E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দিনাজপুরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই বীর মুক্তিযোদ্ধার দাফন সম্পন্ন!

২০১৯ অক্টোবর ২৫ ১৫:২৭:৩৯
দিনাজপুরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই বীর মুক্তিযোদ্ধার দাফন সম্পন্ন!

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর : জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকুরীচ্যুত, বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম/ স্যালুট আমার শেষ যাত্রার কফিনে আমি চাইনা। ভূল ত্রুটি ক্ষমা করিও। উল্লিখিত বক্তব্য আমার কথামত টাইপকৃত।

হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির বরাররে এমন একটি চিঠি লিখার ২৪ ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু বরণ করেন বীরমুক্তি যোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেন। তার এই চিঠিতে লিখে যাওয়া ওছিয়দ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা (গার্ড অফ অনার) ছাড়াই দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। জাতির শ্রেষ্ট সন্তানের শেষ বিদায়ের সময় সেখানে বিগউলে বাজেনি বিদায়ের সুর।

জানাযার পূর্ব মুহুর্তে ম্যাজিষ্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসনের চৌকশদল গার্ড অব অনার জানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেনের মরদেহ জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করা হয়নি। সদর উপজেলার ৬ নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেন পিতৃ স্নেহে চিঠিতে যা লিখে গেছেন তার মুল কথা হচ্ছে, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সুপারিশে ছেলে নুর ইসলামের নো ওয়ার্ক নো পে ভিক্তিতে গাড়ী চালক হিসাবে চাকুরি হয়। সেই সুবাদে নুর ইসলাম সদর এ্যাসিলেন্ডের গাড়ী চালাতেন।

কর্মস্থলে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সঙ্গে স্বাক্ষাত করেন। এ সময় তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে সেখানে উপস্থিত এডিসি রাজস্বকে বিষয়টি দেখতে বলেন। হুইপকে বিষয়টি আবগত করায় প্রশাসন থেকে প্রথমে নুর ইসলামকে তার বসবাসরত খাস পরিত্যক্ত বাড়ী ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়।সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এ্যাসিলেন্ড সদরের মিসেস নুর ইসলামকে বাথরুম পরিস্কার ও মাংস রান্না করতে বলেন। মাংস রান্না ঠিক না হওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে তাকে বাড়ী থেকে বের করে দিয়ে চাকুরি চ্যুত করা হয়। পরে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জাকারিয়াকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জেলা প্রশাসকও ক্ষিপ্ত হয়ে যান।

এ ছাড়াও নুর ইসলাম তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে মাফ চাওয়ার জন্য এ্যাসিলেন্ডের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ৩ ঘন্টা অপেক্ষা করেও দেখা করতে পারেনি। চাকুরি চলে যাওয়ায় আমরা উপায় না পেয়ে হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু প্রশাসন সেটি চরম নেগেটিভ ভাবে নেয়। বর্তমানে তার ছেলেটি চাকুরীচ্যুত ও বাস্তচ্যুত হয়ে স্ত্রী পুত্র পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবণ যাপন করছে।

তিনি আরো লিখেছেন, “জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়ে করা স্বাধীন দেশে আমার ছেলের রুজি রোজগারটুকুও অন্যায় ভাবে কেড়ে নেয়া হল। গত ২১.১০.২০১৯ ইং তারিখ থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল দিনাজপুরের কার্ডিওলজি বিভাগে, ওয়ার্ড নং -২,বেড নং -৪৪ এ ভর্তি অবস্থায় আছি, এই পত্রটি তোমার কাছে লিখছি। তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন তুমি ন্যায় বিচার কর। ঠুনকো অজুহাতে আমার ছেলেটিকে চাকুরীচ্যুত করায় তাকে চাকুরী ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।

আমার বয়স প্রায় ৮০ বৎসরের কাছাকাছি। ছেলেটি হটাৎ করে চাকুরী চ্যুত হওয়ায় একেই তো আমি শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য তারপর মানুষিকভাবেও ভেঙ্গে পড়েছি। জীবণ মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকুরীচ্যুত, বাস্তুচ্যত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম/ স্যালুট আমার শেষ যাত্রার কফিনে আমি চাইনা।”

পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, ২২ অক্টোবর চিঠিটিতে তিনি স্বাক্ষর করে ডাক যোগে ঢাকায় জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির বরাবরে প্রেরণ করেন। পরের দিন ২৩ অক্টোবর সকাল ১১ টার সময় হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন আবস্থায় মারা যান।

বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর সকাল ১১ টায় সদর উপজেলার ৬ নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেনের জানাযা নামাজ শুরুর পূর্ব মহুর্তে ম্যাজিষ্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসনের একটি চৌকশ দল গার্ড অব অনার প্রদান করার জন্য যান। এ সময় স্ত্রী ছেলে মেয়েরা জানায় তাদের পিতার জীবণ মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লিখে যাওয়া চিঠি অনুয়ায়ী তারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন বা গার্ড অব অনার প্রদান করতে দিবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। তাদের ভাষায় এটাই হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মরহুম ইসমাইল হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

জানাযার আগে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেনের পরিবার পরিজন দায়িত্ব দিলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাড, মোফাজ্জল হোসেন দুলাল জানাযা নামাজে উপস্থিত সকলে উদ্দ্যেশ্যে বলেন, অন্যায় ভাবে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেনের ছেলেকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি এই চিঠি লিখে গেছেন। আমরা তার লিখে যাওয়া চিঠির ওছিয়দ অনুয়ায়ী দাফন করতে চাই । চিকিৎসার জন্য তিনি অনেকের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন।

গার্ড অব অনার প্রদান করতে যাওয়া ম্যাজিষ্ট্রেককে ছেলেরা বলেন, জনগনের টেক্স এর টাকায় জেলা প্রশাসক বেতন পান। তিনি জেলার পিতা । তার সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা দেখা করতে গিয়ে দেখা পাননা। এর চেয়ে লজ্জার কি হতে পারে। এই কারণেই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রত্যাখান করেছেন।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল আলম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রশাসন থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করতে যাওয়ার পর বিষয়টি অবগত হই।

তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করতে না দেয়ায় তা প্রদান করা সম্ভব হয়নি।

উল্লেখ্য, মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেনের মুক্তিবার্তা নং ০৩০৮০১১০০২, ভাতা বই নং -৮১৯।

(এস/এসপি/অক্টোবর ২৫, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

১৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test