E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাদারগঞ্জে কর্মসৃজন কর্মসূচিতে পুকুর চুরি

২০১৯ নভেম্বর ০৭ ২৩:০২:৩৩
মাদারগঞ্জে কর্মসৃজন কর্মসূচিতে পুকুর চুরি

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির প্রকল্প বাস্তবায়নে পুকুর ভরাট কাজে বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগই হরিলুট হওয়ায় প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে শ্রমিকরা। জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার গুনারীতলা ইউনিয়নের এ প্রকল্পে ৫৩০ জন অতিদরিদ্র শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অতিদরিদ্রদের টাকা আত্মসাৎ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়ে  সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অতিদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২ কোটি ৭১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে এ বরাদ্দকৃত কাজের অংশ হিসেবে মাদারগঞ্জ উপজেলার গুনারিতলা ইউনিয়নের মোসলেমাবাদ নুরুন্নাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাটের জন্য ৪৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় জেলা প্রশাসন। মাঠ ভরাট করার কথা বলা হলেও বিদ্যালয়ের একটি পুকুর ভরাট করা হচ্ছে।

প্রকল্পটির জন্য ৫৩০ জন অতিদরিদ্র শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরিতে মাটি কেটে পুকুরটি ভরাট করার কথা ছিল। কিন্তু স্থানীয় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ইমরান খান বাছেদ প্রকল্পটির সভাপতি হলেও মূলত: ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন আয়না নিজেই কাজটির তত্ত্বাবধান করেন। প্রকল্পের শুরু থেকেই তিনি শ্রমিক দিয়ে কাজ না করিয়ে নিকটবর্তী ডোবায় ড্রেজার বসিয়ে বালিমাটি ও কিছু মাটি দিয়ে পুকুরটি ভরাট দেখিয়ে পুরো টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।

ঘটনাটি ফাঁস হলে উপজেলা নির্বাহী অফিারের বরাবর ইউপি চেয়ারম্যান আয়নার বিরুদ্ধে প্রকল্পের টাকা আতœসাতের অভিযোগ করেন স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিরা। অভিযোগে বলা হয়, গত অর্থবছরের ১৫ জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখনো কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প কমিটি কাজের পুরো বিল তুলে নিয়েছে গত জুন মাসের মধ্যেই। বিষয়টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকেও জানানো হয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুর রহমান বেলাল গত ১৬ অক্টোবর সরজমিনে গিয়ে ডেজার দিয়ে পুকুরে মাটি ভরাট কাজের অস্তিত্ব পান। তিনি শ্রমিকদের দিয়ে কাজ না করানোর বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তার তদন্ত প্রতিবেদনটি ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়ে প্রকল্পটির কাজে অনিয়মের উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন আয়না দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে নতুন করে ফের ড্রেজার মেশিন বসিয়ে কয়েকদিন ধরে পুনরায় ড্রেজারে মাটি ভরাট কাজ শুরু করেছেন। মঙ্গলবার দুপুরে প্রকল্প স্থানে গিয়ে দেখা গেছে, পাইপ দিয়ে ড্রেজারে বালিমাটি এনে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। সেখানে কোনো অতিদরিদ্র শ্রমিক নেই। প্রকল্পের কোনো সাইনবোর্ডও নেই।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মোস্তাফিজুর রহমান সাজু অভিযোগ করে বলেন, গত অর্থ বছরের এই কাজ এখন বাস্তবায়ন ধেকোনোর পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এর পরও সেখানে শ্রমিক দিয়ে কাজ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের নিয়ম রয়েছে সেখানে তিনি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে কাজ করছেন। এভাবেই ড্রেজারে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। ফলে কাগজে কলমে ৫৩০ জন শ্রমিকের তালিকা জমা দিলেও কার্যত কোনো শ্রমিক মজুরি পায়নি। ইউপি চেয়ারম্যান আয়না প্রকল্প সভাপতিকে দিয়ে শ্রমিকদের ভুয়া টিপ/স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে শ্রমিকদের মজুরির পুরো টাকাই আত্মসাৎ করেছে তারা। এ নিয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাচ্ছি না।’

প্রকল্পটির সভাপতি গুনারীতলা ইউপি সদস্য ইমরান খান বাছেদ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সময়মতোই কাজ বুঝিয়ে দিয়েছি। কাজের বিলও তুলেছি।’ শ্রমিকদের দিয়ে কিছু কাজ করেছি আবার ড্রেজার দিয়েও কাজ করেছেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান। কত জন শ্রমিককে মজুরি দেয়া হয়েছে এবিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

গুনারিতলা ইউপি চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন আয়না অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘পুকুর ভরাট কাজে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। এখন যে ড্রেজার দেখলেন তা প্রকল্পের কাজ নয়। আমি বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আরো কিছু বালিমাটি ভরাট করে দিচ্ছি। স্থানীয় একটি মহল হয়রানি করার উদ্দেশে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ করেছে।’

মাদারগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে পুকুর ভরাট প্রকল্পের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মাদারগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগনেতা মো. ওবায়দুর রহমান বেলাল অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরজমিনে গিয়ে পুকুর ভরাট প্রকল্পের অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করেছি। তদন্তকালে উপজেলার প্রমাসনের অনুমোদিত তালিকাভুক্ত অতিদরিদ্র শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হয়নি বা এরকম কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তবে ড্রেজার দিয়ে বর্তমানে মাটি কাটা হচ্ছে এমন প্রমাণ মিলেছে। ৫৩০ শ্রমিকের মজুরি ও নন ওয়েজকষ্টসহ ৪৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা প্রকল্পটির বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং উচ্চ পর্যায়ে তদন্তের জন্য প্রতিবেদনসহ সুপারিশ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছেন বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, গত অর্থ বছরে গত ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির প্রকল্প বাস্তবায়নের (দ্বিতীয় পর্যায়ে) জন্য ৪৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৩ হাজার ৩৯৩ জন শ্রমিকের মজুরি এবং নন ওয়েজকষ্ট বাবদ ২ কোটি ৭১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রশাসনের নিদ্ধান্তহীনতার কারণে প্রায় প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নের একচিত্র ছিল। মুলত: দ্বিতীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন এই প্রকল্পে বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সচেতন মহল।

(আরআর/এসপি/নভেম্বর ০৭, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test