E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেলেন নওগাঁর আতাইকুলা গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা

২০১৯ ডিসেম্বর ০৩ ১৮:৩৩:৪০
মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেলেন নওগাঁর আতাইকুলা গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা

নওগাঁ প্রতিনিধি : অবশেষে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের ১০ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা সমমান মর্যাদা পেলেন। 

মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সকল সুযোগ-সুবিধা পেতে যাচ্ছেন, স্বামী, সন্তান ও সমভ্রম হারানো এই বীরাঙ্গনারা। তবে এই ১০ বীরাঙ্গনার মধ্যে ইতোমধ্যেই ৪জন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে বেঁচে আছেন আর ৬ জন বীরাঙ্গনা। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় একটি গেজেটের মাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করেন। এতে করে বর্তমান সরকার ৪৮ বছরের লালন করা দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

বানী রানী পাল, ক্ষান্ত রানী পাল, রেনু বালা ও সুষমা সূত্রধর রোগে আক্রান্ত হয়ে অভাব-অনটনের সংসারে উন্নত চিকিৎসার অভাবে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আর বয়সের ভারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কোনমতে বেঁচে আছেন মায়া রানী সূত্রধর, রাশমনি সূত্রধর, সন্ধ্যা রানী পাল, কালীদাসী পাল, সন্ধ্যা রানী ও গীতা রানী পাল। একাত্তরের সেই দুর্বিসহ যন্ত্রনা ও সামাজিক বঞ্চনার পাশাপাশি অনেকটা দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন আর অসুস্থতার মধ্যেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম।

রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর ডান তীরে ছায়াঘেরা শান্ত আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকি-হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দোসর স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্যাতন চালায় এই পালপাড়া গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর।

এই সময় গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নীসংযোগ, লুটপাটসহ জঘন্য ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের কিশোর, যুবক, মাঝ বয়সী, ও বিভিন্ন বয়সী নারীদেরকে ধরে ওই গ্রামের সুরেশ্বর পালের বাড়ির বারান্দায় একত্রিত করে “জয়বাংলা বলতে হ্যায়, নৌকামে ভোট দিতে হ্যায়” এভাবে পাকি সেনারা ব্যঙ্গোক্তি করতে করতে সয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্রাশ ফায়ার করে গবীন্দ চরণ পাল, সুরেশ্বর পাল, বিক্ষয় সূত্রধর, নিবারন পালসহ ৫২জন মুক্তিকামী মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এ সময় পাকি হানাদার বাহিনী গণহত্যা, লুটপাট ও নারী নির্যাতনের মতো ধ্বংস লীলা থেকে বিশেষ করে নারীরা স্বামী সন্তানদেরকে প্রাণে বাঁচানোর শেষ আকুতিটুকু করলেও পাকি-জান্তাদের মন তারা গলাতে পারেনি।

উল্টো পাকি-জান্তারা সুযোগ বুঝে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নওগাঁ জেলা শহরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। ৫২ শহীদের তর-তাজা রক্তে সে দিন নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর পানি লাল হয়ে ভাসিয়ে যায়। নির্যাতিত নারী ও স্বজনদের হৃদয় বিদারক আর্তনাদ ও কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল।

চোখের জল ফেলতে ফেলতে বীরাঙ্গনা কালী দাসী পাল (৭৫) বলেন, ওই দিন সকালে যখন আমাদের গ্রামে পাঞ্জাবী (পাকি সেনা) আসে, তখন আমর স্বামীসহ বাড়ির দরজা লাগিয়ে আতœগোপনের চেষ্টা করি। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় গেটের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামীকে টেনে হেঁচড়ে পাঞ্জাবীরা রাইফেল দিয়ে মারতে মারতে যোগেন্দ্রনাথের বারান্দায় ফেলে রাখে। স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গিয়ে আমার কথা না শুনে চোখের সামনে আমার স্বামীসহ ৫২জনকে হত্যা করে উল্টো আমার ওপরও তারা নানা কায়দায় নির্যাতন চালায়। আমার এক ছেলে আছে। অভাবের সংসারে সে দিনমজুরের কাজ করে।

আমি ও পেটের তাগিদে কখনও ধান কুড়িয়ে, বয়লারের চাতালে কাজ করে, কিংবা অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দু’মুঠো ডাল ভাত খেয়ে কোনো মতো বেঁচে আছি। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকতে আর মনে হয় স্বীকৃতি পাবো না। তবে অবশেষে এই স্বীকৃতি পেয়ে আমি অনেক খুশি। এই সরকারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

বীরাঙ্গনা সন্ধ্যা রাণী পাল (৭০) বলেন, ওই দিন সকাল নয়টার দিকে পাঞ্জাবীরা আমার স্বামী বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় সুরেশ্বর পালের বাড়িতে ধরে নিয়ে লাইন করে রাখে এই দিকে পাঞ্জাবীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লুটপাট ভাংচুর ও অগ্নীসংযোগসহ নানা ধরণের নির্যাতন চালায়। আমি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়ির এক বড় মাটির ডাবরের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করি। বাচ্চার কান্না পাঞ্জাবীরা শুনতে পেয়ে আমাকে সেখান থেকে বের হওয়ার কথা বলে। তখন আমি পালিয়ে মাঠের মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।

স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকি-বাহিনীরা এই গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছে। আমাদেরকে অবশেষে বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতাসহ অনেক ধন্যবাদ। স্বামী হারানোর পর থেকে এই ৪৮ টি বছর অভাব-অনটনের মধ্যে জীবন কাটালাম। তাই স্বীকৃতির পাশাপাশি সকল সুযোগ-সুবিধা যদি দ্রুত আমাদেরকে দেয়া হতো, তাহলে যে কদিন বাঁচি তা ভোগ করে যেতে পারতাম।

রাণীনগর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এ্যাডভোকেট ইসমাইল হোসেন বলেন, অনেক চেষ্টার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার অবশেষে আতাইকুলা গ্রামের ১০বীরঙ্গনাকে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে নাম গেজেটভুক্ত করেছেন। এই স্বীকৃতি প্রাপ্তির সকল প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। বরাদ্দ এলেই আগামী বিজয় দিবসে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেয়া হবে বলে আমি আশা করছি।

নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রাণীনগর) আসনের এমপি মোঃ ইসরাফিল আলম বলেন, বর্তমান প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। অবশেষে আমাদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের এই বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা পেয়েছেন। এটি আমাদের অনেক বড় একটি সফলতা। আমার খুবই ভালো লাগছে। অবশেষে যে কজন বীরাঙ্গনা এখনোও বেঁচে আছেন, তারা অন্তত তাদের নায্য প্রাপ্যটুকু একটু হলেও ভোগ করে ও স্বীকৃতির মুকুট মাথায় নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে পারবেন।

(বিএম/এসপি/ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

১৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test