকা মাছের ভাগার মতো বিলিবন্টন হয় স্তরভেদে।

টোলঘরে গিয়ে দেখা হয় বালু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাবিবুর রহমান হবির সাথে। তখন তিনি খাজনা আদায়ে ব্যস্ত। কাজের এক ফাঁকে তিনি বলেন, লাইসেন্স পেয়েছি, আইনি জটিলতায় জেলা প্রশাসন ঘাট ইজারা দিচ্ছেনা। অথচ প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়নের টাকা গুনতে হচ্ছে।

ঘাট ইজারা পাননি অথচ বালু উত্তোলন ও খাজনা আদায় করছেন, কীভাবে? তাকে এই কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ঘাট ইজারা পাইনি সত্য, ডিসি অফিসের (কথিত) এলআর ফা›েড টাকা দিয়ে বালুমহাল পরিচালনা করছি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (পবা) জয়েন্ট সেক্রেটারি শরিফ জামিল বলেন, জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র নদ রক্ষা আন্দোলনের এক সেমিনারে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ পরিদর্শন করে দেখেছি, দখল ও বালু উত্তোলনের মহাযজ্ঞ। দখলদার ও বালু লুটেরাদের অপতৎপরতায় ব্রহ্মপুত্রের জামালপুর অংশ বিপন্ন হতে চলছে।

তিনি আরও বলেন, নদী দখল, বালু উত্তোলনসহ নদী ধ্বংসের নানা কর্মকান্ডে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। নদীকে মেরে ফেলার যেসব কর্মকা- চলছে তা শনাক্ত করে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বসতভিটা, ফসলি জমিসহ নদীকেন্দ্রিক বিশাল জনগোষ্ঠির জীবন হুমকির মুখে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীববৈচিত্রও। নদীকে না মেরে ফেলে বরং নদী শাসনসহ নদীকে দখলমুক্ত করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই জরুরি।

রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বালু মহাল চালুর বিষয়ে জামালপুরের জেলা প্রশাসক মো. এনামুল হক বলেন, অবৈধ বালু মহালগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(আরআর/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test