E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উপেক্ষিত বেগম রোকেয়া : পর্ব ১

রোকেয়া স্মরণে পায়রাবন্দে তিনদিনব্যাপী দায়সারা অনুষ্ঠান শুরু 

২০১৯ ডিসেম্বর ০৯ ১৫:১০:৫৫
রোকেয়া স্মরণে পায়রাবন্দে তিনদিনব্যাপী দায়সারা অনুষ্ঠান শুরু 

মানিক সরকার মানিক, রংপুর : মহীয়সী বেগম রোকেয়া ১৯৩১ সালের ৩০ এপ্রিল তার কষ্ট আর আক্ষেপের কথা প্রকাশ করে চাচাতো মোনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘শৈশবে বাবার আদর পাইনি। বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর সেবা করেছি, প্রত্যহ ইউরিন পরীক্ষা করিয়েছি, পথ্য রেধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দু’বার মা হয়েছিলুম, তাদেরও প্রাণ ভ’রে কোলে নিতে পারিনি। একজন ৫ মাস বয়সে অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বছর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়েছি। সুতরাং নুরী আর আমাকে বেশি কী কাঁদাবে ? সেতো বোঝার উপর শাকের আঁটি মাত্র। আমি আমার ব্যর্থ জীবন নিয়ে হেসে খেয়ে দিন গুনছি’- আজ থেকে ৮৭ বছর আগে মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া যেমন তার কষ্ট আক্ষেপের কথা নীরব-নি:শব্দে লিখে গেছেন, আজ তিনি বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে বরাবরে মতই রাষ্ট্রের দায়সারা কর্ম দেখে আরও বেশি কষ্ট পেতেন তিনি।

প্রতি বছরের মত এবারও মহীয়সীর জন্মভূমি রংপুরের পায়রাবন্দে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনদিনব্যাপী নেয়া হয়েছে কিছু কর্মসূচী। এসবের মধ্যে রয়েছে, প্রথম দিন সকাল ৯টায় পায়রাবন্দে রোকেয়ার স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, ১০ টায় মিলাদ মাহফিল আর বিকালে মেলা উদ্বোধন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনেও স্থানীয় আলোচক ও শিল্পীদের নিয়ে একই ধরণের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এছাড়া মেলায় থাকছে গুড়ের জিলাপি, চুরি ফিতা আর কাঠের তৈরি শিশুদের খেলনা। পায়রাবন্দ তথা রংপুরবাসী রোকেয়া দিবসে প্রতিবারের মত গতানুগতিক এই কর্মসূচীকে একান্তই লোক দেখানো ও দায়সারা কর্মসূচী উল্লেখ করে বলছেন, ‘বঙ্গের মুসলিম ‘অবরোধ বাসিনী’দের মুক্ত করার জন্য যে নারী আমাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনে ‘জোয়ান অব আর্ক’ ‘হেলেন কিলার’ ‘ফ্লোরেন্স নাইট এ্যাংগেল’ মাদার তেরেসা’র মত অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাকে নিয়ে এই কর্মসূচী নিছক ঠাট্রা আর তামাশা’রই শামিল’।

পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার তথ্য সংগ্রাহক ও পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, রাষ্ট্র যদি নারী বান্ধব হতো, তবে রোকেয়া দিবসটা উপেক্ষিত হতো না। রাষ্ট্র রোকেয়াকে গ্রহণ করেননি, কিন্তু অস্বীকারও করতে পারছেন না। এই কারণে রাষ্ট্র কিছু না কিছু নামকাওয়াস্তে করছে।

তিনি জানান, বিবিসি গোটা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মাঝে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাঙালির নির্বাচনের জন্য একটি জরীপ চালায়। তাতে মহীয়সী রোকেয়ার অবস্থান রয়েছে ৬ নম্বরে। তার আগের ৫ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা এ, কে এম ফজলুল হক, ও নেতাজী সুভাষ বসু।

তিনি জানান, ময়মনসিংহের ত্রিশালে নজরুল জয়ন্তী পালন করা হয় সপ্তাহব্যাপী রাষ্ট্রীয়ভাবে। সেখানে বিখ্যাত নজরুল গবেষক করুণাময় গোস্মামী, যতীন সরকার, কবি নুরুল হুদাসহ সেই মাপের গুণীজনদের উপস্থিতি ঘটে। কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায় লালন উৎসব পালন করা হয় ৫দিনব্যাপী। সেখানে জাপানের ফাকিয়ো ইয়াসু, ভারতের শিব বাউলসহ বিশ্বের সেরা লালন গবেষকদের নিয়ে আসা হয়। শিয়ালদহে বাঙালি সংস্কৃতির মহানায়ক রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কী ধরণের অনুষ্ঠান হয় তা আমাদের সবার জানা। এছাড়াও ফরিদপুরে পল্লী কবি জষিম উদ্দিন, রাজবাড়িতে মীর মোশাররফ হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে যোগ দিয়ে থাকেন ড. আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলামের মত গুণীজনেরা। সেখানে রোকেয়া দিবসে কোন গবেষক আর কাদের নিয়ে এসে যে ধরণের অনুষ্ঠান করা হয় তা রীতিমত লজ্জাজনক।

শুধুমাত্র রোকেয়া দিবসের আলোচনা, সাংস্কুতিক অনুষ্ঠান আর মেলাই নয়, মহীয়সী বেগম রোকেয়া সকল ক্ষেত্রেই চরমভাবে উপেক্ষিত আর অবহেলিত হয়ে আসছে। দীর্ঘ বছর পর রোকেয়ার স্মৃতিকে স্মৃতিকে ধরে রাখতে ৯৭ সালে তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ হিসেবে গড়ে তেলার জন্য প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। সেসময়ই লোকবল নিয়োগসহ যাবতীয় কার্যক্রমও শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ২০০৪ সালে তৎকালীণ বিএনপি সরকারের সময়ে সেই স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ৪ কোটি টাকার অবকাঠামো, স্থাপনা মূল্যবান আসবাব বিলীণ হতে চলেছে। দেশের কোথাও কোন স্মৃুতি কেন্দ্র এমন অবজ্ঞা অবহেলায় পড়ে আছে এর নজির নেই।

অবজ্ঞা অবহেলায় পড়ে আছে রোকেয়া পরিবারের বিশাল পুকুর, হাওয়াখানাসহ সাড়ে তিন শত বিঘা লাখেরাজ জমি। এসবের মধ্যে ৫৩ একর জমি নির্ধারণ হলেও এবং এসব উদ্ধারে হাইকোর্টের আদেশ থাকলেও রাষ্ট্রের গড়িমসির কারণেই বেহাত হয়ে থাকা এসব জমি উদ্ধারে তৎপরতা নেই। এলাকাবাসীর দাবি এসব জমি উদ্ধার করে সেখানে রোকেয়া এস্ট্রেট গড়ে তোলার।

(এমএস/এসপি/ডিসেম্বর ০৯, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test